Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

ভিক্টর-অঙ্ক হাসি আনবে কোন ঠোঁটে, অপেক্ষায় রায়গঞ্জ

কালিয়াগঞ্জে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে জেতা সৌমেন রায় যখন দল ছেড়ে তৃণমূলে যান, তখন বাজি ফাটান বিজেপি কর্মীরা। এ বার তাঁর বিজেপিতে ফেরার দিনে বাজি ফাটিয়েছে তৃণমূল।

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:০৫
Share: Save:

‘‘কৃষ্ণ কল্যাণীকে (বিজেপিতে থাকাকালীন) এক বার বলেছিলাম, ‘তুম মুঝসে দূর হো, লেকিন করিব হো দিলকে’ (তুমি আমার থেকে দূরে, কিন্তু হৃদয়ের কাছে),’’ স্মৃতিতে পিছু হাঁটেন উত্তর দিনাজপুরে তৃণমূলের এক মন্ত্রী। জুড়ছেন, ‘‘পরে কী হল, সবাই জানেন।’’

২০২১-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপির হয়ে রায়গঞ্জে জেতা কৃষ্ণ তৃণমূলের প্রার্থী। সে বছর ফরওয়ার্ড ব্লকের হয়ে চাকুলিয়ায় লড়ে তৃতীয় হন এ বারের বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী আলি ইমরান রম‌্জ (ভিক্টর)। তৃণমূল থেকে ২০২০-তে দলে যোগ দেওয়া কার্তিকচন্দ্র পাল প্রার্থী বিজেপির। রায়গঞ্জ লোকসভা আসনে কিসসা এই দল বদলের।

মাঠের পরে মাঠ ভুট্টার চাষ। সবুজ গাছের মাথায় কোথাও গেরুয়া-ঘেঁষা রং। রায়গঞ্জ আসনে রাজ্যের মধ্যে শতায়ু ভোটারের সংখ্যা বেশি। বিহার সীমানা ঘেঁষা গোয়ালপোখরের গ্রামে একশো এক বছরের আদিবাসী বৃদ্ধ জানাচ্ছেন, কান ভরসা জোগায় না। কাগজে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি দেখেছেন, তাঁর সম্পর্কে পড়েছেন। বলেন, ‘‘উনি ভাল কাজ করতে পারেন।’’ চোখে ছানির আস্তরণ আর এক সংখ্যালঘু শতায়ুর। লাঠি ঠুকে বুঝেছেন, ‘‘আগের থেকে রাস্তাঘাট অনেক ভাল। মমতাদিদি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বড়িয়া।’’ তাঁরা ভিক্টরের বাবা, গোয়ালপোখরের প্রয়াত বাম বিধায়ক রমজান আলিকে চেনেন। ভিক্টর কংগ্রেসে গিয়েছেন শুনে দু’জনেরই মন্তব্য, ‘‘কে যে কখন, কোন দলে!’’

গত লোকসভা ভোটে বিজেপি জেতে ৬০,৫৭৪ ভোটে। সব চেয়ে বেশি ‘লিড’ (৫৬,৭৬২) দিয়েছিল কালিয়াগঞ্জ। ‘‘তৃণমূল থেকে যখন বেরোই তখন রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় ছিল না। এখনও নেই,’’ অবস্থান স্পষ্ট করেন কালিয়াগঞ্জের প্রাক্তন পুরপ্রধান, বর্তমান পুরপ্রতিনিধি কার্তিক। বিধানসভা ভোট-উত্তর কালিয়াগঞ্জে বিজেপি খবরের শিরোনামে থেকেছে চাঁদগাঁওয়ের দৌলতে। গত বছর ২৬ এপ্রিল রাতে সেখানে বিজেপি নেতা বিষ্ণু বর্মণের খুড়তুতো ভাই মৃত্যুঞ্জয়কে গুলি করে মারায় অভিযুক্ত পুলিশ। পরিবার চায়, সিবিআই-তদন্ত। মামলা আদালতে। বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের কাছের সে গ্রামে বসে নিহতের বাবা রবীন্দ্রনাথ বর্মণ বলেন, ‘‘যখন ছেলেটা গেল, এলাকার বিধায়ক ছিলেন তৃণমূলে। তাদের পুলিশ...!’’ পুলিশ নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের দেখা মেলে দাড়িভিটেও।

কালিয়াগঞ্জে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে জেতা সৌমেন রায় যখন দল ছেড়ে তৃণমূলে যান, তখন বাজি ফাটান বিজেপি কর্মীরা। এ বার তাঁর বিজেপিতে ফেরার দিনে বাজি ফাটিয়েছে তৃণমূল। দলের প্রার্থীর সমর্থনে আয়োজিত সভায় যোগ দিয়ে বিজেপির লোকজনের ‘গো-ব্যাক’ স্লোগানের মুখেও পড়েন সৌমেন। তাঁকে বিজেপি ফেরাল কেন? দলীয় প্রার্থীর জবাব, ‘‘রাজ্য নেতৃত্ব বলতে পারবেন।’’

বিজেপি সম্প্রতি আর এক জনকেও দলে ফিরিয়েছে। প্রাক্তন জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ লাহিড়ী, যিনি দলের অন্দরে বর্তমান জেলা সভাপতি বাসুদেব সরকারের ‘বিপক্ষ’ শিবিরের বলে পরিচিত। বহিষ্কৃত হয়েও দলে ফিরলেন কী ভাবে? রায়গঞ্জ সদরে মুচকি হেসে বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘ভিক্টর ভোটের খরচ তোলার জন্য কিউ-আর কোডে জনতার সাহায্য নিচ্ছেন। এই সে দিন দেখলাম, বিজেপির এক ভোটার পঞ্চাশ টাকা পাঠালেন তাতে।’’ সমাজ মাধ্যমে বাসুদেবের ‘পোস্ট’ বলছে— ‘বিজেপি বাকি দলের চেয়ে আলাদা। ...আমরা পদস্খলিতকে সুযোগ দিই আত্মশুদ্ধিকরণের’। জেলায় বিজেপির রাজবংশী নেতাদের অন্যতম মুখ বলে এক সময় পরিচিত রূপক রায় এবং দ্বারিকনাথ বর্মণ নির্দল প্রার্থী এ বার। ওই দু’জন এবং কৃষ্ণের ক্ষেত্রেও কি সে ‘সুযোগ’ প্রযোজ্য?

সদ্য বিধায়ক পদ ছাড়া তৃণমূল প্রার্থী বলছেন, ‘‘বিজেপিতে ফেরত যাওয়ার প্রশ্ন নেই। কারণ, সম্মানের জন্য রাজনীতিতে আসা। বিজেপিতে তা পাইনি।’’ ব্যবসা-সূত্রে কালিয়াগঞ্জের সঙ্গে কৃষ্ণের যোগাযোগ বর্তমান। সেখানকার নেতা তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক অসীম ঘোষের প্রশংসা, ‘‘কোনও শিবিরের লোক নন। এটাই ওঁর প্লাস পয়েন্ট।’’

তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, দলের জেলা স্তরের এক নেতা প্রার্থী হতে না পারায় ইসলামপুর মহকুমার চার বিধানসভা— ইসলামপুর, গোয়ালপোখর, চাকুলিয়া, করণদিঘিতে তাঁর অনুগামীরা ‘বিষণ্ণ’। জেলা তৃণমূল সভাপতি কানাইয়ালাল আগরওয়াল বলছেন, ‘‘রায়গঞ্জ বিধানসভায় কৃষ্ণ লিড নিতে পারলে চিন্তা নেই। দলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তো সমস্যা নেই।’’ ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ আর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী প্রচারকে হাতিয়ার করে লড়াইতে নামা কৃষ্ণ-অনুগামীদের আশা, বিধানসভা ভোটে রায়গঞ্জে তৃণমূলের হয়ে কানাইয়ার পাওয়া ৫৯ হাজার ভোটের সঙ্গে কৃষ্ণের পাওয়া ৮০ হাজার ভোটের একাংশ জুড়বে। ২০১৯-এ বামফ্রন্টের মহম্মদ সেলিম আর কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সির মিলিত ভোট ছিল দু’লক্ষ ৬৫ হাজারের কিছু বেশি। ভিক্টর ‘অত’ পাবেন না।

তবে শুধু ‘তত্ত্ব-নির্ভরতা’ নয়, ভিক্টরের ‘কাছের লোক’, তাঁর মামা জেলা পরিষদে কংগ্রেসের টিকিটে জেতা জাভেদ আখতারকে সম্প্রতি দলে ফিরিয়েছে তৃণমূল। সে সূত্রে ভিক্টরের উপলব্ধি, ‘‘গয়রোঁ মে কাঁহা দম থা! মুঝে তো আপনোনে লুটা। মেরি কশতি ওঁহা ডুবি, জাঁহা পানি কম থা (অন্য লোকের কোথায় ক্ষমতা ছিল! আমাকে আপনজন লুটেছে। আমার নৌকো সেখানে ডুবল, যেখানে জল গভীর ছিল না)।’’

জেলা কংগ্রেস সভাপতি মোহিত সেনগুপ্তের দাবি, ‘‘মানুষ এমনিতেই আমাদের পাশে আছেন।’’ তবে ভিক্টরের কাকা, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী হাফিজ় আলম সৈরানি বলছেন, ‘‘বিজেপির আবেগের ভোটকে অস্বীকার করা যায় না।’’

সমাজমাধ্যমে ভিডিয়ো (আনন্দবাজার সত্যতা যাচাই করেনি) ছড়িয়েছে, বিজেপি প্রার্থীকে নিয়ে ভোট-প্রচারে বেরিয়ে গোয়ালপোখরে মন্ত্রী গোলাম রব্বানির ভাই, বিজেপির রাজ্য সংখ্যালঘু মোর্চার নেতা গোলাম সারওয়ার বলেছেন, ‘বিজেপির প্রার্থী পছন্দ না হলে ঘরের ছেলে ভিক্টরকে ভোট দেবেন’। ভিক্টরকে ফুলের মালা পরিয়ে, তাঁর হয়ে ভোট চেয়েছেন মন্ত্রীর আর এক ভাই গোলাম হায়দার। সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রীর ভাগ্নে, জেলার যুব তৃণমূল সহ সভাপতি নাফে হাবিব। মঙ্গলবার কংগ্রেসে যোগও দেন তাঁরা। মন্ত্রী রব্বানির হয়তো মনে পড়বে, কৃষ্ণকে বলা ‘শের’-এর বাকি অংশটুকু, ‘তুম অগর আও তো হাম মুসকুরা দেঙ্গে’ (যদি তুমি আস, তা হলে হাসি ফুটবে আমার)।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy