ধামসা নিয়ে প্রচারে বেচারাম মান্না। ছবি: দীপঙ্কর দে।
ধামসা, মাদলের একটানা আওয়াজে যেন সাড়া পড়ে গেল হরিপালের দ্বারহাট্টার এই প্রত্যন্ত প্রান্তরে। সঙ্গে ব্যাঞ্জোর চটুল সুর।
শুক্রবারের বারবেলায় সেই আওয়াজ শুনেই ঘর ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে ধেয়ে এল কচি কাঁচারা। সঙ্গে তাঁদের মা, দিদা, দাদু আর দিদিরা। মেঘলা চৈত্রের দুপুরে যেন আচমকাই এক টুকরো উৎসবের মেজাজ। তাঁদের দেখে, হালকা কচি কলাপাতা রঙের লম্বা ঝুলের কলার উঁচু পাঞ্জাবি আর সাদা অল্প ঘেরের পায়জামা পরিহিত ভদ্রলোক হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর মুখে এখন চওড়া হাসি-‘কী সব ভালো আছেন তো?’ প্রত্যুত্তরে তাঁকে দেখেই মহিলারা হাত নাড়লেন। উড়ে এল গাঁদা ফুলের পাপড়ি। বেজে উঠল শাঁখ।
ভিড়ের মধ্য থেকেই মহিলারা বলছিলেন, ‘গলায় উত্তরীয় দেওয়া মাঝের ওই ভদ্রলোক মন্ত্রী বেচারাম মান্না। দীপের মাঠে ফুটবল ম্যাচের সময় আমরা ওঁকে দেখেছিলাম সে বার। টিভিতেও দেখা যায়। উনি প্রতিদিন হরিপালের এক একটা জায়গায় মাইলের পর মাইল হাঁটছেন শুনছি। ভোট বলে কথা।’ হ্যাঁ, সিঙ্গুর অন্দোলনের পরিচিত মুখ বেচারামবাবুকে এ তল্লাটেই প্রার্থী করেছে তাঁর দল। হরিপাল থেকে জিতেই তিনি গত বিধানসভায় মন্ত্রী হয়েছেন।
তাঁর হাঁটা নিয়েই কথা হচ্ছিল সঙ্গীদের সাথে। অলোক সাঁতরা শাসকদলের স্থানীয় হরিপাল পঞ্চায়েত সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলান। তিনি বলছিলেন, “প্রতিদিন এক বেলায় ২২ থেকে ২৪ কিলোমিটার করে আমরা হাঁটছি। আমরা এক একটা পঞ্চায়েত ধরে ক্যালেন্ডার অনুয়ায়ী চাট করে নিয়েছি। এতে মানুষের সঙ্গে জনসংযোগটা খুব ভাল হয়। যে জায়গা বাদ পড়বে, আমরা দেখেছি সেখানকার মানুষ যেন কিছুটা হলেও তাতে ক্ষুন্ন হন।” মন্ত্রীর অপর ছায়াসঙ্গী স্বরূপ মিত্রের কথায়,“যখন যে অঞ্চলে দাদা যাচ্ছেন, সেই এলাকার কর্মীদের উপর দায়িত্ব। তার ফলে কাজ আমরা ভাগ করে নিয়েছি। কারুর উপর কিন্তু সেইভাবে চাপ নেই।” ঘাসফুল আর পতাকা, ব্যানারে সাজানো পুরো মিছিলটা। মিছিলের সামনে দশ জনের ধামসা, মাদলের টিম। মাঝে ব্যাঞ্জো।
নেতারা চাপ নেই বলছেন। কিন্তু তাতেও চাপের বহর চাপা দেওয়া যাচ্ছে কই? গড়ে প্রতিদিন চল্লিশ কিলোমিটার হাঁটাটা যে ঠিক কতটা চাপের তা শুক্রবার দ্বারহাট্টায় বেচারামবাবুর দুপুরের ডেরায় হানা দিয়েই বেশ কিছুটা মালুম পাওয়া গিয়েছে। আদুর গায়ে নেতা তখন দীর্ঘ পথ ক্লান্তির ঘাম মুখছেন। একটু পরেই সেই ঘরে ধোঁওয়া ওঠা গরম জল নিয়ে হাজির হলেন এক সঙ্গী। একটা বড় প্লাস্টিকের গামলায় তা ঢালা হল। বেচারামবাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে তাতে পা ডোবাতেই বেশি গরমে মুখ বিকৃত করে উঠলেন খানিক।
তারপর নিজেই বলতে লাগলেন পদসেবার সেই টানা কাহিনী- “দু’বেলা প্লাস্টিকের বড় গামলায় কটকটে গরম জলে পা স্যাঁকা। কিন্তু তাতেও পায়ের ব্যাথা মরছে কই?’ তার উপর ভাল জুতোতেও ফোস্কা ঠেকানো যাচ্ছে না। টানা হাঁটতে হাঁটতে পা গরম হয়ে যায়। তাতে ফোস্কা অনিবার্য। তার উপর বিশ্রাম মিলছে না পায়ের। ফলে প্রতিদিন সংখ্যায় বাড়ছে বড় বড় ফোস্কা।
শুধু কী তাই? আরও আছে। মন্ত্রীর মুখেই সে সব শোনা গেল, “প্রচার শুরুর আগে আমার ওজন ছিল ৮৪ কেজি। এখন তা কমে গিয়ে হয়েছে ৭৮ কেজি।”
কিন্তু এই অনুপাতে শরীরের ওজন কমলে তো সমস্যা?
“না না কোনও সমস্যা নেই।”-অভয়বাণী শোনালেন মন্ত্রীমশাই। তিনি বলেন, “গতবার তো এ ভাবেই হেঁটে ছিলাম। আমি চাইছি ওজনটা ৬৮ থেকে ৭০ কেজিতে নামিয়ে আনতে। ভোটের পরেও যাতে আর ওজন না বাড়ে, তাতে নজর দেব।”
মন্ত্রী যতই হাঁটার গুণ বিচার করুন, তাঁর প্রতিদিনের সঙ্গীরা যে কিছুটা হলেও কাহিল হয়ে পড়ছেন, প্রতিদিনের পথ চলায় তা তাঁদের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। দুপুর দেড়টা নাগাদ মন্ত্রীমশাই সাময়িক বিশ্রামের অনুমতি দিতেই যে যার ছুট লাগালেন, খাওয়ার জলের সন্ধানে। ডাকাতিয়া খালকে পিছনে ফেলে এর মাঝে ওঁরা কিন্তু পেরিয়ে এসেছেন কনকপুর, পার্বতীপুর, গজার মোড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা। এখন প্রতিটি অঞ্চল কমিটির দায়িত্বেই দুপুরে খাওয়ার আয়োজন। ভাত, শুকতো, ডাল, তরকারি, মাছ আর চাটনি সহযোগে দুপুরের ভোজনের পর গাছ তলাতেই খানিক বিশ্রাম। তবে কতটুকু সেই সুখ?
ফের যে হাঁটতে হবে। দুপুর সাড়ে তিনটের ঘরে কাটা ঘুরতেই দ্বারহাট্টার পঞ্চায়েত প্রধান লীলাবতি মাণ্ডি নড়েচড়ে উঠলেন। মন্ত্রী আসতেই আবারও বেজে উঠল মাদল। নিঝুম গ্রাম বাংলার দুপুরে ধামসায় ঘা পড়তেই আবার নড়েচড়ে উঠল গোটা গ্রামটা। অহল্যাবাঈ রোডের ধুলো উড়িয়ে মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল। মন্ত্রীর সঙ্গী স্বরূপ বলছিলেন, “হরিপালে গত পাঁচ বছরে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার রাস্তার কাজ হয়েছে। সারা রাজ্যে এই নজির প্রায় নেই।”
সারাদিনই এই সব নানা কাজের খতিয়ান দিচ্ছিলেন শাসকদলের কর্মী-সমর্থকেরা। বড় রাস্তার পাশে মিছিল যে পথে হাঁটছিল ঠিক তখনই হরিপালে শাসকদলের সমর্থনে দেওয়াল লিখন চোখে পড়ছিল কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, রাস্তাঘাট, আলো আরও নানা খতিয়ান। তার পাশেই অন্য দেওয়ালে বামপ্রার্থী যোগীয়ানন্দ মিশ্রের সমর্থনেও প্রচার চোখ টানে। সঙ্গে আরও নানা কুকথা। যা ইদানীং বিরোধী জোট আর সোস্যাল মিডিয়ার দাপটে অ্যানড্রয়েট সেটে নিয়মিত ফিরি হচ্ছে।
এখন দেখার ‘হাওয়াই চটির হাজার কোটির প্রচার’ কোনও পথে ব্যালোট বাক্সে দাগ কাটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy