ছত্রধরের মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন সুব্রতবাবু। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
বৃদ্ধার সামনে হাত জোড় করে কংগ্রেস প্রার্থী বলছেন, “প্রতিবার ভোটে নেতা জেতেন। আর জনতা হারে। মা গো, এবার জনতাকে জেতানোর লড়াইয়ে আপনাদের সমর্থন চাইছি!” বহুদিন পরে ‘মা’ সম্বোধনে খানিক চমকালেন সত্তরোর্ধ্ব বেদনবালা। তাঁর ছেলে জনগণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতো ইউএপি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খাটছেন। আমলিয়া গ্রামে টিনের চালের মাটির দোতলা বাড়িটার ধারপাশ মাড়ান না স্থানীয় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। ভোট চাওয়া তো দূরের কথা। শনিবার লালগড়ের আমলিয়া গ্রামে ছত্রধর মাহাতোর বাড়ি থেকেই নির্বাচনী প্রচার শুরু করলেন ঝাড়গ্রাম বিধানসভা আসনের কংগ্রেস প্রার্থী সুব্রত ভট্টাচার্য।
২০১১ সালে বিচারাধীন জেলবন্দি ছত্রধর ঝুড়ি প্রতীকে ঝাড়গ্রাম আসনে নির্দল লড়েছিলেন। সেবার ছেলেকে ভোট দিয়েছিলেন বেদনবালা। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি, গ্রামের অনেকেই ছত্রধরকে সমর্থন করেছিলেন। গতবার ছত্রধর কুড়ি হাজার ভোট কাটায় তৃণমূল প্রার্থী সুকুমার হাঁসদার জয় সহজ হয়েছিল। রাজ্যে ক্ষমতার পালা বদলের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা রাখেননি বলে অভিযোগ বেদনবালার। গত পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে তাই ভোট দেননি ছত্রধরের পরিবার। পাঁচ বছর পরে ফের বিধানসভা ভোট। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জঙ্গলমহলে শাসকদলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের চোরাস্রোত বইছে। নেতাই-হত্যাকাণ্ডের অস্বস্তির কাঁটা এড়াতে এ বার ঝাড়গ্রাম আসনে প্রার্থী দেয়নি সিপিএম। কংগ্রেসের প্রার্থী সুব্রতবাবুর পরিবর্তে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর নেত্রী চুনিবালা হাঁসদাকে সমর্থন করছে বামেরা। বেকায়দায় পড়লেও পরিস্থিতি সামনে নিয়েছেন সুব্রতবাবু। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভোট অঙ্কের কথা মাথায় রেখে প্রচারের প্রথম দিনেই চমক দিয়েছেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস প্রার্থী।
এ দিন ছত্রধরের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মা বেদনবালা ও স্ত্রী নিয়তি মাহাতোর সঙ্গে খোস গল্প জুড়ে দেন সুব্রতবাবু। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে লালগড়ের এক জনসভায় দাঁড়িয়ে মাওবাদী নেতা আজাদের মৃত্যুর তদন্ত চেয়েছিলেন। ক্ষমতায় এলে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও সন্ত্রাসপর্বে গ্রেফতার হওয়াদের নিঃশর্ত মুক্তির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা। ঝাড়গ্রাম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যের অসম লড়াইটা শুরু হয়েছিল তার অনেক আগে ২০০০ সালে। ওই সময় বেলপাহাড়িতে মাওবাদী সন্দেহে সাধারণ গ্রামবাসীদের উপর পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছিল। অনেকে গ্রেফতার হন। সুব্রতবাবুর উদ্যোগে মনোজ কালন্দি, অনন্দ মুড়াদের মতো মূল স্রোতে ফেরা বাসিন্দাদের কপালে কোনও প্যাকেজ-সাহায্য জোটেনি। এরপর ২০০৯-১০ সন্ত্রাসপর্বে আরও অনেকে গ্রেফতার হন। অজস্র খুনের ঘটনা ঘটেছে। আবার সিপিএম বাহিনীর হাতেও গুম-খুনের সংখ্যাটাও কম নয়। মূলধারার রাজনৈতিক নেতাদের থেকে সুব্রতবাবু বরাবরই আলাদা। অনুন্নয়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধেই তাঁর লড়াই। আলাপচারিতায় নিয়তিদেবী অনুযোগ করেন, তৃণমূলের শাসনে এলাকায় আরও খারাপ অবস্থা। দু’বছর ধরে একশো দিনের কাজ বন্ধ। যাঁরা কাজ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই মজুরি পাননি। শাসকদলের নেতাদের ঘনিষ্ঠরাই পঞ্চায়েতের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন।
অভিযোগ শুনে সুব্রতবাবু বেরিয়ে পড়লেন জনসংযোগ-প্রচারে। ছোটপেলিয়া গ্রামের মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে থাকা বৃদ্ধা পাতামণি সরেন বলেন, “ইন্দিরা আবাসে বাড়ি পেলাম। নেতারা কাগজে টিপসই করিয়ে নিয়ে গেল। দু’বছরেও বাড়ির টাকা পেলাম না।” পাশে বসে থাকা সুমি সরেন, চূড়ামণি সরেন-রা জানালেন, একশো দিনের কাজ হচ্ছে না। সেচের জলের অভাবে চাষ মার খাচ্ছে। দলিলপুর চকের বাসযাত্রী প্রতীক্ষালয়ে জিরোচ্ছিলেন কয়েকজন মহিলা। সবিতা মাহাতো, লক্ষ্মী মাহাতো, শ্যামলী মাল-রা জানান, পঞ্চায়েতে আবেদন করেও একশো দিনের কাজ জোটে নি। তাই এলাকায় পিচরাস্তা তৈরির শ্রমিকের কাজ করতে এসেছেন তাঁরা। দুপুরে খানিক বিশ্রাম নিচ্ছেন। সুব্রতবাবু নিজের পরিচয় দিতে শ্যামলীদের টিপ্পনি, “ভোট এলে সবাই হাতজোড় করে আসে। ভোট ফুরলে কেউ আমাদের মনে রাখে না।”
২০১০-এর ২২ ফেব্রুয়ারি নাড়চ্যা গ্রামে পুলিশের গুলিতে নিহত হন জনগণের কমিটির সভাপতি লালমোহন টুডু। বাড়ির উঠোনে স্বামীর স্মারকসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীমণি টুডু বলেন, “স্বামীর মৃত্যুর পরে প্রাপ্তি বলতে দু’টাকা কিলো দরে চাল। আর কিছু পাইনি। তবু আমি প্রতিবার ভোট দিই।” সুব্রতবাবু লক্ষ্মীমণির দু’টি হাত ধরে বলেন, “এতবার ঠকেছেন। রাজনীতিক হিসেবে বলতে লজ্জা হচ্ছে, তবু বলছি আমাকে একটিবার ভরসা করে দেখুন।” খিলখিলিয়ে হেসে উঠে লক্ষ্মীমণি বলেন, “আমরা তো ফুটবল। সবাই লাথি মারে। ভরসা করে বিশ্বাস ছাড়া হারাবার মতো আর কিছুই নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy