মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
বাড়ি তৈরির কাজ তদারক করছেন সুতনু দাস। জ্যৈষ্ঠের দুপুরে, গলদঘর্ম অবস্থা। গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালান। টাকা জমিয়ে একচিলতে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানাচ্ছেন তিলে তিলে। ওড়িশা সীমানাবর্তী নয়াগ্রাম বিধানসভার শেষ প্রান্ত ধূমসাই গ্রামের বাসিন্দা সুতনু বলছিলেন, “কোন দলের কে যে প্রার্থী, কারওরই নাম জানি না। আসলে এখানে তো প্রতীক দেখে মানুষ ভোট দেন!”
এক সময় কেউ প্রত্যন্ত এলাকার খবরই রাখতেন না। তবে স্থানীয়রা মানছেন, এলাকায় উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল হয়েছে। ১৫ কিলোমিটার দূরে বালিগেড়িয়ায় সরকারি কলেজ, ২০ কিলোমিটার দূরে খড়িকামাথানিতে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, পিচের রাস্তা, গ্রামে গ্রামে পানীয় জল, নয়াগ্রামের ডাহি ও পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ি ব্লকের ভসরাঘাটের সংযোগকারী সুবর্ণরেখার উপর জঙ্গলকন্যা সেতু হয়েছে। দূরত্ব কমেছে খড়্গপুর ও মেদিনীপুরের। তবে সুতনুর আক্ষেপ, “পঞ্চায়েতের প্রাপক-তালিকায় নাম থাকলেও কবে যে সরকারি বাড়ি পাব, জানি না। তাই মাথা গোঁজার আস্তানা বানানো শুরু করেছি।” তাতেও কাউকে দোষারোপ করতে রাজি নন ‘বৈষ্ণব’ সুতনু। কারণ, উন্নয়নে তিনি ‘খুশি’।
বছর ছাব্বিশের যুবক স্বদেশরঞ্জন দাস গণিতের স্নাতক। ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বন্ধুরা কেউ ভিন্ জেলায় কাজ করেন, কেউ ভিন্ রাজ্যে। স্বদেশ বলছেন, “রাস্তা হলেও দূরপাল্লার বাসের যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালেও সব পরিষেবা মেলে না।” ধূমসাই থেকে জেলা সদর ঝাড়গ্রামের দূরত্ব ১০৫ কিলোমিটার। জঙ্গলকন্যা সেতু পেরিয়ে পড়শি জেলার সদর মেদিনীপুরের দূরত্বও প্রায় ৮০ কিমি। ফলে নয়াগ্রামের প্রান্তিক এলাকার বাসিন্দারা চিকিৎসার জন্য ৩৫ কিমি দূরে ওড়িশার বারিপদা হাসপাতাল বা ৫০ কিলোমিটার দূরের বালেশ্বর হাসপাতালে যান।
মোটরবাইক থামিয়ে ওড়িশার রাসগোবিন্দপুর এলাকার সুরথ মান্ডি বলেন, “ব্যবসার প্রয়োজনে নয়াগ্রামে নিত্য যাতায়াত করি। সন্দেশখালি, চাকরি দুর্নীতি— এ সব নিয়ে বাংলার এই প্রান্তের মানুষের মাথাব্যথা নেই। কারণ হয়তো ঘরে ঘরে নানা পরিষেবার অর্থপ্রাপ্তি।”
ধূমসাইয়ের মাহালি পাড়ায় দেখা মিলল মোহাম্মদ নুরেজ্জামানের। এলাকার জনজাতি মাহালি সম্প্রদায়ের তৈরি বাঁশের ঝুড়ি পূর্ব মেদিনীপুরে রফতানি করেন। নুরেজ্জামানের কথায়, “এলাকার অধিকাংশ যুবকের হাতে কাজ নেই। কর্নাটক, অন্ধ্র কিংবা গুজরাতে কাজ করছেন অনেকে। তাই এলাকায় শিল্প চাই।” স্থানীয়দের একাংশের আরও অভিযোগ, জঙ্গল কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু বন দফতর ও পুলিশ-প্রশাসন নীরব।
বড়নিগুই অঞ্চলের মরচি গ্রামের অঙ্কনশিল্পী সত্যেন্দ্রনাথ মাহাতো সব দলের দেওয়াল লিখছেন। জানালেন, সবচেয়ে বেশি দেওয়াল লেখার বরাত পেয়েছেন বিজেপির কাছ থেকে। কেন্দ্র ঘুরেও মালুম হয়েছে, সাংগঠনিক দুর্বলতা ঢাকতে পুরনো-নতুন কর্মীদের একযোগে মাঠে নামিয়েছে গেরুয়া শিবির। উঁচু কমলাপুর গ্রামে তিন ফসলি জমি। সেখানকার কৃষক পুষ্পেন্দু দাস বলছেন, “হাতির উপদ্রবে আখ চাষ বন্ধ। ধান আর মরসুমি আনাজ চাষেরও ক্ষতি করে হাতির দল।” জরকা গ্রামের বাবলু সরেনের কাকা যতীন্দ্র সরেন কয়েক বছর আগে হাতির হানায় প্রাণ হারান। বাবলু বলছেন, “সব সময়ে হাতির ভয়।” স্থানীয় বাসিন্দা ফুলমণি সরেন বলছেন, “যে কোনও সময়ে হাতি আমাদের জীবন কেড়ে নিতে পারে।”
ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বান্দোয়ান বিধানসভা এলাকাতেও পিচ রাস্তা, পানীয় জলের কল চোখে পড়ল। আশপাড়া গ্রামে সাঁওতাল ও কুড়মিরা মিলেমিশে থাকেন। পেশায় ছুতোর মিস্ত্রি মহাদেব মাহাতো বলছেন, “এখানে কাঠের দামি আসবাব কেনার লোক কোথায়? তাই অন্ধ্রপ্রদেশের একটি রাসায়নিক কারখানায় বছরের ছ’-আট মাস কাজ করি।” মাংলা গ্রামের বাসিন্দা ঠাকুরদাস মাঝি, মলীন্দ্র মাঝিরা বলছেন, “সেচের ব্যবস্থা নেই। আকাশের ভরসায় বছরে এক বার ধান চাষ হয়।” ঘাঁটিহুলি, পাটকিটা, দুয়ারসিনি মোড় হয়ে ছবির মতো চওড়া পাহাড়ি পিচ রাস্তা চলে গিয়েছে ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলার দিকে। কুচিয়া পঞ্চায়েতের জোড়বেড়া গ্রামের বুদ্ধেশ্বর টুডুর তিন ছেলের মধ্যে অর্জুন ও ডমন স্কুলছুট হয়ে জামশেদপুরে কাজ করছেন। ছোট ছেলে বিভীষণ এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেন। বুদ্ধেশ্বরের গলায় হতাশা, “ছোটটাকেও হয়তো সংসারের জন্য পড়ার পাট চুকোতে হবে।”
২০০৬ সালে দুয়ারসিনি প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছিল মাওবাদীরা। ২০১১ সালে পরিবর্তনের পরে নতুন করে বন দফতর চালু করে প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। আসনপানি গ্রামের বন পরিচালন কমিটি এখানে কয়েকটি কটেজ চালায়। তবে আসনপানি গ্রামের বিভূতি মুর্মু বলছেন, “শুধু কয়েকটা হোম স্টে করে তো আর এলাকায় সবার কাজের সংস্থান হবে না।” বরাবাজারের জয়কিশোর নামহাতা একটি সাইবার কাফে চালান। তিনিও মানছেন, “এলাকায় কাজের সমস্যাটাই বড়।” বরাভূম রাজবাড়ি চত্বরের রাস্তায় সাইকেল থামিয়ে বিদ্যুৎ দফতরের অস্থায়ী কর্মী সন্দীপ দেবসিংহ জানান, “এলাকায় শান্তি ফিরেছে। আবার রাজবাড়ি চত্বরে রামমন্দিরও হয়েছে।”
বেলপাহাড়ির বাঁশপাহাড়ি মোড়ে দাঁড়িয়ে বিজেপি কর্মী মথন মাহাতোর দাবি, “নিরপেক্ষ ভাবে পঞ্চায়েত ভোট হলে অনেক আসনেই আমরা জিততাম। লোকসভায় আর কারচুরি করতে পারবে না তৃণমূল।” জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অজিত মাহাতোর জবাব, “বিজেপির সংগঠন নেই। তাই তৃণমূলের নামে অপপ্রচার করছে। ওরা তো মিছিল-সভা ভরাচ্ছে টাকা দিয়ে লোক এনে।”
ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও পুরুলিয়া— তিন জেলার ৭টি বিধানসভা নিয়ে জনজাতি সংরক্ষিত ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্র। এর মধ্যে ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রাম, বিনপুর ও পুরুলিয়ার বান্দোয়ান বিধানসভা জনজাতি সংরক্ষিত। লোকসভা এলাকায় জনজাতিরা প্রায় ৩০ শতাংশ। তার পরই কুড়মিরা, প্রায় ২৫ শতাংশ। তফসিলি জাতির সংখ্যা প্রায় ২১ শতাংশ। জাতিসত্তার দাবিতে দু’টি কুড়মি সামাজিক সংগঠন দু’জনকে প্রার্থী করেছে। ফলে কুড়মি ভোট ভাগাভাগি হলে শাসকদলেরই সুবিধা। ২০১৯ সালে মাত্র কয়েক হাজার ভোটে আসনটি জিতেছিল বিজেপি। টিকিট না পেয়ে বিদায়ী সাংসদ কুনার হেমব্রম সদ্য তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
উল্টো দিকে আবার, শেষ বেলায় বিজেপির জেলা সভাপতি তুফান মাহাতো ও প্রাক্তন জেলা সভাপতি সুখময় শতপথী বিরোধ মিটিয়ে একযোগে দলের প্রার্থী প্রণত টুডুকে জেতাতে নেমেছেন। নেগাচারী কুড়মি সমাজের নির্দল প্রার্থী বরুণ মাহাতোও প্রচারে রয়েছেন। যদিও তুলনায় বামেরা ম্রিয়মাণ। আসন ধরে রাখা যাবে? তুফান মাহাতো বলছেন, “রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক দুর্নীতি ও তৃণমূলের অত্যাচারে ভোটারদের একটি বড় অংশ এখন আমাদের সমর্থন করছেন।”
ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মু বলছেন, “উন্নয়নের ছোঁয়ায় প্রতিটি এলাকা বদলে গিয়েছে। লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের তিন লাখেরও বেশি উপভোক্তা আমাদের এগিয়ে রাখছে। ঝাড়গ্রাম আসন আমরাই পাচ্ছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy