গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সিএএ কার্যকর হওয়ায় মতুয়াদের ভাল হবে। এই কথাটা প্রচারে বারবার বলে চলেছেন পূর্ব বর্ধমানের বিজেপি প্রার্থী অসীম সরকার। ‘কবিয়াল’ হিসাবে পরিচিতি থাকলেও বিজেপি তাঁকে প্রার্থী করেছে অন্য পরিচয়ের জন্য। সেই পরিচয়ে অসীম মতুয়া সম্প্রদায়ের। নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন আসনের মতো না হলেও পূর্ব বর্ধমানেও যে মতুয়া অঙ্কে ভোট হতে পারে, তা দেখিয়ে দিচ্ছে এ বারের লোকসভা নির্বাচন। ফলে তৃণমূল প্রার্থী শর্মিলা সরকারকে (মতুয়া নন) সর্বত্র বলতে হচ্ছে, সিএএ চালু হলে মতুয়াদের কী কী বিপদ হতে পারে! অতএব, অতীতে না-থাকা নতুন অঙ্ক এ বার পূর্ব বর্ধমানের ভোট-পরীক্ষার সিলেবাসে।
এই আসনের জন্ম ২০০৯ সালে মূলত কাটোয়া লোকসভা ভেঙে। কাটোয়া দীর্ঘকাল ছিল বামেদের দখলে। কাটোয়া লোকসভা কেন্দ্রে ১৯৭১ সাল থেকেই জয় শুরু সিপিএমের। মাঝে ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস জিতলেও ১৯৮০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত টানা এই আসন ধরে রেখেছিল সিপিএম। চার বার করে সাংসদ হন সৈফুদ্দিন চৌধুরী এবং মেহবুব জাহেদি। কাটোয়া লোকসভার সর্বশেষ সাংসদ ছিলেন আবু আয়েশ মণ্ডল। যিনি পরবর্তীকালে তৃণমূলে যোগ দেন। ২০০৯ সাল থেকে কাটোয়া লোকসভার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। তৈরি হয় বর্ধমান পূর্ব আসন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে দুর্বার আন্দোলন সত্ত্বেও ২০০৯ সালে বর্ধমান পূর্বের সাংসদ হয়েছিলেন সিপিএমের অনুপ সাহা। কিন্তু ২০১৪ সালে ধাক্কা খায় সিপিএম। লক্ষাধিক ভোটে জয় পান ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক পদ ছেড়ে তৃণমূলে যোগদান করা সুনীল মণ্ডল। ২০১৯ সালেও জেতেন তিনি।
তৃতীয় বারের জন্য যে সুনীলকে আর তৃণমূল টিকিট দেবে না, তা একপ্রকার নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন সুনীলই। কারণ, ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছিলেন তিনি। মেদিনীপুরে অমিত শাহের সভায় যখন শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেন, তখন তৃণমূলের কয়েকজন বিধায়কের সঙ্গে সেখআনে একমাত্র সাংসদ হিসাবে ছিলেন সুনীল। রাজ্য বিজেপির ওয়েবসাইটে ‘দলীয় সাংসদ’ হিসাবে সুনীলের নামও উঠে গিয়েছিল। যদিও খাতায়কলমে সুনীল তৃণমূলেরই ছিলেন। নীলবাড়ির লড়াইয়ে বিজেপির সঙ্গে সঙ্গে আশাভঙ্গ হয়েছিল সুনীলেরও। তার পর থেকে তৃণমূলে থাকতে চাইলেও সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছিল তেল-জলের মতো।
গত ১০ মার্চ ব্রিগেড সমাবেশ থেকে যখন তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা ঘোষণা হয়, তখন অন্যতম ‘চমক’ ছিলেন পূর্ব বর্ধমানের প্রার্থী শর্মিলা। পেশায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক (অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর)। পূর্ব বর্ধমানের সঙ্গে যোগসূত্র বলতে স্কুল, কলেজে পড়াশোনা। পরে কলকাতাকেন্দ্রিক লেখাপড়া ও কর্মজীবন। বাপের বাড়ি কাটোয়ার অগ্রদ্বীপ হাসপাতাল পাড়ায়। থাকেন দমদমে। তবে কোনও কালেই রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ ছিল না শর্মিলার।
অভাবের সংসার থেকে বড় হওয়ার অতীত রয়েছে শর্মিলার। বাবা ছিলেন অগ্রদ্বীপ বাজারের সব্জিবিক্রেতা। ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক, ১৯৯৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক। কাটোয়া কলেজে ফিজিক্স অনার্সের পরে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ আর জি করে। সেখান থেকে এমবিবিএস এবং এসএসকেএম থেকে এমডি করে চাকরি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। শর্মিলার স্বামী সুদীপ ঘোষও চিকিৎসক। একমাত্র মেয়ে এখন দমদমের স্কুলে নবম শ্রেণিতে পাঠরতা।
নিজে রাজনীতি না করলেও শর্মিলার দিদি এবং জামাইবাবু তৃণমূলের। দিদি জয়া সরকার মজুমদার কাটোয়ার গাজিপুর পঞ্চায়েতে ১৯৯৮ এবং ২০১৩ সালে প্রধান ছিলেন। জামাইবাবু সুব্রত মজুমদার কাটোয়া ২ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি ছিলেন। পরে কাটোয়া ২ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষও ছিলেন। সেই সূত্রেই নাকি শর্মিলার নাম পৌঁছয় কালীঘাটে।
গত লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের পরিসংখ্যান বলছে, বর্ধমান-পূর্ব লোকসভা কেন্দ্র তৃণমূলের কার্যত ‘খাসতালুক’। ২০২১ সালের নীলবাড়ির লড়াইয়ে এই লোকসভায় সাতে-সাত পেয়েছে তৃণমূল। তবে বিজেপি প্রার্থী অসীমের কাছে এটা একেবারে অচেনা মাঠও নয়। অসীম নিজের গুরু মানেন ভবাপাগলাকে। সেই ভবাপাগলার কালনার আশ্রমেই তাঁর বেড়ে ওঠা। সেখানেই ছেলেবেলায় কবিগানে মুখে-খড়ি। যদিও পরে এই উদ্বাস্তু বিজেপি নেতার ঠিকানা হয় বনগাঁ। অসীমের রাজনীতিতে আগমন ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সিএএ-র দাবিতে আন্দোলন করতে মতুয়াদের নিয়ে দিল্লির যন্তরমন্তরে গিয়েছিলেন অসীম। সেখানেই ঘোষণা করেছিলেন, বিজেপি যদি সিএএ বিল পাশ করাতে পারে, তা হলে তিনি আজীবন বিজেপি করবেন। সেই বছর ডিসেম্বরেই রাজ্যসভা ও লোকসভায় পাশ হয় সিএএ বিল। খুশিমনে দিল্লি থেকে বনগাঁয় ফেরেন কবিয়াল। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁকে তাঁর ঘোষণা স্মরণ করিয়ে ভোটে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব। হরিণঘাটা বিধানসভায় প্রার্থী হন অসীম। জয়ও পান। তবে নদিয়ার মতুয়া-অধ্যুষিত হরিণঘাটা বিধানসভায় জয় যত সহজ ছিল, তার তুলনায় বর্ধমান পূর্বের ময়দান খানিক শুখা।
এই লোকসভার অনেক এলাকায় মতুয়া ভোট রয়েছে। সেই অঙ্কেই কবিয়ালের উপরে অসীম ভরসা পদ্মশিবিরের। আরও একটা বিষয় উল্লেখ্য। কালনা, পূর্বস্থলী, কাটোয়ায় ‘কবিয়াল’ অসীমের পরিচিতি রয়েছে। প্রার্থী হওয়ার পর অসীম জানিয়েছিলেন, বর্ধমান তাঁর কাছে বনগাঁর মতোই। ভবাপাগলার আশ্রমে যেমন তাঁর বেড়ে ওঠা, তেমনই কবিগানের সুবাদে পূর্ব বর্ধমানে প্রায় প্রতি মহল্লায় গত ৪৮ বছর ধরে তাঁর পরিচিতি। রাজনীতিতে নামার আগে সেই সব এলাকায় অনেক কবিগানের সভা মাতিয়েছেন তিনি। এখন রাজনৈতিক সভা মাতাতেও স্লোগানের চেয়ে গানেই বেশি নির্ভরতা অসীমের। প্রসঙ্গত, এই এলাকায় প্রভাব ছিল তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের। সভায় সভায় কৃষ্ণভজনার পাশাপাশি কেষ্টকেও আক্রমণ করছেন অসীম। ভোটের জন্য গান বেঁধেছেন, ‘মনে মনে ভাবো, আমি কত হনু রে / তোমার সব ভাবনাই লুপ্ত হবে / যে দিন জীর্ণ হবে তনু রে।’
গানবাজনা থেকে অনেক দূরে নীরবেই প্রচার সারছেন সিপিএম প্রার্থী নীরব খাঁ। পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক নীরবের বাড়ি কালনায়। ২০১৫ সালে কালনা পৌরসভার ভোটে লড়েছিলেন। ২০২১ সালেও তাঁকে কালনা আসনে প্রার্থী করেছিল দল। এই প্রথম তিনি লোকসভায় প্রার্থী। ফলে তাঁর দলের অতীত ইতিহাসই সম্বল নীরবের। যদিও সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রসন্ন হওয়ার মতো নয়। গত লোকসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের মোট ভোটপ্রাপ্তি ছিল ১৫ শতাংশের মতো।
এ বার লড়াই তৃণমূল-বিজেপির মধ্যেই। কিছু দিন আগে পর্যন্ত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে জেরবার তৃণমূল ভোটের আগে অনেকটাই এককাট্টা। রাজনীতির বাইরের প্রার্থী হওয়ায় কোনও দ্বন্দ্ব নেই। অন্য দিকে, অসীমকে নিয়ে বিজেপির অন্দরে প্রথম দিকে যে ক্ষোভের আবহ তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই প্রশমিত। বিজেপির দাবি, মতুয়া ভোট পেলে পদ্ম ফুটবে ধানের দেশ বর্ধমান পূর্বে। আর তৃণমূলের অঙ্ক, সিএএ-র পরে মতুয়া ভোট আর যাবে না পদ্মে। এখন দুই ফুলেরই এক মন্ত্র— রাখে মতুয়া, মারে কে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy