Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

গনি-গড়ে ‘গেরাম’ তত্ত্ব

চরিঅনন্তপুরের দুইশতবিঘা গ্রামের নেতলা সিংহ কংগ্রেসের পঞ্চায়েত সদস্যা ছিলেন দু’বার। এখন তিনি মাসে এক হাজার টাকা বিধবা ভাতা পান।

—প্রতীকী ছবি।

রাজীব চট্টোপাধ্যায়
মালদহ শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৫১
Share: Save:

পাওয়া-না পাওয়ার পাল্লা যে দিকেই ভারী হোক না কেন, ওঁরা কাকে ভোট দেবেন, তা ঠিক করে দেবে ‘গেরাম’। কিন্তু এই ‘গেরামের’ নিয়ন্ত্রণ যাঁদের হাতে, তাঁরা এখনও ‘জল মাপছেন।’

বৈষ্ণবনগরের বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা চরিঅনন্তপুর হোক বা সুজাপুরের নয়াবস্তি, ভোটে কারা এগিয়ে— প্রশ্ন করতেই জবাব আসে, “ওটা গেরামের লোক যা ঠিক করবে...।” এই ‘গেরামের’ নিয়ন্ত্রকেরা পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। কেউ তৃণমূল, কেউ বা বিজেপি। কোথাও আবার নিয়ন্ত্রক কংগ্রেস বা বামেরা। তবে ভোট কোন দিকে যাবে, সেই প্রশ্নে কম-বেশি দোলাচল রয়েছে প্রায় সব মহল্লাতেই।

চরিঅনন্তপুরের দুইশতবিঘা গ্রামের নেতলা সিংহ কংগ্রেসের পঞ্চায়েত সদস্যা ছিলেন দু’বার। এখন তিনি মাসে এক হাজার টাকা বিধবা ভাতা পান। তাঁর কথায়, “গ্রামে ট্যাপ নেই। টিউবওয়েলের জল খাওয়া যায় না। খাওয়ার জল কিনতেই ভাতার টাকা খরচ হয়ে যায়।” দু’দিনে এক হাজার বিড়ি বেঁধে ১৬৫ টাকা পান নেতলা। রেশনের চাল-আটায় খিদে মেটে ঠিকই, তবে পুত্রবধূ ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ না পাওয়ায় আক্ষেপ গোপন করেননি তিনি। এলাকায় কাজ না থাকায় তাঁর দুই ছেলে বেঙ্গালুরুতে রাজমিস্ত্রির কাজে গিয়েছেন। ভোট কোন দিকে জিজ্ঞাসা করতেই খানিক চুপ থেকে নেতলা বলেন, “এটা গেরাম ঠিক করবে।” নেতলার বাড়ির ৫০ মিটার দূরে বাস দেবী মণ্ডলের। তাঁর ক্ষোভ, “লক্ষ্মীর ভান্ডার পেতে ২০০০ টাকা দিতে হয়েছে।” তিনিও বলেন, “কাকে ভোট দেব, তা ঠিক করবে গেরাম।” ওই গ্রামের হারাধন সিংহের অভিযোগ, “২০০০ টাকা দিয়েছি। তার পরে মেয়ে লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা পাচ্ছে।” তিনিও ‘গেরামের’ নির্দেশের অপেক্ষায় আছেন।

তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি সুজাপুরেও এই ‘দোলাচল’ দেখা গিয়েছে। কালিয়াচকের নয়মৌজা স্ট্যান্ডে চায়ের দোকানে গল্পের অবসরে এক যুবক বলেন, “এখানে তৃণমূলই সব। তবে এই যে দেখুন (বিজেপির হোর্ডিং দেখিয়ে) ওরাও আছে।” পাশ থেকে আর এক জন মুচকি হেসে বলেন, “এরাও আছে, ওরাও আছে। পুলিশের জুলুমও আছে, তোলাবাজিও আছে।”

মালদহ দক্ষিণে কংগ্রেস প্রার্থী করেছে বিদায়ী সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরীর (ডালু) ছেলে ইশা খান চৌধুরীকে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে যুক্ত শাহনওয়াজ আলি রায়হানকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। বিজেপি টিকিট দিয়েছে ইংরেজবাজারের বিধায়ক শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরীকে। তিনি গত লোকসভা ভোটে ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়েও হেরে যান ডালুবাবুর কাছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কথায়, গনির ভাই ডালু মূলত সুজাপুরের ভোটেই শ্রীরূপাকে আট হাজারের ব্যবধানে হারান।

কিন্তু গত বিধানসভা ভোটে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। বাম-কংগ্রেস নেমে আসে শূন্যে। সুজাপুরে এক লক্ষেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে জেতে তৃণমূল। ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোটে আবার বিজেপিকে তিনে ঠেলে প্রধান বিরোধী পক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে বাম-কংগ্রেস জোট।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ‘এনআরসি’ অথবা ‘সিএএ’ নিয়ে আগের মতো আলোচনা শোনা যাচ্ছে না। তৃণমূল নেতারা যদিও প্রচারে বলছেন, “সিএএ মানবে না রাজ্য সরকার। এনআরসি ক্যাম্প হলে তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।” এই আবহে সংখ্যালঘু ভোট টানতে সক্রিয় হয়েছে বিজেপি। শ্রীরূপার কথায়, “কালিয়াচকেও হোর্ডিং দিয়েছি। আগে ওখানে বিজেপির কেউ যেত না। আমি যাচ্ছি। বহু সংখ্যালঘু আমাদের ভোট দেবেন।” উত্তরবঙ্গে একমাত্র মহিলা প্রার্থী শ্রীরূপা। সে কথাও প্রচার করছে বিজেপি। তবে এতে মহিলা ভোটে প্রভাব আদৌ পড়বে কি না, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। কারণ, সব মহল্লাতেই ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে’র প্রসঙ্গে উঠতেই একগাল হাসছেন মহিলারা।

কংগ্রেস প্রার্থী আবার বলছেন, “এই ভোট তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নয়, এটা রাহুল গান্ধী আর মোদীর ভোট। ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে মহিলারা মাসে আট হাজার টাকা করে পাবেন।” তৃণমূল প্রার্থীর পাল্টা মন্তব্য, “শুধু লক্ষ্মীর ভান্ডার নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উন্নয়নের যা জোয়ার রাজ্যে বইয়েছেন, তাতে সাফ হয়ে যাবে বাকিরা।”

সত্যিই কি তাই? গঙ্গাভাঙন ও বিড়ি শ্রমিকদের দুরবস্থা মালদহে ভোট-চর্চার বড় উপাদান। ফরাক্কা বিধানসভার নয়নসুখ গ্রামের দুঃখ কবে যে ঘুচবে, জানেন না গঙ্গার তীরে খাসজমির বাসিন্দা সৌমিত্র রজক, মঙ্গলী রজকেরা। নদীগর্ভে একটি বিদ্যুতের টাওয়ার দেখিয়ে সৌমিত্র বললেন, “ওখানে আমাদের ঘর ছিল। বর্ষায় ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা মারে গঙ্গার জল। ভয়ে ঘুমোতে পারি না।” বিড়ি বেঁধে সংসার চালান মঙ্গলী। তাঁর আক্ষেপ, “হাজার বিড়ি বেঁধে ১৭৫ টাকা পাই। দু’বছর ধরে মজুরি বাড়েনি।” পাশ থেকে এক যুবক বলেন, “সিপিএম চাপ দিয়ে মজুরি বাড়াত। এখন কে মালিকদের চাপ দেবে?” এখানেও কান পাতলে শোনা যাচ্ছে সেই ‘ভোট ঠিক করবে গেরাম’।

শ্রীরূপা বলছেন, “ডালুবাবুকে বলতে হবে উনি গঙ্গাভাঙন রুখতে কী করেছেন? আমি জিতলে মোদীজির থেকে ভাঙন-রোধে বিশেষ প্যাকেজ আদায় করব।” যদিও প্রশ্ন উঠেছে, এত দিন কেন্দ্র এই নিয়ে কী করেছে? ইশার পাল্টা, “বাবাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন বিরোধীরা। ভাঙন রুখতে বাবা ৩০০ কোটি টাকার কাজ করেছেন।” শাহনওয়াজের বক্তব্য, “যেটুকু হয়েছে, তা মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই।”

তৃণমূল প্রার্থী এর সঙ্গে যোগ করছেন ‘উন্নয়নের জোয়ার’কে। তাই তিনি প্রচারে বেরিয়ে কোনও ধর্মস্থানেও যাচ্ছেন না। এমনকি, যাননি মালদহের ‘রূপকার’ বরকত গনি খান চৌধুরীর মাজারেও। বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষো চলছে জেনেও শাহনওয়াজ বলেন, “আমি যদি ধর্মস্থানে গিয়ে প্রচার করি, তবে কোন মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলব?” তৃণমূল বিধায়ক সাবিনা ইয়াসমিনের বক্তব্য, “বরকত সাহেবের মৃত্যুর পরে ওই পরিবারের সেই প্রভাব আর নেই।”

আর আছে দলের অন্দরের ক্ষোভ। তৃণমূলের একাংশ শাহনওয়াজকে ‘বহিরাগত’ বলে খোঁচা দিচ্ছেন। বিজেপির অন্দরেও প্রার্থী নিয়ে ‘অসন্তোষ’ আছে। কিছু দিন আগে শ্রীরূপার নামে ‘নিখোঁজ’ পোস্টার পড়েছিল। কংগ্রেসের একাংশে ক্ষোভ, বার বার কেন একই পরিবার থেকে প্রার্থী হবে? দলের একাংশ মানছেন, বিধানসভায় দল শূন্য হয়ে যাওয়ায় সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ইশা অবশ্য সিপিএমকে পাশে পেয়ে ভরসা পাচ্ছেন। পোস্টার বিতর্ককে পাত্তা দিচ্ছেন না শ্রীরূপা। আর তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের দাবি, একশো শতাংশ কর্মী নেমেছেন প্রচারে।

আর শেষ কথা? সম্ভবত সেটা ‘গেরামই’ বলবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2024 Maldah Spot Reporting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy