গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের বহমান স্রোত দেখেছে দমদম। দেখেছে চটকলের গেটে লাল নিশানও। কিন্তু ক্ষয়রোগে সেই লালের উড়ানের রানওয়েটাই আর নেই। প্রায় ১৮ কিলোমিটার লম্বা বি টি রোড (ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড) ব্যারাকপুর থেকে কলকাতা যাতায়াতের প্রধান পথ। সাহিত্যিক সমরেশ বসু তাঁর ‘বি টি রোডের ধারে’ উপন্যাস লিখেছিলেন গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। তাতে বর্ণনা ছিল, ‘এই সুদীর্ঘ রাস্তাজুড়ে ভিড় লেগেছে, কারখানার ছুটির ভিড়। সারা বাংলার বৃহত্তম শিল্পকেন্দ্র এই রাস্তা। গঙ্গার তীরে তীরে, রেললাইনের ধারে ধারে অসংখ্য কারখানার ইমারত...।’ কিন্তু কিছুই নেই আর। প্রিয়া বিস্কুট, খড়দহের এস্যাব, কামারহাটির উইমকো কিছুই নেই। এবড়েখেবড়ো, বাঁকাচোরা, দোমড়ানো শিল্পতালুকে রয়েছে শুধু ঝোপ, জঙ্গল আর অতীত গৌরব। তবে সেই গৌরবও চাপা পড়ে গিয়েছে ঝাঁ-চকচকে শপিং মল আর বহুতলে।
অভিনেতা শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’-এর মতোই আজকের দমদম। যেখানে লেখক লিখেছিলেন, ‘বরানগরের কাছে বি টি রোডের ধারে একটা লালচে রঙের দোতলা বাড়ির প্রায়ান্ধকার ঘরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন এক প্রৌঢ়।’ এক কালে দমদমে দাপট দেখানো বামেরাও ঠিক একই রকম নিঃসঙ্গ। সঙ্গী কংগ্রেসের শেষ বারের প্রাপ্ত ভোট আড়াই শতাংশ। সঙ্গে নিজেদের প্রায় ১৪ মিলিয়ে কতটুকুই বা পুঁজি! তা নিয়েই লড়াইয়ে সিপিএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী।
অতীতে যাদবপুর থেকে বিধানসভা ও লোকসভায় জিতেছেন পক্বকেশ সুজন। কিন্তু এমন এক দুর্বল অঙ্ক নিয়ে লড়াইয়ে প্রথম বার। মূল লড়াইয়ে অবশ্য দুই ফুল। তৃণমূলের প্রার্থী বিভিন্ন আসন থেকে অতীতে বিধায়ক হওয়া এবং দমদম থেকেই টানা তিন বারের সাংসদ প্রবীণ সৌগত রায়। যিনি চরণ সিংহ মন্ত্রিসভার পরে আবার মনমোহন সিংহ মন্ত্রিসভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকেছেন। পদ্মের প্রার্থী তৃণমূলেরই প্রাক্তন বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত। দু’বার ব্যারাকপুর বিধানসভায় জয়ী শীলভদ্র নীলবাড়ির লড়াইয়ে পদ্মের টিকিটে খড়দহ বিধানসভায় পরাজিত হন। ওই আসনের বিধায়ক কাজল সিংহের মৃত্যুতে উপনির্বাচন হলে তিনি আর প্রার্থী হননি। এ বারই প্রথম তিনি লোকসভা নির্বাচনে।
অতীতে কয়েক বার কংগ্রেস জিতলেও ১৯৮৯ সাল থেকে এই আসন টানা ছিল সিপিএমের হাতে। নির্মলকান্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাম সাংসদ। এর পরে তৃণমূল-বিজেপি জোট হলে এই আসন থেকে পর পর দু’বার জেতেন অধুনাপ্রয়াত তপন সিকদার। বাজপেয়ী সরকারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি। বাম জমানায় দমদমে যে ভাবে পদ্মফুল ফুটেছিল, তা দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল আলিমুদ্দিন ষ্ট্রিটের ভোট ম্যানেজারদের। ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে পদ্ম প্রতীকে তপনকে জিততে সঙ্গত করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপির সঙ্গে জোটে দমদম তাদের ছেড়ে দেন মমতা। কিন্তু রাজনীতির কারবারিরা তপনের জয়ের পিছনে অন্য ‘গন্ধ’ পেয়েছিলেন। বিপরীতমুখী রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী তপনকে দু’বার সংসদে যেতে নাকি সাহায্য করেছিলেন সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তী। সিপিএমের অন্দরে গোষ্ঠীলড়াইয়ে সুভাষ হারিয়ে দিতে চেয়েছিলেন অমিতাভ নন্দীকে। পেরেওছিলেন। পর পর দু’বার। যদিও এমন অভিযোগের কোনও প্রমাণ দিতে পারেননি কেউ। সুভাষকেও দলের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু বলা হয়নি। স্বাভাবিক। তেমন হলে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরের ‘শৃঙ্খলা’ প্রশ্নের মুখে পড়ে যেত।
২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নজরুল মঞ্চে সিপিএমের এক সভায় সুভাষের উদ্দেশে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, “আমি মৃত্যুর আগে দমদম পুনরুদ্ধার দেখতে চাই।” শিষ্য সুভাষ ‘আশাহত’ করেননি ‘গুরু’ জ্যোতিকে। দলীয় রাজনীতিতে বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা হলেও সে বার অমিতাভকে জেতাতে ময়দানে নেমেছিলেন সুভাষ। ইতিহাস বলছে, সেই নির্বাচনে বিজেপির তপনকে হারিয়ে জিতেছিলেন সিপিএমের অমিতাভ।
২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই আসনে বিজেপি প্রার্থীরা বার বার হারলেও দমদমের উপর নজর রয়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপির। কারণ, এই আসনে অতীতে দল ভাল ফল করেছে। ২০০৯ সালে দমদমে বিজেপির ভোট অস্বাভাবিক হারে কমেছিল। ওই ভোটে বিজেপি প্রার্থী তপন পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশের কিছু বেশি ভোট। সেই ভোটেই অমিতাভ ২০ হাজারের মতো ভোটে হারেন সৌগতের কাছে। এর পর থেকে এই আসন তৃণমূল এবং সৌগতের। ২০১৪ সালে রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তকে দমদমে প্রার্থী করেছিল সিপিএম। কিন্তু তিনিও হেরে যান দেড় লাখের বেশি ভোটে। সেই ভোটে আবার ভোটবৃদ্ধি হয় বিজেপির। চার গুণ ভোট বাড়িয়ে বিজেপি প্রার্থী তপন পান ২ লাখ ৫৪ হাজারের বেশি ভোট। কিন্তু তৃতীয় স্থানেই ছিলেন।
দমদমে ২০১৪ সালে বিজেপির ভোট ছিল ২২.৫ শতাংশ। সেই নির্বাচন শেষ হওয়ার কয়েক মাস পরেই প্রয়াত হন তপন। ২০১৯ সালে এই আসনে বিজেপি প্রার্থী করে বর্তমানে রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যকে। বিজেপির ভোট অনেকটা বেড়ে ৩৮ শতাংশ হলেও সৌগত ৫৩ হাজার ভোটে জয় পান।
সৌগতের সুবিধা অনেক। টানা সাংসদ থাকার পাশাপাশি এলাকার সব ক’টি বিধানসভাই তৃণমূলের দখলে। দমদম আসনের মধ্যে থাকা পুরসভাগুলিও তৃণমূলের দখলে। তবে একটা অসুবিধাও রয়েছে। প্রথমত, দলের মধ্যে প্রবীণ-নবীন লড়াইয়ে তিনি প্রথম দলে। দ্বিতীয়ত, পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের অধীন বিভিন্ন পুরসভার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও একাধিক তৃণমূল নেতার জেলে যাওয়া থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি সৌগতর গলার কাঁটা। যাঁরা তৃণমূলের অন্দরের খবর রাখেন, তাঁরা বলেন, দলনেত্রী মমতার ইচ্ছায় সৌগত প্রার্থী হলেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে দমদমে চাননি। সৌগতর এই ‘সমস্যা’কেই বিজেপি পুঁজি বানাতে চাইছে।
তবে শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দরের আসন দমদম থেকে কার উড়ান দিল্লি যাবে, তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে। লড়াই এখানে হাড্ডাহাড্ডি। বামেরা কি নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারবে? না কি আরও কিছু ভোট কেটে নেবে? জানে বি টি রোডের দু’ধার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy