পুরীতে জগন্নাথ হেরিটেজ করিডর প্রকল্প। ছবি: পিটিআই।
“জয় শ্রী রাম!”
কানের কাছে বাজখাঁই দাবড়ানিতে খানিকটা চমকেই উঠেছিলাম। ঠাওর করে নিশ্চিত হওয়া গেল— আমি নই, হনুমানের মুখচ্ছবি আঁকা গেরুয়া পতাকা লাগানো ভারী বাইকের বিশালাকায় আরোহীর নিশানা পুরীর স্বর্গদ্বারে বিচ রোডের ধারের এক তরুণ দোকানদার। পায়ের ঠেকনায় ক্ষণিকের জন্য বাইক থামিয়ে ওড়িয়া ভাষায় নির্দেশ দিয়ে গেলেন বিশাল বপু, রামনবমীর মিছিলে ওই দোকানি যেন আগাগোড়া থাকেন। হাজিরা দিয়ে দোকানে ফিরে এলে অসুবিধা হতে পারে।
রোগাসোগা দোকানি কী করলেন? ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন? একেবারেই নয়। বরং গুন্ডি-পান চিবোতে চিবোতে চোখে চোখ রেখে সমানে তাকিয়ে রইলেন নির্দেশদাতার দিকে। বাইক যখন এগিয়ে যাচ্ছে, অস্ফুটে যে অপভাষাটি ছুড়ে দিলেন, বাংলা-হিন্দি-ওড়িয়া সবেতেই তা এক।
ভোটের হাওয়া পালে টানতে বিজেপি সারা দেশে রামমন্দির নির্মাণের সাফল্যের যে জয়ঢাক পেটাচ্ছে, ওড়িশা তার ব্যতিক্রম নয়। রামনবমী উপলক্ষে রাজ্য জুড়ে গেরুয়া বাহিনীর হল্লাবোলের ঢেউ আছড়ে পড়েছে শ্রীক্ষেত্র পুরীতেও। জানুয়ারির ২২ তারিখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যায় রামলালার মন্দিরটির উদ্বোধন করেন। তার ঠিক পাঁচ দিন আগে ১৭ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক উদ্বোধন করেছেন ৪ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ‘পরিক্রমা প্রকল্প’ ও ‘শ্রী সেতু’ সংযোগ। সঙ্গে আরও ২ হাজার কোটি টাকায় ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির, কোনার্কের সূর্য মন্দির, সম্বলপুরের সমলেশ্বরী, পুরীর গুন্ডিচা, রেমুনার ক্ষীরচোরা গোপীনাথ-সহ রাজ্যের প্রত্যেকটি প্রধান মন্দিরের সংস্কার কর্ম।
রাজনীতির মানুষ-জন বলছেন, এই পদক্ষেপ নবীনের মাস্টারস্ট্রোক। রাজ্যে বিজু জনতা দল সরকারের টানা পাঁচ বারের মুখ্যমন্ত্রী এই বর্ষীয়ান নেতা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ততটুকুই মাথা ঘামান, যতটা তাঁর রাজ্যের স্বার্থে প্রয়োজন। দিল্লির শাসককে চটালে রাজ্যের বরাদ্দ আটকে যেতে পারে, ইডি-সিবিআইয়ের দল ভুবনেশ্বরে উড়ে আসতে পারে— বিলক্ষণ জানেন নবীনবাবু। তাই সে পথে হাঁটেন না। আবার বিজেপির কৌশল আঁচ করে নীরবে ঘর গুছিয়ে নিতেও ছাড়েন না। পুরীর জগন্নাথ মন্দির-সহ ওড়িশার মন্দিরগুলির এমন ঢালাও সংস্কারের প্রভাব যে সুদূর অযোধ্যায় মসজিদ ভেঙে রামের নতুন মন্দির গড়ার চেয়ে বহু গুণ বেশি, ভোটের হাওয়া দিব্যি জানান দিচ্ছে।
তার পরেও কিন্তু বিজেপিকে আক্রমণে আপাত উদাসীন নবীনবাবু। হিন্দুত্বের বর্মেই কি তিনি হিন্দুত্বের আক্রমণ মোকাবিলা করছেন না? এই প্রশ্নের বিনয়ী জবাব পরিপাটি শুভ্র পোশাকের পরিশীলিত মুখ্যমন্ত্রীর— ‘‘আমার সরকার পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। কিন্তু হাজার হাজার বছরের প্রাচীন মন্দিরগুলি তো শুধু ধর্মস্থান নয়, ওড়িয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভূষণ। প্রতিটি মন্দির ওই এলাকার অর্থনীতির চাকা। জগন্নাথের কৃপা যে আমি মন্দির সংস্কারের সুযোগটি পেয়েছি।’’ মুখ্যমন্ত্রীর এই নম্র ‘ওড়িয়া অস্মিতার’ সঙ্গে ছাতি ফুলিয়ে হিন্দুত্বের আস্ফালনের সর্বাংশেই অমিল। ভোটারদের একটা বড় অংশের শ্রদ্ধা কুড়োচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর এই স্বভাব-বিনয়।
ওড়িশায় এ বারেও বিধানসভা ও লোকসভার ভোট হচ্ছে এক সঙ্গে। গত বছর পুরী লোকসভা আসনে সাত বিধানসভা কেন্দ্রের সম্মিলিত ফলাফলে বিজেপির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্র বিজেডির প্রার্থী পিনাকী মিশ্রের কাছে মাত্র ১১,৭১৪ ভোটে পরাজিত হন। কিন্তু পুরী বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির জয়ন্ত ষড়ঙ্গী ৪ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন বিজেডি প্রার্থী টানা পাঁচ বারের প্রভাবশালী বিধায়ক মহেশ্বর মহান্তিকে।
এ বার পুরী লোকসভা কেন্দ্রে সম্বিত পাত্রের লড়াই বিজেডির অরূপ পট্টনায়কের সঙ্গে। গত বার ভুবনেশ্বর লোকসভা কেন্দ্রে পরাজিত অরূপ প্রাথমিক ভাবে একটু পিছিয়ে রয়েছেন বলেই অনেকে মনে করছেন। কিন্তু নবীনের মন্দির কার্ডে বিধানসভায় অবশ্যই এগিয়ে প্রয়াত মহেশ্বর মহান্তির পুত্র বিজেডি প্রার্থী সুনীল।
বেলা ১০টা ১০-এ পাণ্ডাপাড়ায় বিজেপি বিধায়ক জয়ন্ত ওরফে লিলু ষড়ঙ্গীর একতলার বৈঠকখানায় জনা কুড়ি দর্শনার্থী। মিনিট পাঁচেক পরে দোতলা থেকে নেমে এলেন বিধায়ক। পরণে আধময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি, মিসকালো হাফপ্যান্ট। দু’পায়ে মোজা-ছাড়া ঘিয়ে রঙের ব্র্যান্ডেড স্নিকার। স্নান সেরে এত ক্ষণ যে চুলে কলপ করছিলেন, তার কলঙ্করেখা গেঞ্জির কাঁধে-পিঠে। ঘরে ঢুকতেই গণ্ডা তিনেক হাত এগিয়ে গেল চরণ নিশানা করে। ছোট্ট লাফে সেগুলি এড়িয়ে বিধায়ক লিলু প্রতিবেদককে নিয়ে ফের চললেন সিঁড়ি দিয়ে উপরে। সেখানে বসে নানা হতাশার ক্ষরণ। সাফ কথা— পাঁচ বছরে কিচ্ছুটি করে উঠতে পারেননি পুরীর জন্য। মোদীর বক্তৃতা ছাড়া তাঁর হাতে আছেটাই বা কী! অসৎ হলে তিনি তো মন্দিরের প্রকল্প সুষ্ঠু ভাবে হওয়ার সব সাফল্য নিজের বলে দেখাতে পারতেন। কিন্তু সেটা করছেন না। মন্দির প্রকল্পে অনেক কেলেঙ্কারির খবর তিনি রাখেন, কিন্তু জগন্নাথ দেবের কাজ বলে বাগড়া দেননি।
পুরীতে বিজেপির সংগঠন দুর্বল। পর্যটনকেন্দ্র এই শহরে মানুষ ‘নগদ নারায়ণ’ বোঝেন। তিনি নেতৃত্বকে বলেছিলেন, কর্মীদের জন্য নগদ বিলির ব্যবস্থা না করলে, কেউ বিজেপি করবে না। নেতৃত্ব কান দেয়নি। প্রতিপক্ষ বিজেডির হাতে প্রশাসন। রাজ্য সরকার নানা প্রকল্পের উপকার পৌঁছে দিচ্ছে মানুষের কাছে। স্বচ্ছসাথী, শিক্ষা সাথী, স্বনির্ভর প্রকল্পে গরিব মানুষের নাম তোলা হয়েছে। দুর্নীতি হলেও তাঁরা টাকা পাচ্ছেন হাতে হাতে। বিধায়কের আক্ষেপ, বিজেপির দোকানে শুধু বক্তৃতাই মেলে। বিধানসভায় মানুষ কেন বিজেপিকে ভোট দেবেন?
আর লোকসভা ভোটে? বিধায়কের জবাব, “লোকসভার বিষয়টা আলাদা। সেখানে নবীনবাবুও নরেন্দ্র মোদীর বন্ধু। মানুষ তাই সম্বিত পাত্রকে ভোট দেবেন। তিনি জিতেও যেতে পারেন। কিন্তু আমাকে কেন ভোট দেবে বলতে পারেন?” (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy