—প্রতীকী ছবি।
হাওয়া বইছে জোরে। শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ঘরের চাল মজবুত করছিলেন এক বৃদ্ধ।
ঝড় হলে ঘরের চাল টিকবে? প্রশ্ন শুনে রীতিমত খেঁকিয়ে বৃদ্ধ বলেন, “ভোট এলেই আমাদের কথা মনে পড়ে?”
সরকার তো পাশে থাকে বলছে, সাহায্য করে। সরকারের বাড়ি বানানোর প্রকল্প আছে। পরিচয় পেয়ে কিছুটা শান্ত স্বরে বললেন, “আমাদের কথা কে ভাবে? ত্রাণ চাই না, কংক্রিটের বাঁধ হলে বাঁচা যায়।”
ভোট দিতে যাবেন তো? “ভোট দিতে পারলে যাব। জবাব দেওয়ার আছে।”
পাথরপ্রতিমা বিধানসভা এলাকায় ওই বৃদ্ধ কাকে, কী জবাব দেবেন, সে সম্পর্কে সদুত্তর না মিললেও নির্বাচনের প্রাক্কালে মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভোট উত্তাপের আভাস মিলল। আর শুধু ভাঙন নয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, পানীয়, কর্মসংস্থান নিয়েও সেই একই অভিযোগ। উন্নতি হলেও পর্যাপ্ত নয় বলেই অভিযোগ।
যদিও এ বারের নির্বাচনে এ সব ছাপিয়ে সাংগঠনিক শক্তি, দুর্নীতি নিয়ে ওঠা অভিযোগ এবং মেরুকরণের ঝোঁক ভোট দুর্গে নিশ্বাস ফেলারও ইঙ্গিত মিলেছে।
মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রে লাগাতার জয়ের ব্যবধান বাড়িয়েছে শাসক দল। বিধানসভা, পঞ্চায়েতেও দখল তাঁদেরই। পক্ষান্তরে বাম ভোটে ভাঙন অব্যাহত। সেখানে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি প্রায় ৩২ শতাংশ। তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান ২ লাখ ছাড়িয়েছে। পাথরপ্রতিমা, রায়দীঘি, মন্দিরবাজার, মগরাহাট (পশ্চিম), কুলপি, কাকদ্বীপ, নামখানা এবং সাগর বিধানসভা নিয়ে গঠিত মথুরাপুর লোকসভার ভোটার প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ। যাদের অধিকাংশ সংখ্যালঘু এবং তফসিলি জাতি, জনজাতি। এই লোকসভার অধিকাংশ আবার গ্রামীণ ভোটার।
শহর এলাকার বাসিন্দাদের কারও মতে, মেরুকরণের ঝোঁক আগেও ছিল, এ বারে বেড়েছে। কারও মতে, বিজেপি-তৃণমূল উভয়েই শাসক। সাধারণের লাভ কি হল? এই ভোট সমীকরণে আবার আইএসএফ এবং এসইউসিআই-এর ভোট কাটাকুটির সম্ভাব্য অঙ্কও শোনা যাচ্ছে। যদিও টোটোচালক নিমাই বেরার কথায়, “হাওয়াতে লাভ হবে কি না, সন্দেহ।”
সমস্যার সমীকরণে অবশ্য বদল ঘটেনি। ঘোড়ামারা, মৌসুনি দ্বীপ, পাথরপ্রতিমা-সহ একাধিক এলাকায় নদীবাঁধ সমস্যা মেটেনি। ২০০৯-এর আয়লায় বিপর্যস্ত হয়েছিল পাথরপ্রতিমা। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে টাকা মঞ্জুর হলেও সময়ে কাজ না হওয়ায় বেশিরভাগ টাকা ফেরত যাওয়ার অভিযোগ প্রচারে তুলে ধরছেন বিরোধীরা। এর পরে আমপান, ইয়াশের ধাক্কা আজও পুরোপুরি সামলে ওঠেনি মথুরাপুর। আগামীতে ফের ভাঙনের আশঙ্কা অনেকেরই।
বাম প্রার্থী, পেশায় চিকিৎসক শরৎচন্দ্র হালদারের অভিযোগ, পরিকল্পনা গঠন ও প্রয়োগে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যর্থ। আইএসএফের প্রার্থী, কলেজ শিক্ষক অজয়কুমার দাস জানান, বাম, কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল প্রতিশ্রুতি দিলেও সমস্যা মেটাতে পারেনি। শাসকদলের পাল্টা দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা সত্ত্বেও লাগাতার নদী বাঁধের মেরামত করা হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, কর্মসংস্থান এ বারেও বড় বিষয়। বামেদের অভিযোগ, বাম আমলে ৩৮টি সেতু তৈরি হয়েছিল। আরও পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের আমলে নতুন করে রেল বা সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। রায়দিঘি-জয়নগর রেলপথের শিলান্যাস হলেও কাজ হয়নি। একই ভাবে নামখানা-ফ্রেজারগঞ্জ রেলপথ হয়নি। প্রচারে মুড়িগঙ্গার উপরে সেতু তৈরির দাবিও জানাচ্ছেন সকলে। তার জেরে আটকে পড়ছে উন্নয়ন। তৃণমূলের পাল্টা দাবি, যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। সাড়ে তিন কিলোমিটারের নামখানা ঝুলন্ত সেতু তার উদাহরণ। বকখালি-সহ একাধিক এলাকায় রাস্তা, পরিবহণের উন্নতি হয়েছে। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই মুড়িগঙ্গার উপর সেতু তৈরির প্রকল্প নিয়েছে।
বাসিন্দাদের মূল জীবিকা চাষ এবং মাছের ব্যবসা। কিষাণ মান্ডি হলেও পর্যাপ্ত সংখ্যক হিমঘরের অভাবে সমস্যায় পড়েন চাষিরা। সাদেক, সুস্মিতা, আকাশ, সাবিনার মতো যুবক-যুবতীদের কথায়, “কল-কারখানা নেই। যেটুকু বা কাজ আছে, তাতেও তুলনায় আয় কম। তাঁরাও বাইরে চলে যাবেন।” যদিও পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে বলেই দাবি শাসকদলের।
তৃণমূল যেমন প্রচারে লক্ষ্মীর ভান্ডার-সহ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের কথা তুলে ধরছেন। তেমনই বিরোধীরা অনুন্নয়নের অভিযোগ সামনে আনছেন। দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরির দাবি তুলছেন বামেরা। বিজেপি বলছে, মথুরাপুর নিয়ে বিশেষ সার্বিক পরিকল্পনা তৈরি করে কার্যকর করবেন তাঁরা।
দুর্নীতির অভিযোগ বিরোধীদের প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার। তৃণমূল প্রার্থী এবং তাঁর স্ত্রী তথা প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান শিলি হালদারের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে সেই তালিকায়। বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। আবাস যোজনা থেকে একশো দিনের কাজ নিয়ে বিরোধীদের তোলা দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে তৃণমূল প্রার্থী বাপি দেবনাথ বলেন, “লাগাতার কুৎসা প্রচার করছেন বিরোধীরা। মানুষ বামেদের অতীত ভোলেনি, আবার বিজেপিকে দেখছে। মানুষ তৃণমূলকেই সর্বদা পাশে পেয়েছে। এটা লোকসভার ভোট। জবাব দেওয়ার দায় বিজেপির। কেন রাজ্য সরকারকে বঞ্চনা করে কোটি কোটি টাকা আটকে রাখা হয়েছে? আগে তার জবাব দিক ওরা।”
বিজেপি প্রার্থী অশোক পুরকাইত বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার বঞ্চনা করে থাকলে, শাসকদল আইনের দ্বারস্থ হচ্ছে না কেন?”
এ সবের পাশাপাশি নির্বাচনে শাসকের পেশিশক্তিকেও আলাদা ভাবে উল্লেখ করছেন বিরোধীরা। যদিও শাসকদলের কথায়, বিরোধীদের সাংগঠনিক শক্তি কম। গোষ্ঠী কোন্দলও রয়েছে। যা মানতে নারাজ বিজেপি প্রার্থী। তাঁর দাবি, ঐক্যবদ্ধভাবেই লড়াই করে পাঁচ বছরে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি হয়েছে।
বর্ষীয়ান বাম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় আবার জানাচ্ছেন, লড়াইয়ের মাঠেই রয়েছেন তাঁরা। সাধ্যমতো প্রচার চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, “মানুষের সমর্থন বাড়ছে, ভোট অনেকাংশই বাড়বে। তবে মেরুকরণের ঝোঁক রয়েছে। সেটা একটা ফ্যাক্টর।”
তা হলে কি মথুরাপুরে এ বারে পালাবদল? নাকি ২০১৯ সালেরই পুনরাবৃত্তি? এই সব প্রশ্নের মধ্যেই বাসিন্দারা চাইছেন, পেটের ভাত আর মাথায় ছাদ। মুড়িগঙ্গার পাশে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ দূরে দেখিয়ে বললেন, “নতুন চর দেখতে পাচ্ছেন? নতুন কিছুর আশা করা ছাড়া উপায় কী!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy