অভিযোগের মূল্য। বুথে প্রত্যেকটি ভুয়ো ভোট নিয়ে অভিযোগ জানাতে প্রিসাইডিং অফিসারকে দিতে হয় ২ টাকা। —নিজস্ব চিত্র।
বড়সড় থলির ভিতরে খলবল করছিল ২ টাকার কয়েনগুলো। গুনে গুনে ২০টা করে বের করে কর্মীদের হাতে হাতে বিলি করা হচ্ছিল। সঙ্গে নির্দেশ, ‘‘আরও কিছু কয়েন জোগাড় করে রাখবেন কমরেড।’’
‘অতি বিশ্বস্ত’ এই কর্মীরাই সোমবার ভোটে সিপিএমের এজেন্ট হয়েছেন দেগঙ্গা-হাড়োয়া-শাসনের বিভিন্ন বুথে। সংখ্যায় অন্তত দু’শো জন। যাঁদের নিয়ে শনিবার দুপুরে শাসনের এক গ্রামে সব্জির গুদামে চলছিল গোপন বৈঠক। ভোটের দিনের ‘স্ট্র্যাট্রেজি’ ঠিক করতে ৪০টি পয়েন্টে ঘণ্টা দু’য়েক ধরে চলল খুঁটিনাটি আলোচনা।
কিন্তু বুথের মধ্যে ২ টাকার কয়েন নিয়ে কী করবেন এজেন্ট?
প্রবল গরমের মধ্যে ফ্যানটুকুও নেই ঘরে। গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে নেতা বললেন, ‘‘বুথের মধ্যে ভূতেদের নেত্য তো লেগেই থাকে। আর প্রত্যেকটা ভুয়ো ভোট নিয়ে অভিযোগ করতে হলে প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে ২ টাকা জমা দিয়ে আবেদন করতে হয়। অনেক সময়ে খুচরো নিয়ে সমস্যায় অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। তাই আগেভাগে এই ব্যবস্থা!’’
বাম জমানায় ‘ভোট করানোর’ অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে বুঝি? উত্তর এড়িয়ে নেতা বললেন, ‘‘এ বার আমাদের জান কবুল লড়াই।’’
কেমন সেই লড়াই?
ক’দিন আগেই খুন হয়েছেন কীর্তিপুরের সিপিএম নেতা নূর ইসলাম মিস্ত্রি। তাঁর তিন জ্ঞাতি এ বার ভোটে সিপিএমের এজেন্ট হয়েছেন। তাঁরাও ছিলেন কর্মিশিবিরে। তাঁদের দেখিয়ে নেতা বললেন, ‘‘ওঁদের পরিবারে খুন হয়ে গিয়েছে। তবু ওঁরা এসেছেন। ভোটের দিন কাফনে ঢাকা শহিদ কমরেডের মুখটা যেন আপনাদের মনে পড়ে।’’ শুক্রবারই শাসনে মার খেয়েছেন প্রবীণ সিপিএম নেতা মহাদেব ঘোষ। বলা হল, ‘‘উনি নার্সিংহোমে শুয়ে যে লড়াইটা চালাচ্ছেন, সেটা ভুলবেন না। মৃত্যুভয় রাখবেন না।’’
‘মৃত্যুভয়’ ভুলে আর কী কী কৌশল ঠিক করে দিলেন নেতারা? তারই কিছু নমুনা—
• কৌশল ১: ভোর ৫টার মধ্যে উঠে গোসল সেরে ভরপেট নাস্তা করে বেরিয়ে পড়বেন। দুপুরের খাবার আমরা পৌঁছে দেবো। কিন্তু ধরে নিন খাবার এল না। খিদেয় মরে
গেলেও কমরেড, ওই সময়ে কিন্তু বুথ ছাড়বেন না। মনে রাখবেন, গত পঞ্চায়েত ভোটে আমাদের এক এজেন্ট দুপুরে খেতে বেরিয়েছিলেন। ওই সামান্য সময়ের মধ্যে ছাপ্পা ভোট পড়েছিল অনেক। কাজেই কমরেড, যদি খাবার না পৌঁছয়, মনে রাখবেন, ওই দিন হল আপনার নকল রোজা। ভোটের পরে সকলে মিলে ইফতার করা যাবে।
• কৌশল ২: তৃণমূলের এজেন্টরা আগেভাগে ঢুকে জানলার সামনে বসতে চাইবে। জানলার সামনে বসলে কথাবার্তা চালাতে সুবিধা হয়। আপনারা আগে থাকতে বুথে ঢুকে জানলার দখল নেবেন। এমন জায়গায় বসবেন, যেখান থেকে লাইনে দাঁড়ানো প্রত্যেক ভোটারের মুখ দেখা যায়।
• কৌশল ৩: বুথে ঢুকেই সব কিছু দেখেশুনে নেবেন। ইভিএমে ১০টা করে ভোট দিয়ে দেখবেন সব ঠিক আছে কিনা। না থাকলে প্রিসাইডিং অফিসারকে জানাবেন। ভোটের কালিও চেক করে নেবেন। ইভিএম যেখানে বসানো থাকবে, তার আশপাশে কোথাও ফুটোফাটা, গর্ত আছে কিনা ভাল করে নজর করবেন। নিজের কাছে মোবাইল ফোন রাখবেন না। অন্য এজেন্টের কাছে ফোন আছে কিনা, দেখে নেবেন।
• কৌশল ৪: সচিত্র ভোটার তালিকা মিলিয়ে দেখবেন, কারা এলাকার বাইরে আছেন। কারা মারা গিয়েছেন। আগেভাগে দেখেশুনে লাল কালি দিয়ে দেগে নেবেন। পরে ভোটের সময়ে সন্দেহ হলে সেই তালিকা মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ করবেন।
চতুর্থ দফা ভোটের দিন থেকেই জেলায় জেলায় প্রতিবাদের স্বরটা ক্রমে তীব্র হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের হাতও ক্রমশ শক্ত হয়েছে। কিন্তু এত সবের পরেও সংগঠনের জোর না থাকলে ভোটে তল পাওয়া মুশকিল, জানেন দীর্ঘ দিন ভোট করে আসা পোড়
খাওয়া বাম নেতারা। শেষ মূহূর্তে তাই ভোটের দিনের রণকৌশল ঠিক করে নিচ্ছেন তাঁরা।
বহু দৃষ্টিহীন ভোটার আছেন এই সব এলাকায়। এ দিন ব্রেইল পদ্ধতিতে ভোটের প্রক্রিয়া বুঝিয়ে দেওয়া হয় কর্মীদের। প্রত্যেক এজেন্টকে নোটবই, পেন দেওয়া হয়েছিল। আরও দেওয়া হল নির্বাচন কমিশনের বিলি করা এজেন্টদের জন্য তৈরি পুস্তিকা।
সেই সঙ্গে জরুরি কিছু ফোন নম্বর। সেখানে দলের নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসন এমনকী স্থানীয় সাংবাদিকদের নম্বরও ছিল। সঙ্গে ফুটনোট, ছোটখাট গণ্ডগোলে যেন বার বার ফোন করে সাংবাদিকদের বিভ্রান্ত না করা হয়। তেমন কিছু ঘটলে তবেই করবেন ফোন। গ্রামে ফিরে নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদেরও সমস্ত নম্বর বিলি করে দিন।
এক এজেন্ট জানালেন, গ্রামে শ’দুয়েক লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছে তৃণমূলের বাহিনী। বলেছে, ভোটের দিন যেন ঘর থেকে কেউ না বেরোয়। নেতা মুহূর্তের জন্য থমকালেন। তার পরে নির্দেশ দিলেন, ‘‘ওই গ্রামে আমরা একশো ছেলে পাঠাবো রবিবার। আর গ্রামের লোককে বলা হবে, ভোটের দিন যেন বেলা ১২টা নাগাদ এক সঙ্গে মিছিল করে ভোটকেন্দ্রে যায়। সে খবর আগে থেকে জানানো থাকবে নির্বাচন কমিশনে। নিরাপত্তাও পাওয়া যাবে তা হলে। অসুবিধা হবে না।’’
কিন্তু যদি বুথে হামলা চালায় তৃণমূল, অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে, মারধর করে? নেতা বললেন, ‘‘যদি দেখেন ভয় লাগছে, আমাদের জানাবেন। আমরা ব্যবস্থা নেব।’’
কী ব্যবস্থা? জানা গেল, যত জন এজেন্ট দেওয়া হচ্ছে, সমসংখ্যক কর্মীকে বাইরে মজুত রাখা হবে। তাঁদেরও এজেন্ট হওয়ার অনুমতিপত্র থাকবে। কেউ বেরিয়ে গেলেই যাতে অন্য জনকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া যায়।
নেতা বললেন, ‘‘ভয় পেলে জানাবেন। কিন্তু বেইমানি, গদ্দারি করবেন না। আমরা কিন্তু সে সব ধরে ফেলব।’’ কর্মীদের দিকে ছুড়ে দিলেন প্রশ্ন, ‘‘এখানে এমন কেউ আছেন নাকি?’’ সমস্বরে উত্তর ভেসে এল, ‘‘না না।’’
দমচাপা গরমের মধ্যেও হাসি ফুটল ঘামে ভেজা নেতার মুখে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy