E-Paper

হাঙ্গামা হলে প্রতিরোধ, বার্তা আতঙ্কের ভাঙড়েও

২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় এই ভাঙড় বার বার সংবাদে এসেছে মৃত্যুমিছিলের কান্না, হাহাকারে। বছর ঘুরতে ফের ভোট আসায় সন্ত্রাসের স্মৃতি পাক খেয়ে উঠে এসেছে।

বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসের ঘটনা বলছেন নিলুফা বিবি।

বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসের ঘটনা বলছেন নিলুফা বিবি। — নিজস্ব চিত্র।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:০৬
Share
Save

দিঘির পাড়ে এক চিলতে বাড়ি। দাওয়ায় ঠাকুমার কোলে বসে খেলা করছে বছর তিনেকের একটি ছেলে। আপাত শান্ত বাড়ির চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, এক বছর আগে এই বাড়ির উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। পঞ্চায়েত ভোটের সংঘর্ষে ভাঙড়ে ‘খুন হন’ এই বাড়িরই ছেলে মহিউদ্দিন মোল্লা। রাজনীতির ঝড় অনাথ করে দিয়েছে মহিউদ্দিনের পুত্রকে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে হোমগার্ডের চাকরি পেয়েছেন মহিউদ্দিনের স্ত্রী। দূরে পোস্টিং হওয়ায় ছেলেকে সময় দিতে পারেন না। বাবা-মায়ের আদরের স্বাদ ঠাকুমার আঁচলেই খুঁজে নেয় শিশুটি।

নাতিকে কোলে বসিয়ে সে দিনের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন মহিউদ্দিনের বৃদ্ধা মা বসিরন বিবি। নাতির মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলতে থাকেন, ‘‘এ কী রাজনীতি? ভোটে হাতাহাতি, মারামারি হতে পারে। তা মিটেও যায়। তা বলে একটা মানুষকে মেরে ফেলবে? আমার সংসার যে ছারখার হয়ে গেল, তার দাম কে দেবে?’’

লোকসভা ভোটের আগে এমনই প্রশ্ন বারবার উঠছে ভাঙড়ে।

২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় এই ভাঙড় বার বার সংবাদে এসেছে মৃত্যুমিছিলের কান্না, হাহাকারে। বছর ঘুরতে ফের ভোট আসায় সন্ত্রাসের স্মৃতি পাক খেয়ে উঠে এসেছে। পথেঘাটে, বাড়ির উঠোনে বসে থাকা বাসিন্দাদের মুখে শুধুই সেই হাড় কাঁপানো দিনরাতের কথা।

চকমরিচা গ্রামের নিলুফা বিবি আজও সে সব কথা উঠলে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বোমার আঘাতে তাঁর স্বামী রফিক আলির পা ঝলসে গিয়েছিল। সঙ্গে জুটেছিল পুলিশ এবং শাসক দলের রক্তচক্ষু। বলছেন, ‘‘পুলিশ এসে তো আমাদের বাড়ির ছেলেদেরই খুঁজছিল। সবাই বাড়িছাড়া। এ দিকে রাতবিরেতে পুলিশ দলবেঁধে আসছে, শাসাচ্ছে। আমরা মেয়েমানুষ। অত কি বুঝি! তবু দাঁতে দাঁত চেপে সয়েছি।’’ মাস দুয়েক হাসপাতালে ছিলেন রফিক। ছাড়া পেলেও হাতে, পায়ে পোড়ার দগদগে ছাপ এখনও রয়েছে।

শুধু কি সন্ত্রাস? কয়েক মিনিট কথা বললেই বেরিয়ে আসে পুলিশের একাংশের ‘কীর্তি’। শানপুর গ্রামের আজহারউদ্দিন মোল্লাই যেমন। এমএ ক্লাসের পড়ুয়া আজহার হাঙ্গামার পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। তার আইএসএফ সমর্থক দাদাকে না পেয়ে তাঁকেই তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। রাজনীতির সঙ্গে ‘সম্পর্কহীন’ তাঁর আরও দুই দাদারও হাজতবাস হয়। ৩৪ দিন পরে জামিন পেলেও সেই মামলা এখনও মেটেনি। আজহারের বাবা মহম্মদ আজিদ আলি মোল্লা বলছেন, ‘‘মামলায় জড়িয়ে ছেলেটার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার হয়ে গেল!’’ পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে আজিদ নিজেও পালিয়েছিলেন। বর্ষার রাতে অন্ধকার কবরখানায় গিয়ে শুয়েছিলেন। বলছিলেন, ‘‘মৃত্যুর আগেই কবরে শুয়ে এসেছি।’’

ভাঙড়ের রাজনীতির লোকেরা বলছেন, ভোটে শাসানি, ধমক ভাঙড়ে গত এক দশকে নতুন নয়। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটে শাসকের পাল্টা বিরোধীরাও শক্তি প্রদর্শন করে। বিশেষ করে নতুন দল আইএসএফ পাল্টা মারের পথ নেওয়ায় সংঘর্ষ বড় হয়েছে। প্রাণহানিও বেশি। বাম এবং আইএসএফ সমর্থকেরা অবশ্য বলছেন, তৃণমূল ভোট লুটের চেষ্টা না করলে তো গোলমাল বাধত না। কেন শাসক দলের নেতারা বিনা ভোটে জেতার চেষ্টা করেছিলেন, সেই প্রশ্নও তুলছেন তাঁরা। অনেকে একান্তে এ-ও মেনে নিচ্ছেন, ভাঙড়ে এখনও আইএসএফ-বামের জোট ঘোষণা হয়নি। তাই ভোটে হাঙ্গামা হলে যৌথ প্রতিরোধ হবে কি না, তা নিয়েপ্রশ্ন থাকছেই।

তৃণমূলের ক্যানিং (পূর্ব)-এর বিধায়ক তথা ভাঙড়ে দলের ‘সেনাপতি’ সওকাত মোল্লা অবশ্য গোলমালের দায় বাম-আইএসএফের ঘাড়ে দিয়ে বলছেন, ‘‘লোকসভা ভোটে কোনও গোলমাল হবে না। যদি আমার দলেরও কেউ অশান্তি করে, তা হলে তার দায় দল নেবে না। পাশেও দাঁড়াবে না। পুলিশ-প্রশাসন যা করার করবে।’’ তিনি এ-ও বলছেন, ‘‘এ বার মানুষ আর ওদের সঙ্গে নেই।’’

সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য তুষার গুহ অবশ্য বলছেন, ‘‘সওকাত ঠিক কথা বলছেন না, সেটা ভাঙড়বাসী জানেন। পঞ্চায়েত ভোটের হাঙ্গামায় ক্যানিং, বাসন্তী এলাকা থেকে গাড়ি কে পাঠিয়েছিল? কার নির্দেশে, পুলিশ-প্রশাসনের মদতে ভোট লুট হয়েছিল? লোকসভা ভোট আর পঞ্চায়েত ভোট এক নয়, এটাও বুঝতে হবে।’’ তাঁর পাল্টা হুঁশিয়ারি, এ বারও শাসকদল হাঙ্গামা করলে মানুষ পাল্টা প্রতিরোধ করবে।

রাজনীতির এই তাল ঠোকাঠুকিতে কোথাও নিজের অজান্তে জড়িয়ে যান নিলুফার মতো গৃহবধূরা। রমজান মাসে উপরওয়ালার কাছে ‘শান্তিতে’ ভোট মেটার প্রার্থনা করেও বলেন, ‘‘হামলা হলে বাঁচার জন্য প্রতিরোধ তো করতেই হবে।’’

চৈত্রের তপ্ত দুপুরে আপাত শান্ত ভাঙড়ে নিলুফার কথাই প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 Bhangar West Bengal Spot Reporting

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।