E-Paper

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির টক্কর, অপেক্ষা বিধানসভার

৩৭০ ধারা এবং রাজ্যের মর্যাদা প্রত্যাহারের পর কেটে গিয়েছে প্রায় পাঁচ বছর। লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে কেমন আছে কাশ্মীর?

কাশ্মীরের ডাল লেকে ব্যস্ত শিকারা। শুক্রবার।

কাশ্মীরের ডাল লেকে ব্যস্ত শিকারা। শুক্রবার। ছবি: পিটিআই।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৪ ০৫:০৯
Share
Save

পূর্ব ইউরোপের কোনও ফ্রেমের মতো এই বসন্ত সমাগমের পোলো ভিউ বাজার। লাল চক থেকে বড়জোর দেড় কিলোমিটার দূরের এই বাজার নাকি কাশ্মীরের বৃহত্তম খুচরো বিকিকিনি কেন্দ্র। আপাতত বসন্তের ছিটেফোঁটা নেই, বরং চিনার, জুনিপার, সাইপ্রাস, উইলো আকাশের দিকে উঁচিয়ে রয়েছে পত্রবিরহিত, ন্যাড়া। কনকনে হাওয়ার মধ্যে ধীরে চলছে জীবন, স্মার্ট সিটি-র প্রসাদধন্য বাঁধানো চত্বরে। দু’জন সশস্ত্র জলপাই পোশাক, নতুন তৈরি নয়নশোভন বেঞ্চে বসে ঢুলছেন। আরও কিছু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

শান্তির পক্ষে খুবই আদর্শ এই ছবি। বাণিজ্যের পক্ষে ততটা নয়। গোটা বাজারটিই এই ভরদুপুরে ধু-ধু করছে যেন। ফিরন, পশমিনা, আখরোট কাঠের গহনা বাক্স, কাগজের মণ্ড থেকে বাহারি বিবিধ পণ্য, চামড়ার জুতো, মনোহর সুগন্ধের তেল, শুকনো ফলের দোকান এই চত্বরের দু’ধারে মাছি মারছে। অবরে সবরে এক-আধ জন খদ্দের এসে তাক থেকে পণ্য নামিয়ে দেখছেন।

গোটা দেশ থেকে (এবং বিদেশ থেকেও) পর্যটকরা আসছেন বিলক্ষণ। অন্তত বুরহান ওয়ানির হত্যা পরবর্তী সময়ের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেড়েছে তাঁদের আসা। কিন্তু শ্রীনগরের বাজারে নষ্ট করার সময় তাঁদের নেই। “লোকজন চলে যাচ্ছেন গুলমার্গ, সোনমার্গে বরফ দেখতে আর সেখানেই যা কেনাকাটা”, জানালেন ফাজিন সিদ্দিকি। ৭৪ বছরের প্রাচীন ‘এম সিদ্দিকি অ্যান্ড সন্স’-এর নবীন উত্তরাধিকারী ফাজিন, যাঁদের দু’টি বড় দোকান রয়েছে এই পোলো ভিউ-য়ে। তাঁর কথায় যা স্পষ্ট, শুধুই পর্যটন নির্ভর তাঁদের বাণিজ্য। স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন ক্রয়ক্ষমতার উপরে ভরসা তাঁদের নেই। ক্রমশ সেই ক্ষমতা কমছে বলেই দোকানদারদের অভিজ্ঞতা। রুটি আর ডাল জোগাড়েই যাঁদের দিন যায়, তাঁদের কাছে ঘর সাজানো বিলাসই।

সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পর, এই প্রথম কাশ্মীরে লোকসভা ভোট। এসে মালুম, আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে উপত্যকার মানুষের মন। প্রশাসন, পুলিশ, ডাল লেকের সামনে পাঁচতারা পান্থনিবাসের মালিকপক্ষ, বিজেপি নেতা, শীর্ষস্থানীয় আমলারা এক দিকে। যাঁদের সম্মিলিত মত, উপত্যকা বদলে গিয়েছে ৩৭০-এর পরে। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস, হিংসা আর নেই। কেন্দ্র সব টাকাই সাধারণ মানুষের উন্নয়নে কাজে লাগাচ্ছে। আর সন্দেহ অমূলক, গত পাঁচ বছরে কোনও বাইরের লোক এসে উপত্যকার জমির দখল নেননি।

শিকারা চালক, হাউস বোটের মালিক, শহরের ছোট ছোট বিপণি, বাজারের দোকানদার মালিক, অটো ও ট্যাক্সি চালক এবং স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা অন্য দিকে। যাঁরা মনে করেন, ৩৭০ ধারা অকেজো করে স্থানীয় যুবার কাজের সুযোগ, জমির দাবিকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র নিজের শাসন বহাল রাখতে চায় অনন্তকাল, তাই এখানে বিধানসভার ভোটের প্রশ্নে নিরাপত্তার অজুহাত দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ এনে তাঁরা বলছেন, এক দিকে নরেন্দ্র মোদী-জয়শঙ্কর গোটা বিশ্বে কাশ্মীরে শান্তি ফেরানোর দাবিতে পতাকা ওড়াচ্ছেন। আর ঘরের ভোটের প্রসঙ্গ এলেই বলছেন, একসঙ্গে দু’টো ভোট করার মতো নিরাপত্তাকর্মী দেওয়া যাবে না!

সব মিলিয়ে যেন দু’টি বিপরীত মেরু তৈরি হয়েছে ভূস্বর্গে। ১০ বছর জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা ভোট ঝুলে থাকা এবং এ বারেও লোকসভার সঙ্গে ভোট না-হওয়া নিয়েও মতামত এই দুই পরস্পর বিরোধী মেরুতেই। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের অন্যতম শীর্ষ কর্তা আব্দুল কায়ুম তাঁর দফতরে বসে বলছেন, ‘‘২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর যে সামগ্রিক শান্তি প্রক্রিয়া চলছে, কাশ্মীরের বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিক তার শরিক হতে চাইছেন। এল জি শাসনের ফলে যে শান্তির বাতাবরণ, তাতে পুলিশ, বিচারবিভাগ, স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষাক্ষেত্রের কর্মী প্রত্যেকেই মনে করছেন, তাতে তাঁদের অংশ রয়েছে। কোনও মূল্যেই তা ভেস্তে দিতে চান না মানুষ।’’ তাঁর কথায়, ‘‘শান্তি ফেরানোর প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ বলতে পারেন একে। ৩৭০ প্রত্যাহারের পর বিভিন্ন যোজনায় কেন্দ্রীয় অর্থ অনেক বেশি করে এখানে তৃণমূল স্তরে পৌঁছচ্ছে দক্ষ ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য। বিজলি সড়ক পানির ক্ষেত্রে টাকা কতটা কী ভাবে খরচ হচ্ছে তার হিসাব থাকছে। হয়তো কিছু দুর্নীতি এখনও রয়েছে, কিন্তু আগের মতো নয়। আপনি রাজবাগে গিয়ে রিভার ফ্রন্ট দেখুন, কত রাত পর্যন্ত মানুষ সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আলো ঝলমলে পরিবেশে নৌকায় চড়ছেন। কিন্তু এত দিন যারা বঞ্চনা করে গিয়েছেন সেই রাজনৈতিক নেতারা ফের জিতে এলে আবার দুর্নীতির পারদ চড়বে। আর পুলিশও নিশ্চিন্ত এখন। আমাদের তো নিজেদের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করার কাজ নয়, কিন্তু পাথর ছোড়ার সেই দিনগুলিতে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’’

কাশ্মীরের পুলিশ-প্রশাসন সূত্রের দাবি, আপাতত এখানে বিধানসভা গঠনের কোনও তাড়াহুড়ো কেন্দ্রের নেই। তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্রের জন্য পঞ্চায়েত ভোট করানো হবে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে যে শান্তির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, তা আবার স্থানীয় এন সি বা পিডিপি সরকার গঠিত হলে নষ্ট হয়ে যাবে। কারণহিসাবে অবশ্য প্রকাশ্যে নিরাপত্তা পরিস্থিতির কথাই বলছে নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় প্রশাসন। জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রে দশটি করে বিধানসভা কেন্দ্র। প্রশাসনের হিসাব, দু’টি একসঙ্গে করতে হলে চারশো কোম্পানি সিআরপিএফ-এর প্রয়োজন। গোটা দেশে লোকসভা ভোট চললে তা দেওয়া অসম্ভব বলেই দাবি পুলিশ প্রশাসনের। তা ছাড়া, জুন মাসে লোকসভা শেষ হওয়ার পরই শুরু হবে অমরনাথ যাত্রা, যা চলবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তার পরই এসে যাবে শীতকাল। সুপ্রিম কোর্ট সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাশ্মীরে ভোট করার কথা বলেছে ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতির বদলে সেই নির্দেশেরও বদল ঘটতে পারে বলেই মনে করছে প্রশাসন।

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 Kashmir Jammu and Kashmir Jammu

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।