Advertisement
১৩ নভেম্বর ২০২৪
সাঁইথিয়া চেয়ে এখনও মরিয়া বাম

তৃণমূলের সুবিধা করতে নারাজ দু’পক্ষই

সংবাদমাধ্যমে নাম পড়ে এক জন অন্যদের থেকে জানতে পেরেছিলেন, তিনি-ই এ বারে ওই কেন্দ্রের প্রার্থী। নাম ‘প্রত্যাহার’ হওয়ার দিন বিকেল পর্যন্ত আবার নিজের জন্য প্রচার চালাতে দেখা গিয়েছিল দ্বিতীয় জনকে! বাম-কংগ্রেস জোটের এমনই বেনজির ছবি দেখা গিয়েছে এ বার সাঁইথিয়া বিধানসভা কেন্দ্রকে ঘিরে। যে ঘটনায় জেতা আসন কংগ্রেসকে ছেড়ে দেওয়ার যন্ত্রণা এখনও সামলে উঠতে পারেননি দলের নিচুতলার অনেকেই।

শূন্যস্থানে বসবে কে? প্রশ্ন সাঁইথিয়ায়। —নিজস্ব চিত্র

শূন্যস্থানে বসবে কে? প্রশ্ন সাঁইথিয়ায়। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
সাঁইথিয়া শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৬ ০৩:১২
Share: Save:

সংবাদমাধ্যমে নাম পড়ে এক জন অন্যদের থেকে জানতে পেরেছিলেন, তিনি-ই এ বারে ওই কেন্দ্রের প্রার্থী। নাম ‘প্রত্যাহার’ হওয়ার দিন বিকেল পর্যন্ত আবার নিজের জন্য প্রচার চালাতে দেখা গিয়েছিল দ্বিতীয় জনকে!

বাম-কংগ্রেস জোটের এমনই বেনজির ছবি দেখা গিয়েছে এ বার সাঁইথিয়া বিধানসভা কেন্দ্রকে ঘিরে। যে ঘটনায় জেতা আসন কংগ্রেসকে ছেড়ে দেওয়ার যন্ত্রণা এখনও সামলে উঠতে পারেননি দলের নিচুতলার অনেকেই। উল্টো দিকে, বাম-কংগ্রেস জোটের এমন ‘সমঝোতা’র মাঝখানে ফায়দা লোটার চেষ্টার কসুর করছে না শাসকদল তৃণমূল। আবার কোমর বেঁধে প্রচারে নেমে পড়েছেন বিজেপি-র প্রার্থীও।

অথচ জোটের মসৃণ সমঝোতার পথে প্রাথমিক ভাবে ঠিকই হয়েছিল, ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ-ই নিজেদের জেতা আসন ছাড়বেন না। যে কারণে বামেরা প্রার্থী ঘোষণা করার পরেও কংগ্রেসের জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছে হাঁসন কেন্দ্রকে। কিন্তু, কোন ব্যতক্রমী ‘কারণে’ দলীয় নেতৃত্ব সাঁইথিয়া ছেড়ে দিলেন, কর্মী-সমর্থকদের তার কোনও সদুত্তর দিতে পারছেন না সিপিএমের জেলা নেতৃত্ব। দলের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদার বক্তব্য, ‘‘জোটের স্বার্থে আমরা ওই আসন কংগ্রেসকে ছেড়ে দিয়েছি।’’ যদিও জোটের কোন শর্তে ওই আসন ছাড়া হল, তার কোনও ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। যা বিস্ময় জাগিয়েছে সাঁইথিয়ার সিপিএম-কে। অথচ সেখানে গত দু’বারের বিধায়ক সিপিএমেরই। এমনকী, গত লোকসভা ভোটের ফলেও সিপিএম কংগ্রেসের থেকে বহু এগিয়ে। সিপিএম-এর প্রাপ্ত ভোট যেখানে ৫১,৭৫৮ সেখানে কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৫,৭৯০টি ভোট।

শুধু ভোটের ফলেই নয়, সাঁইথিয়ায় এই মুহূর্তে সাংগঠনিক ভাবেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে কংগ্রেস। বিধানসভা কেন্দ্রের ১৮টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৪টি পঞ্চায়েতই এবং সাঁইথিয়া পুরসভা বর্তমানে তৃণমূলের দখলে। সেখানে বাকি চারটি (মহম্মদবাজারের ভূতুড়া, আঙ্গারগড়িয়া, পুরাতন গ্রাম ও দেউচা) পঞ্চায়েত রয়েছে সিপিএম-এর দখলে। সম্প্রতি দলবদলের খেলায় দেউচা অবশ্য তৃণমূল দখল করেছে। আবার সাঁইথিয়া শহরের ১৬টি ওয়ার্ডের ১৫টিই রয়েছে শাসকদলের দখলে। এই পরিস্থিতিতে সাঁইথিয়া কংগ্রেসের জন্য ছেড়ে দেওয়ায় শুধু বাম কর্মীরাই নন, বিস্মিত হয়েছেন এলাকার কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদেরও অনেকে। যার সুর খানিকটা মিলেছে খোদ প্রার্থীর গলাতেই। এমনকী, কংগ্রেসের প্রকাশিত প্রথম তালিকায় সাঁইথিয়াকে দেখে, তার সদুত্তর দিতে পারেনি জেলা কংগ্রেস নেতৃত্বও। দলের জেলা সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মি তখন স্বীকারই করে নিয়েছিলেন, রাজ্য নেতৃত্বের কাছে তাঁদের পাঠানো তালিকায় সাঁইথিয়া কেন্দ্রটি ছিল না।

সাঁইথিয়া নিয়ে জেলা নেতৃত্বের ‘গাছাড়া’ মনোভাব প্রথম দিন থেকেই ক্ষুব্ধ করেছিল এলাকার সিপিএম নেতৃত্বকে। দলের মহম্মদবাজার জোনাল সম্পাদক প্রভাস মাল সরাসরিই ওই সিদ্ধান্তকে ‘আত্মহত্যার সামিল’ বলেই বর্ণনা করেছিলেন। গোটা ঘটনাক্রম দেখে দলের কর্মী-সমর্থকের একাংশ বেশ হতাশ বলে মানছেন এলাকার সিপিএম নেতারাও। এই ক্ষোভ আর হতাশা বাম-কংগ্রেস জোটের পথকে কতটা মসৃণ করবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। জেলা নেতৃত্ব কার্যত হাত তুলে নিলেও কেন্দ্র ছাড়তে এখনও রাজি নয় সিপিএমের স্থানীয় নেতৃত্ব। বরং লড়াই এখনও শেষ হয়নি বলেই মনে করছেন প্রভাসবাবুও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাঁইথিয়ার জোট প্রার্থী নিয়ে জেলা ও রাজ্যস্তরে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। রাজ্য নেতৃত্ব এ ব্যাপারে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে যাতে সাঁইথিয়া আসনটি বামফ্রন্ট পায়, তার চেষ্টা করবে বলে আশ্বাসও দিয়েছে। আমরা এখনই হাল ছাড়তে নারাজ।’’ শেষপর্যন্ত আসনটি দলই পাবে বলে তাঁর আশা।

এ দিকে, বামফ্রন্টের প্রথম তালিকায় সাঁইথিয়া কেন্দ্রে তাঁর নাম ঘোষণার পরেই জোর কদমে প্রচার শুরু করেছিলেন বিদায়ী বিধায়ক ধীরেন বাগদি। কিন্তু গত শুক্রবার ওই আসনে কংগ্রেস মদনচন্দ্র ঢুলির নাম ঘোষণা করায় হতাশ হয়ে প্রচার বন্ধ করে দেন সিপিএম কর্মীরা। গোটা ঘটনায় ধীরেনবাবুর বক্তব্য, ‘‘এ ব্যাপারে রাজ্য নেতৃত্ব যা সিদ্ধান্ত নেবেন, তা-ই আমরা মানব।’’ অন্য দিকে, কংগ্রেস প্রার্থী মদনবাবু কার্যত এখনও প্রচারেই নামতে পারেননি। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, ‘‘প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। শনিবার হঠাৎ শুনছি, আমি কংগ্রেস প্রার্থী। তা-ও আবার অন্যেরা কাগজে পড়ে আমাকে জানিয়েছেন। কাজেই প্রস্তুতি নিতে একটু সময় তো লাগবেই।’’

এলাকার দুর্বল সংগঠন নিয়ে এই লড়াই যে সহজ নয়, তা বুঝতে পারছেন কংগ্রেসের প্রার্থীও। নিজে থেকেই বলছেন, ‘‘দল যদি মনে করে অন্য কাউকে প্রার্থী করবে, তা-ও করতে পারে। আমার আপত্তি নেই।’’

ঘটনা হল, জোট-জটের এই পরিস্থিতির ফায়দা ইতিমধ্যেই নিতে শুরু করেছে শাসকদল। সোমবারই মহম্মদবাজারের পুরাতনগ্রাম অঞ্চলের মকদমনগরের মাজারে চাদর চাপিয়ে প্রচার করেছেন তৃণমূল প্রার্থী নীলাবতী সাহা। তিনি বলছেন, ‘‘কে প্রার্থী হবেন, বিরোধীরা তা নিয়েই ব্যস্ত থাকুক। আমি তো সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত এলাকার ২০টি গ্রাম ঘুরে ফেলেছি। অবশ্য উন্নয়নের জন্যই মানুষ আমাকে ভোট দেবেন।’’ উল্টো দিকে, বিজেপি-র দেওয়াল লিখন, প্রচার চলছিলই। বৃহস্পতিবার নাম ঘোষণার পর থেকে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী পিয়া সাহাও।

এই পরিস্থিতিতে চাপ বাড়ছে বই কমছে না বাম-কংগ্রেস উভয় পক্ষেরই। এলাকার দীর্ঘ দিনের এক কংগ্রেস নেতার উপলব্ধি, ‘‘মানতে অসুবিধা নেই যে এখানে আর আগের মতো দলের সংগঠন নেই। লড়তে গেলে আমাদের বাম সংগঠনের উপরেই নির্ভর করতে হবে। ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে বাম কর্মী-সমর্থকদের সাহায্য আমরা কতটা পাব, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। দু’পক্ষের রাজ্য নেতৃত্বের এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়, যাতে তৃণমূলেরই সুবিধা হয়।’’

তাই সিপিএমের জেলা নেতৃত্ব যে জোট স্বার্থের কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, সেই ‘জোট’ স্বার্থেই আসনটিতে ধীরেনবাবুকেই লড়ার সুযোগ দেওয়ার দাবি তুলেছে দলের নিচুতলা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE