গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিরাট কোহলিকে গলি ক্রিকেটের টিমে রাখলে কী হবে? জবাব খুব সহজ— তিনি সময় দিতে পারবেন না। টিম ডুববে। অথবা প্রত্যাশিত ফল করতে পারবে না।
বঙ্গ বিজেপির ‘প্রভারী’ (পর্যবেক্ষক) নীতিও কি সেই কারণেই ব্যর্থ? পশ্চিমবঙ্গে ‘প্রভারী’ হিসেবে প্রায় বিরাট কোহলি পর্যায়ের নেতাদের নিয়োগ করে এসেছে বিজেপি। তাঁরা প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেননি। যার ফল ভুগতে হয়েছে বঙ্গ বিজেপিকে।
ঘটনাচক্রে, এখনই বাংলার দায়িত্বে রয়েছেন তিন জন অন্য রাজ্যের নেতা। তাঁদের উপর কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসল। যিনি অমিত শাহের ‘আস্থাভাজন’। সুনীল উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জয়ের নীরব কান্ডারি ছিলেন। এখন বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বনসল বাংলার পাশাপাশি ওড়িশা এবং তেলঙ্গানারও দায়িত্বে। সম্প্রতি লোকসভা নির্বাচনে গোটা দেশে যুব মোর্চার যাবতীয় কর্মসূচি দেখার দায়িত্বও তাঁকেই দেওয়া হয়েছে।
বনসল আগামী দিনে দলে আরও বড় দায়িত্ব পাবেন বলেই মনে করেন বিজেপি নেতারা। আবার তিনি সরকারেও দায়িত্ব পেতে পারেন। কারণ, এ-ও দেখা গিয়েছে যে, রাজ্যে বিজেপির ‘প্রভারী’ হয়ে এলে কপাল খুলে যায় বিজেপি নেতাদের। সম্প্রতি রাজ্য বিজেপির বর্তমান পর্যবেক্ষক মঙ্গল পাণ্ডে বিহারে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। এর আগে রাজ্যে বিজেপির পর্যবেক্ষক হয়ে আসেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়। পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচন ইনদওরের প্রাক্তন মেয়র কৈলাসের নেতৃত্বেই লড়েছিল বিজেপি। তিনি সদ্য মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে ইনদওর-১ আসন থেকে জিতেছেন। আর তার পরেই মন্ত্রী। কৈলাসের আগেই রাজ্যে ‘প্রভারী’ ছিলেন ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ স্লোগানের জন্য বিখ্যাত সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। তিনিও বাংলা ছেড়ে যাওয়ার পরেই মন্ত্রী হন উত্তরপ্রদেশে।
বস্তুত, বাংলায় বিজেপি যখন কোনও আলোচনাতেই ছিল না, তারা কোনও আসনও জিততে পারত না, তখন থেকেই বাংলায় পর্যবেক্ষক হয়ে যাঁরা এসেছেন তাঁরা অনেকেই পরে বড় দায়িত্ব পেয়েছেন দলে বা মন্ত্রিসভায়। তিন জন সর্বভারতীয় সভাপতিও হয়েছেন— মুরলীমনোহর জোশি, রাজনাথ সিংহ, জেপি নড্ডা। তাঁরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছেন। প্রয়াত অরুণ জেটলিও কিছু দিনের জন্য বাংলার পর্যবেক্ষক হিসাবে ছিলেন। একটি নির্বাচনে বাংলার দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন বিহারের সুশীলকুমার মোদী। তিনিও বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন তিন বছর।
বিজেপিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ নতুন নয়। আরএসএসের ধাঁচেই বিজেপি সংগঠনকে সাজিয়েছে। শুরুর দিনে বাংলায় বিজেপির ভিত তৈরি করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন সুন্দর সিংহ ভাণ্ডারী। তিনি পরে বিহারের রাজ্যপাল হয়েছিলেন। ভাণ্ডারীকেই বাংলায় প্রথম পদ্ম পর্যবেক্ষক বলা যেতে পারে। পরে বিহারের মন্ত্রী হওয়া কৈলাসপতি মিশ্রও বাংলায় পর্যবেক্ষক হয়ে এসেছেন। রাজস্থান এবং গুজরাতের রাজ্যপালও ছিলেন কৈলাসপতি। তবে বাংলায় রাজ্য বিজেপির যে ভবিষ্যৎ রয়েছে সেটা বোঝা যায় জোশির সময়ে। তিনি বাংলার পর্যবেক্ষক থাকার সময়েই শূন্য থেকে ১১ শতাংশ ভোট পাওয়ার জায়গায় যায় রাজ্য বিজেপি।
কিন্তু অন্য রাজ্য থেকে আগত ‘বিরাট কোহলি’রা কি রাজনৈতিক উন্নতির দিশা দেখাতে পারেন? সে প্রশ্ন গত বিধানসভা নির্বাচনের পরেই উঠেছিল। বিপর্যয়ের পরে বিজেপির অন্দরেই আলোচনা হয়েছিল যে, বাংলা বুঝতে না পারা অন্য রাজ্যের নেতাদের সঙ্গে এখানকার কর্মীদের ‘বোঝাপড়ার সমস্যা’ তৈরি হয়েছিল। ভোটের পরে প্রকাশ্যেই তা নিয়ে তোপ দেগেছিলেন রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি তথাগত রায়। সেই সময়ের কথা এখন আর বলতে না চাইলেও তথাগত অবশ্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ নীতির পক্ষে। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘বাংলায় বিজেপির ভিত অনেক পর্যবেক্ষকই মজবুত করেছেন। তাঁদের কথা এখনকার নেতারা অনেকেই জানেন না। পদটার দোষ নেই। দেখতে হবে, কে সেই পদে বসেছেন। ব্যক্তির উপর, তাঁর কর্মপদ্ধতির উপর নির্ভর করে তিনি কেমন ফল দিতে পারবেন।’’
তাঁর ত্রিপুরার রাজ্যপাল থাকার সময়ের কথা উল্লেখ করে তথাগত বলেন, ‘‘ওখানে তখন পর্যবেক্ষক ছিলেন সুনীল দেওধর। প্রথমেই বাংলা ভাষা শিখে নেন। কিছু কিছু ককবরক শব্দও শেখেন। ফলে কাজ করতে সুবিধা হয়েছিল। ত্রিপুরায় খুব কম সময়ে বিজেপি ভাল ফল করতে পেরেছে।’’ দেওধর প্রসঙ্গে তথাগত আরও বলেন, ‘‘আমি ওঁকে এখানে (বাংলায়) চেয়েছিলাম। বাংলা বলতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সুসংগঠকের গুণাবলি ছিল সুনীলের মধ্যে। উনি এখন অন্ধ্রপ্রদেশের দায়িত্বে। দায়িত্ব পেয়েই আগে তেলুগু ভাষা রপ্ত করে নিয়েছেন।’’
তবে বিজেপির বর্তমান রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার মনে করেন না, ভাষা যে বেশি সমস্যা হতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘প্রভারীর কাজ সভায় গিয়ে বক্তৃতা করা নয়। তাঁরা সংগঠনের খুঁটিনাটি বিষয়ে নাক গলান না। মূলত অভিভাবকের ভূমিকায় থাকেন। পথ দেখিয়ে দেন। কাজ রাজ্যের নেতাদেরই করতে হয়।’’ বস্তুত, সুকান্তের দাবি, ‘‘রাজ্যে বিজেপির কপাল ফেরেনি কে বলল? কয়েক বছর আগেও কি ভাবা গিয়েছিল বাংলায় একমাত্র বিরোধী দল হয়ে উঠবে বিজেপি? এই লোকসভা নির্বাচনের পরে বাংলা দেখবে গোটা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যের কোনও ফারাক নেই। মোদীজির বিজেপি গোটা দেশেই আরও শক্তিমান হবে।’’
এটা ঠিক যে, পর্যবেক্ষকেরা বরাবর আড়াল থেকেই কাজ করেন। এখনকার মঙ্গল পাণ্ডে বা তাঁর দুই সহকারী অমিত মালব্য এবং আশা লাকড়া দলের বৈঠকে থাকলেও প্রকাশ্য মঞ্চে কমই থাকেন। কিন্তু সিদ্ধার্থনাথ এবং কৈলাস বেরিয়ে এসেছিলেন জনসমক্ষে। বিজেপির অনেকে বলেন, সেই সময়টা বিজেপি ‘বেড়ে ওঠার কাল’। সময়ের ‘প্রয়োজনীয়তা’ মাথায় রেখেই তাঁরা কর্মপদ্ধতি বদলেছিলেন। তবে অনেকে বলেন, ‘‘কাজের থেকে দেখনদারি বেশি হয়েছে ওই সময়ে।’’ তবে অনেকে এমনও মনে করেন যে, কৈলাস চেষ্টা করেছিলেন।
২০২২ সালের মাঝামাঝি লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছিল বিজেপি। অগস্টে বাংলার দায়িত্ব পান সুনীল। সেই সময়ে রাজ্য ঘুরে একের পর এক বৈঠকে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, কী ভাবে ভোটের প্রস্তুতি চান। তাঁর অধীন তিন রাজ্যের জন্য কি আলাদা আলাদা পরিকল্পনা? সুনীল বলেছিলেন, ‘‘বিজেপি সর্বত্র একই পরিকল্পনায় এগোয়— সংগঠন দিয়ে ভোট জিততে হবে। এ ছাড়া স্থানীয় স্তরে কিছু বৈচিত্র থাকে। তার জন্য মূল বিষয় বদলায় না।’’
বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য মনে করেন, ভোটে লড়া ছাড়াও সারা বছরের সাংগঠনিক কাজে পর্যবেক্ষক বা কেন্দ্রীয় নেতাদের বড় ভূমিকা থাকে। প্রকৃত কর্মী বা নেতা কী ভাবে হয়ে উঠতে হয়, সে ব্যাপারেও তাঁরা দিশারীর কাজ করেন। শমীকের বক্তব্য, ‘‘আমরা সর্বভারতীয় দল। ফলে ভাষা বা সংস্কৃতির বিভিন্নতা থাকলেও সেটা কখনও প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়নি। তা হলে দল এত বড় হতে পারত না। এক দিনে কিছু হয় না। আবার কোনও এক জন সব করে দেন, তেমনও নয়। বাংলায় আমাদের যত এগোনো-পিছোনো, সবের সাক্ষী থেকেছেন প্রভারীরা।’’ এই সাংসদের কথায়, ‘‘একটা সময়ে বাংলায় বিজেপির দৃশ্যমানতাই ছিল না। তখন থেকে কেন্দ্রীয় নেতারাই বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তখন দল ছোট ছিল বলে এক জনকে দিয়ে হয়ে যেত। এখন দল বড় হয়েছে। ফলে অনেককে দায়িত্ব নিতে হয়।’’
ঠিকই। বিরাট কোহলিদের দরকার। কিন্তু গলির ক্রিকেটেও? তাঁরা ‘ম্যাচ’ নিরঙ্কুশ না-জেতানো পর্যন্ত প্রশ্ন রয়ে যাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy