এক দিকে প্রত্যাবর্তনের ডাক। অন্য দিকে পরিত্রাণ পাওয়ার লড়াই! পশ্চিমবঙ্গের ভোট-পর্বের আনুষ্ঠানিক সূচনা হচ্ছে আজ, সোমবার জঙ্গলমহল থেকে।
লাগাতার ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে বাংলার ভোট এ বার গোটা দেশের নজরে! নারদ-কাণ্ডের জেরে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সর্বত্র আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। তার রেশ চলতে চলতেই কলকাতা শহরে আস্ত একটা উড়ালপুলের ভেঙে পড়ার ঘটনা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে! আর এই দুই ঘটনা ফের সামনে এনে ফেলেছে সারদা-কাণ্ডের স্মৃতিকে। এবং প্রতিটি ঘটনাতেই শাসক দলের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে দুর্নীতির যোগের অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী— জাতীয় রাজনীতির মুখ্য চরিত্রেরাও এ যাবৎ প্রচারে এসে শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকেই হাতিয়ার করেছেন। দুর্নীতির এমন কালো ছায়ায় পশ্চিমবঙ্গে কোনও বিধানসভা ভোট সম্ভবত এই প্রথম!
পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার ১৮টি আসনে আজ ভোট দিয়েই শুরু হচ্ছে বঙ্গের নির্বাচন-পর্ব। শুকনো পরিসংখ্যান বলছে, জঙ্গলমহলের ওই ১৮টি আসনের মধ্যে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল জিতেছিল ১০টি। কংগ্রেসের দখলে গিয়েছিল দু’টি এবং বাকি ৬টি বামেদের। তবে সে বার তৃণমূল-কংগ্রেস জোট ছিল। তাই জোটের আসন ১২ই ধরতে হবে। এর পরে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ‘লি়ড’ হিসাব করলে তৃণমূল এগিয়ে গিয়েছে ১৮টির মধ্যে ১৫টি আসনেই। শুধু পুরুলিয়ার পাড়া ও বাঁকুড়ার রানিবাঁধে বামেরা এবং বাঘমুন্ডিতে কংগ্রেস এগিয়ে। আর লোকসভায় বাম-কংগ্রেসের ভোট যোগ করলে বিরোধী জোট এগিয়ে রয়েছে ৭টি আসনে।
অঙ্ক তৃণমূলকে এগিয়ে রাখলেও রাজ্য রাজনীতির সাম্প্রতিকতম সমীকরণ অবশ্য অন্য ছবি দেখাচ্ছে! তৃণমূলের মোকাবিলায় এ বার আসন সমঝোতা করে লড়াইয়ে নেমেছে বাম ও কংগ্রেস। প্রথম পর্বের ১৮টি আসনে এই সমঝোতা আরও মসৃণ। গত লোকসভা ভোটের সময় থেকেই এ রাজ্যে তৃণমূল এবং বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট সমান সমান।
বিধানসভা ভোটের আগে যতগুলি জনমত সমীক্ষা হয়েছে, প্রত্যেকটির ইঙ্গিত একই। শাসক এবং বিরোধী জোটের ভোট সব সমীক্ষাতেই তুল্যমূল্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতই দাবি করুন জঙ্গলমহল হাসছে, জোটের রসায়নেই তৃণমূলের সামনে রাস্তা একেবারে সহজ নয়! এবং নিজে তা বিলক্ষণ বুঝেছেন বলেই এ বার জঙ্গলমহলে প্রায় ঘাঁটি গেড়ে পড়ে থেকে দফায় দফায় প্রচার চালিয়েছেন মমতা।
তবে জোট থাকলেও বিরোধীদের সামনে প্রধান উদ্বেগ অবশ্য সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মধ্যবঙ্গের শ’খানেক আসন বরাবরই ‘রিগিং-প্রবণ’। তার কেন্দ্রে অনুব্রত মণ্ডল, মনিরুল ইসলামদের বীরভূম। সেই সঙ্গেই বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশে এই গা-জোয়ারির ভোটের বৃত্ত ছড়িয়ে আছে। দু’বছর আগের লোকসভা ভোটেও যার প্রমাণ মিলেছিল বেশ কিছু এলাকায়। সেই ইতিহাস মাথায় রেখেই এ বার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের উপরে আগাম চাপ সৃষ্টি করেছে বিরোধীরা। প্রথম পর্বের ভোটের আগে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের আহ্বান, ‘‘মানুষ এ বার জোট বেঁধেছেন। জোট বেঁধে প্রতিটা বুথকে নিশ্ছিদ্র দুর্গ করে তুলতে হবে মানুষকেই। যাতে তৃণমূল আবার ভোট লুঠ করতে না পারে।’’ কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যও রবিবার বলেছেন, ‘‘জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে তৃণমূলের সামনে এখন ভয় দেখানো ছাড়া উপায় নেই। তারা প্রকারান্তরে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে! ভোটে বাধা পেলে মানুষকে জোট বেঁধে তা প্রতিহত করতে হবে।’’
ভোটের ২৪ ঘণ্টা আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, নাট্যকার চন্দন সেন, লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, অশোক মিত্র, মীরা পাণ্ডে, মৃণাল সেন প্রমুখ বিশিষ্টদের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য প্রশাসন উভয়ের। তাই উভয়ের কাছে আবেদন করছি, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে যথাযথ ব্যবহার করে এমন পরিবেশ তৈরি করা হোক, যাতে নাগরিকরা অবাধে ও নির্ভয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে’। এ বার জঙ্গলমহলে মাওবাদী আতঙ্কের সরাসরি ছায়া না থাকলেও আজ প্রথম দফার ভোটেই কমিশনের অগ্নিপরীক্ষা শুরু হচ্ছে বলে অশোকবাবুরা মনে করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy