Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

সবাই বোঝে, শুধু তিনি বোঝেন না শেষের সময় এসেছে

যে কোনও মেগালোম্যানিয়াকেরই শেষটা একরকম হয়। তিনি ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে আসেন। কিন্তু তিনি যেহেতু মেগালোম্যানিয়াক তাই তিনি বোঝেন না যে শেষ সময় এসে গিয়েছে, অথচ সবাই তা দেখতে পাচ্ছে। যাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি পাহাড়কে হাসাচ্ছিলেন, সেই গোর্খা জনমুক্তি পরিষদ তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছে বামেদের সঙ্গে।

সিউড়ির জুনিদপুরে বামেদের ভোট প্রচারের মিছিল। নিজস্ব চিত্র।

সিউড়ির জুনিদপুরে বামেদের ভোট প্রচারের মিছিল। নিজস্ব চিত্র।

মানব মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৬ ১৩:৫৩
Share: Save:

যে কোনও মেগালোম্যানিয়াকেরই শেষটা একরকম হয়। তিনি ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে আসেন। কিন্তু তিনি যেহেতু মেগালোম্যানিয়াক তাই তিনি বোঝেন না যে শেষ সময় এসে গিয়েছে, অথচ সবাই তা দেখতে পাচ্ছে। যাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি পাহাড়কে হাসাচ্ছিলেন, সেই গোর্খা জনমুক্তি পরিষদ তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছে বামেদের সঙ্গে। পাঁচ বছর আগে জঙ্গলমহলের সঙ্গী ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চাও তাই। ২০১১-র তাঁর প্রধান জোটসঙ্গী কংগ্রেস বহু দিন তাঁর মন্ত্রিসভা এবং জোট ছেড়ে চলে এসেছে। সঙ্গে নেই এসইউসিআই। নেত্রী এবং তাঁর দল এখন একা। রইল একা বিজেপি। ম্যাথু স্যামুয়েলের স্টিং অপারেশনের পর হয় বিজেপির হাত, না হয় বিজেপির পা ধরতে হবে এখন তাঁকে।

এই বিচ্ছিন্নতা ওনার পাওনা ছিল। বাংলায় যাকে বলে ‘ধরাকে সরা জ্ঞান করা’ তাই করেছেন। সিঙ্গুরে টাটাদের মোটরগাড়ির কারখানা আর নন্দীগ্রামের কেমিক্যাল হাব রাজ্য থেকে তাড়িয়ে তিনি রাজত্ব বসালেন এবং রাজত্বে বসে প্রথমেই ইনফোসিস-কে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন। সিমেন্স কলকাতা থেকে তাদের পাততাড়ি গোটাচ্ছে এটা জেনেও তিনি তা ঠেকানোর চেষ্টা করলেন না। একই অবস্থা ভিডিওকনের জলপাইগুড়ি প্রকল্পের। শালবনিতে জিন্দালদের ৩৫,০০০ কোটি টাকার ইস্পাত প্রকল্পের শিলান্যাস হয়েছিল বামফ্রন্ট আমলে, এখন তা বাতিল করা হয়েছে। আর মুখ্যমন্ত্রী সেখানে গিয়ে ৫০০ কোটি টাকার সিমেন্ট কারখানার শিলান্যাস করে এসেছেন। চেম্বার অব কমার্সগুলি বার বার দাবি করেছেন শিল্পের জন্য জমির নির্দিষ্ট নীতি চাই— মুখ্যমন্ত্রী নিরুত্তর। সবাই জানেন, অসংখ্য মাঝারি এবং ছোট শিল্প ঝাঁপ বন্ধ করে দিচ্ছে স্রেফ স্থানীয় তৃণমূলীদের তোলাবাজির ভয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর কিছু করার নেই, কারণ তোলাবাজি বন্ধ হলে তার দল উঠে যাবে।

আমাদের মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন সেই দুর্ভাগা মুখ্যমন্ত্রী যিনি গত পাঁচ বছরে একটিও নতুন কারখানার শিলান্যাস করতে পারেননি। কত দূর অসহায় হলে এক জন মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারেন, ‘তেলেভাজাটাও শিল্প’। এ রাজ্যে কোনও কাজ নেই। মধ্যবিত্ত পাড়াগুলি ধীরে ধীরে ‘বৃদ্ধাবাস’ হয়ে যাচ্ছে, ছেলেমেয়েরা বাইরে। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে কাজের খোঁজে পালাচ্ছে বাংলার ছেলেরা। সবচেয়ে বেশি মেয়ে পাচার হয় এ রাজ্য থেকে।

আসলে একটা সমস্যাকে সমস্যা হিসাবে না মানলে তার সমাধান হওয়ার কোনও সম্ভাবনা থাকে না। গোটা দেশে হলেও আমাদের রাজ্যে কৃষকের আত্মহত্যা ছিল অজানা বিষয়। কিন্তু এখন এটা নিয়মিত ঘটনা। কৃষক ফসলের দাম পায় না। আর সরকারের বিবৃতি, ‘এরা পারিবারিক অশান্তির জন্য আত্মহত্যা করছে।’ কে সমস্যার সমাধান করবে? বন্ধ চা বাগানের প্রায় ৪০০ শ্রমিক না খেতে পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। মুখ্যমন্ত্রী উৎসব করে টাকা ওড়াচ্ছেন। ক্ষমতা মানুষকে এতটা হৃদয়হীন করে? বামফ্রন্টের আমলে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের সরকাক ভাতা দিত। কী অসুবিধা সেটা আবার চালু করতে?

পশ্চিমবাংলার যে দিকে তাকাবেন সে দিকেই অন্ধকার। সর্বনাশ হয়ে গেছে শিক্ষার জগতে। শিক্ষার জগত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আরাবুল-অনুব্রতরা। টাকা ছাড়া অ্যাডমিশন হয় না, টাকা দিলে ফেল করা ছাত্র ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে যায়। শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় পাশ করতে হলে তৃণমূলীদের টাকা দিতে হয়— খোদ শিক্ষামন্ত্রী তা স্বীকার করছেন। এই চিত্র শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যন্ত। আগে রাজা-বাদশারা খুশি হয়ে অনুগতদের জমিদারি উপহার দিতেন, শিক্ষামন্ত্রীকে পিএইচডি করানোয় উপাচার্যের পদ উপহার পেয়েছেন, এ কেবল তৃণমূলী রাজত্বেই সম্ভব। যাঁরা রাজ্যের ‘মধ্য মেধা’ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতেন তাঁরা এসে দেখে যান ‘নিম্ন মেধা’ কাকে বলে। নিজের ছাত্রদের মারতে উপাচার্য ইন-চার্জকে টিভি ক্যামেরার সামনেই বেধড়ক মারল তৃণমূলের মধ্যবয়সী জেলা সভাপতি। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘‘বাচ্চা ছেলেরা করে ফেলেছে।’’

পুলিশের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ একদল যুবককে ভবানীপুর থানা গ্রেফতার করে। কিছুক্ষণ পর মুখ্যমন্ত্রী নিজে গিয়ে তাদের লকআপ খুলে নিয়ে চলে আসেন। যে পুলিশ অফিসার গ্রেফতারর করেছিলেন পরের দিনই তাঁকে ট্রান্সফার করে দেন। এই ঘটনার পর থেকেই এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, রাজ্যে দু’ধরনের আইন। একটি আইন তৃণমূলীদের জন্য আর একটি আইন বাকিদের জন্য। এর পর আর রাজ্যে আইনের কাঠামো বলে কিছু থাকে না। যারা তৃণমূল করে তারা সবাই সমাজবিরোধী তা নয়, কিন্তু কারও শাস্তি হয়নি। মেয়েদের ওপর চরম অপরাধের সংখ্যায় দেশের মধ্যে সবার শেষে। পার্ক স্ট্রিটে সুজেট জর্ডানের ওপর এই ভয়ঙ্কর আক্রমণ হলে মুখ্যমন্ত্রী অবলীলায় বলেন, ‘গোটাটা সাজানো ঘটনা।’ এটা অপরাধীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা ছাড়া আর কী? এবং হয়েছেও তাই, তৃণমূলী নেতাদের সাহায্যে অপরাধী পালিয়ে যেতে পেরেছে। আজও সে গ্রেফতার হয়নি। ধর্ষণে অপরাধী হিসাবে আদালতে সাব্যস্ত হলেও সরকারি উকিল সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি না করে সর্বনিম্ন শাস্তি দাবি করেন। এদের জন্য কামদুনি কাণ্ডে অভিযুক্তরা কয়েক জন বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। এক জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অন্তত এই বিষয়ে ন্যূনতম সংবেদনশীলতাও আশা করা যাবে না? কাটোয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের পর তিনি কী করে এ কথা বলেন, ‘ওর স্বামী সিপিএম করে’, অর্থাৎ সিপিআই(এম) কর্মীর স্ত্রী ধর্ষিত হলে সেটি অপরাধ নয়।

এই বিপুল সমাজবিরোধী বাহিনী তৃণমূলের প্রয়োজন। মানুষের মুখ বন্ধ করতে, ভোট লুঠ করতে এরাই তাদের প্রধান হাতিয়ার। আর নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকলেই সিন্ডিকেট রাজ, তোলাবাজি-সহ হাজার ধরনের সমাজবিরোধী সুলভ রাস্তায় আয়ের গ্যারান্টি হয় এদের। এর জন্য তৃণমূল এবং সমাজবিরোধীরা ‘মেড ফর ইচ আদার’।

তবে এই গোটা বিষয়ে পুলিশের একাংশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারদ ডট কম-এর স্টিং অপারেশনে যে পুলিশ অফিসারটিকে দেখা যাচ্ছে, সে কি কখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করতে পারে? অন্যায় ঠেকানো দূরে থাক, যে নিজে অন্যায়ের সংগঠক। সে লুঠের ভাগ পায়। তৃণমূল-সমাজবিরোধী-পুলিশের একাংশ এই নিয়ে একটা বিষাক্ত ত্রিভুজ গোটা রাজ্যের ওপর চেপে বসেছে।

এক সময় এটা আমাদের অহঙ্কার ছিল, অন্য রাজ্যের তুলনায় আমাদের রাজ্যের রাজনীতিকরা অনেক সৎ। কোনও বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগ বামফ্রন্টের নেতাদের সম্পর্কে তোলা যায়নি। এমনকী, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেও তৃণমূল কোনও অভিযোগ আনতে পারেনি। আর এখন? দুর্নীতির নাম এবং দুর্নীতিতে লুঠ হওয়া টাকার পরিমাণের উল্লেখ অর্থহীন হয়ে গেছে। চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে সর্বস্ব হারিয়েছেন প্রায় এক কোটি মানুষ। দেশের ইতিহাসে এটাই সর্ববৃহৎ দুর্নীতিতে আলাদা করা যাচ্ছে না। আজ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী জানালেন না, তাঁর আঁকা ছবি কোটি কোটি টাকায় কারা কিনেছিল? কালিম্পংয়ের ডেলো বাংলোয় চিটফান্ডের দুই মালিকের সঙ্গে মধ্যরাতে তাঁর কী কথা হয়েছিল?

মেগেলোম্যানিয়াকরা শুধু নিজেদের ক্ষমতার লোভে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে বিজেপির হাত ধরিয়েছিল। এখনও সেই বোঝাপড়া বর্তমান। জেএনইউ-এর ছাত্রদের ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে গোটা দেশ মুখ খুলছে, একমাত্র চুপ তৃণমূল। আর বিনিময়ে নারদ ডট কমের স্টিং অপারেশন দেখে গোটা দেশ মুখ কুলুপ বিজেপির। এই বোঝাপড়ার সুযোগে আরএসএস তার প্রভাব বাড়াচ্ছে বাংলায়। এর ফল ভাল হবে না। আর তার উল্টো দিকে মুসলমান ভোট পেতে তৃণমূল হাত মিলিয়েছে মৌলবাদীদের সঙ্গে। তার বিনিময়ে খাগড়াগড়ে তৃণমূলের অফিসের নীচে বাংলাদেশি মৌলবাদীদের বোমা তৈরির কারখানা বানিয়েছে। তৃণমূল নেতা গার্ডেনরিচের যুদ্ধজাহাজ তৈরির কারখানায় পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে। রাজ্যে বিপজ্জনক ভাবে সক্রিয় মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িকরা। হিটলার শেষ হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু জার্মানিকে ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের জন্য কি সেই ভবিতব্য অপেক্ষা করছে? না, যথেষ্ট দেরি হয়ে যাবার আগে এটা ঠেকাতে হবে। আর এর জন্যই তৃণমূল নেত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে বাংলা থেকে বিদায় নিতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 manab mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE