বার বার ফিরে আসছে প্রবাদ। ‘আমও গেল, ছালাও গেল’! ওঁদের জন্য। ওঁরা সে সব রাজনৈতিক চরিত্র, যাঁরা লোকসভা ভোটে দলের প্রার্থী হতে গিয়ে নিজেদের বিধায়ক-পদ বাজি রেখেছেন। হেরেছেন। এখন দলকে ভাবতে হচ্ছে, বিধায়কের খালি হওয়া আসনে আসন্ন উপনির্বাচন নিয়ে।
রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়কের পদ ছেড়ে রানাঘাট লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী হন মুকুটমণি অধিকারী। প্রচার-পর্বেই তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকার কটাক্ষ করেন, “মুকুটমণির আমও যাবে, ছালাও যাবে।” কার্যত তা-ই ঘটেছে। প্রায় এক লক্ষ ৮৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন মুকুট। ফলে, তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে।
মুকুট বিজেপিতে ফিরতে পারেন বলে ফিসফাস শুরু হয়েছে। তিনি নিজে বলছেন, “বিজেপির কিছু লোকজন এবং সেই সঙ্গে আমাদের দলের একটা অংশ অপপ্রচার করেছে। কখনও বিজেপিতে ফেরার কথা বলিনি।’’ সে কথা সত্যি হলে ভোটের যুদ্ধের পরে এ বার তৃণমূলের ‘দ্বন্দ্বদীর্ণ’ সংসারে মানিয়ে নিতে হবে তাঁকে। সে প্রসঙ্গে মুকুট বলেন, ‘‘দলের সব গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করছি। সকলকে নিয়েই চলব।’’ একই পরিস্থিতির মুখোমুখি তৃণমূলের বিধায়ক-পদ ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে কলকাতা উত্তর লোকসভার প্রার্থী হয়ে পরাজিত তাপস রায়। মুকুট অবশ্য দলবদলের সময়ে বিধায়ক-পদ ছাড়েননি, যা তাঁকে করতে হয়েছিল লোকসভায় প্রার্থী হতে গিয়ে নিয়মের গেরোয়। আর তাপস দলবদলের সঙ্গেই বিধায়ক পদ ছাড়েন।
মতুয়া প্রধান রানাঘাট দক্ষিণে তৃণমূল যদি মুকুটকেই প্রার্থী করে, তাঁর কি জেতার সম্ভাবনা আছে? সরাসরি জবাব এড়িয়ে মুকুটমণি বলেন, ‘‘সদ্য লোকসভা ভোট শেষ হল। উপনির্বাচন নিয়ে এখনই কিছু ভাবছি না।’’
তৃণমূলের বনগাঁ লোকসভার প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বাগদা কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তৃণমূলে যোগদান। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁকে দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি করেন। লোকসভায় টিকিট পাওয়ার পরে, তিনি বিধায়ক-পদ থেকে ইস্তফা দেন। ভোটে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুরের কাছে প্রায় ৭৪ হাজার ভোটে হেরেছেন। ভোটের প্রচারে গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে এসে শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছিলেন, বিশ্বজিতের আম এবং ছালা—দুই-ই যাবে। বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘ভোটে জয় পরাজয় থাকবে। এটাকে মেনে নিয়েই জীবনের পথে এগিয়ে চলতে হয়। বুধবার থেকেই জনসংযোগের কাজ শুরু করেছি।’’ তাঁর সংযোজন: ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে ফোন করে সাংগঠনিক কাজ করতে বলে দিয়েছেন। সব রকম সহযোগিতা করবেন। আমি বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি। ফলে, দলের কাজ আমাকে করতে হচ্ছে।’’ আগামী দিনে বাগদা বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনে বিশ্বজিৎকে ফের প্রার্থী করা হবে কি না, তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে চর্চা শুরু হয়েছে।
বিজেপির টিকিটে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে রায়গঞ্জে জেতেন কৃষ্ণ কল্যাণী। তৃণমূলে ফিরে এ বার রায়গঞ্জ লোকসভায় প্রার্থী হন। বিজেপির কার্তিকচন্দ্র পালের কাছে ৬৮,১৯৭ ভোটে হেরেছেন তিনি। কৃষ্ণের নাম না করে বিজেপির উত্তর দিনাজপুর জেলা সভাপতি বাসুদেব সরকারের কটাক্ষ, ‘‘বিধায়ক ও রাজ্য বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যানের পদ গেল। সাংসদও হতে পারলেন না। আম ও ছালা— দু’টোই চলে যাওয়ার সমান!’’ কৃষ্ণের দাবি, ‘‘পদের জন্য রাজনীতি করিনি। যত দিন বেঁচে থাকব, মানুষের জন্য কাজ করে যাব।’’ রায়গঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনে কৃষ্ণকে তৃণমূল প্রার্থী করবে কি? তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক অসীম ঘোষের দাবি, সে বিষয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে এখনও আলোচনা হয়নি।
দল না ছাড়লেও যে সব বিধায়কেরা লোকসভায় প্রার্থী হয়ে হেরেছেন, তাঁদের অন্যতম বিজেপির তিন বিধায়ক। অগ্নিমিত্রা পাল, হিরণ, শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী। রাজ্যের মন্ত্রী বিপ্লব মিত্রও হেরেছেন। বিধায়ক থাকতে থাকতেই লোকসভায় জিতেছেন তৃণমূলের পাঁচ জন—জুন মালিয়া, জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়া, অরূপ চক্রবর্তী, পার্থ ভৌমিক ও হাজি নুরুল ইসলাম। লোকসভায় জিতে এসেছেন বিজেপির বিধায়ক মনোজ টিগ্গা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)