—প্রতীকী ছবি।
গঙ্গার বুকে বিস্তীর্ণ চর। নদীর স্রোতকে দু’পাশে রেখে এগিয়ে গিয়েছে বহু দূর। তারও পশ্চিমে নদীর গা ঘেঁষে মাইলের পর মাইল ফাঁকা জমি। এই জায়গাকে বলে দিয়ারা।
গরমের শুরুতে দিয়ারায় ফসল ফলিয়েছেন কৃষকেরা। বেড়ে উঠেছে ভুট্টার গাছ। গমের খেত আপাতত সোনালি। ফসল ঘরে তোলার অপেক্ষায় কৃষক।
ভোর তখনও হয়নি। নির্জন গঙ্গার বুকে শেষ রাতের অন্ধকার কাটেনি। মিরকাসিমের কেল্লার দিক থেকে একটি নৌকা এগিয়ে চলেছে দিয়ারার দিকে। কেল্লার পশ্চিম দিক ধরে বইছে নদীর মূল ধারা। তার আরও পশ্চিমে দিয়ারা। আকাশের নীচে, রাতের অন্ধকারে যা ডুবে রয়েছে।
ছোট্ট নৌকাটি দ্রুত নদীর কিনারায় এসে পৌঁছয়। মুহূর্ত অপেক্ষা না করে জমিতে লাফিয়ে নামে পুলিশ। খবর আগেই ছিল। খেতের মধ্যে টাঙানো তাঁবুতে হানা দিতে তাই সময় নষ্ট হয় না। তাঁবুর ভিতরে থাকা তিনটি মানুষ তখন টের পেয়ে গিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত লোকজনের উপস্থিতি। রাতের অন্ধকারে গমের খেত মাড়িয়ে ছুটে পালাতে চায় তারা। পুলিশের দল আগে থেকেই ঘিরে রেখেছিল এলাকাটা। ধরা পড়ে যায় দু’জন। আর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু ভুট্টার খেতের আড়ালে সেঁধিয়ে গিয়ে কোথায় হারিয়ে যায় তৃতীয় ব্যক্তি।
সীতাচরণ দিয়ারায় সেই তাঁবুর মধ্যে মেলে মিনি গান ফ্যাক্টরির সন্ধান। পাওয়া যায় দেশি পিস্তল, গুলি, বেস মেশিন, ড্রিল মেশিন, পিস্তলের নানান যন্ত্রাংশ আর আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির হাজার উপকরণ। ঘটনাটা বেশি দিনের নয়। চলতি মাসেরই ২ তারিখের। গ্রেফতার হওয়া দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, এক জনের নাম মহম্মদ ঔরঙ্গজেব ওরফে চাঁদ আর অন্য জন মহম্মদ জাহাঙ্গির। দু’জনেরই বাড়ি বিহারের মুঙ্গের জেলায়।
জিজ্ঞাসাবাদ দীর্ঘ। পুলিশের দাবি, জেরায় ঔরঙ্গজেব আর জাহাঙ্গির জানিয়েছে, তারা আসলে পিস্তল তৈরির কারিগর। অন্যের হয়ে কাজ করতে দিয়ারায় এসে থাকছিল। আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির যাবতীয় উপকরণ তারা পেয়েছে মুঙ্গেরেরই বাসিন্দা সতোজ যাদবের কাছ থেকে। প্রতিটি পিস্তল তৈরির জন্য তাদের ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। বন্দুক তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে সেগুলি নিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেওয়া হত বলেও জানিয়েছে ধৃতেরা। জেরার মুখে ঔরঙ্গজেব আর জাহাঙ্গির পুলিশকে বলে, সতোজ অনেক দিন থেকেই এই ধরনের কাজ করছে। এর পরেই মুঙ্গেরের মুফসিল থানা এলাকায় সতোজের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। গ্রেফতার করে তাকে। দেখা যায়, সতোজের নামে আগে থেকেই অপরাধের লম্বা তালিকা তৈরি রয়েছে।
বিহারের ঐতিহাসিক শহর মুঙ্গেরে ঔরঙ্গজেব, জাহাঙ্গিরদের কাজকারবার কিংবা তাদের গ্রেফতারি অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয়। সারা বছর শুধু বাংলা নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে চোরাপথে অবৈধ অস্ত্র পৌঁছে যায় এই মুঙ্গের থেকেই। তাই দুর্গাপুজোর আগে যে ভাবে জেগে ওঠে কুমোরটুলি, ভোটের আগে তেমন কোনও প্রস্তুতি নিচ্ছে না কি বিহারের এই জনপদ, সেকথা জানার খুব কৌতূহল ছিল। কারণ, কিছু দিন পর থেকেই শুরু হতে যাওয়া ভোট উৎসবে বন্দুকের নলকেই শক্তির উৎস করতে বিহার-বাংলা-উত্তরপ্রদেশের গ্রামেগঞ্জে, পাড়ায় পাড়ায় অপেক্ষায় রয়েছেন যাঁরা— তাঁদের হাতে অস্ত্রের জোগান তো এখান থেকেই!
মিরকাসিমের কেল্লার ভিতরেই নিজের বাংলোয় বসে এই ধরনের বিশেষ প্রস্তুতির কথাটা অবশ্য উড়িয়ে দিলেন মুঙ্গেরের পুলিশ সুপার সৈয়দ ইমরান মাসুদ। ঝকঝকে তরুণ আইপিএস অফিসার। এই বয়সেই দায়িত্ব সামলে এসেছেন বিহারের দুর্দান্ত অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলিতে। আপাতত মুঙ্গেরের অবৈধ অস্ত্রের কাজকারবার আটকানোর দায়িত্ব তাঁরই কাঁধে। বললেন, ‘‘দেখুন, ভোটের সময় এই ধরনের বেআইনি অস্ত্রের ডিমান্ড থাকেই। তবে আমার মনে হয়, মুঙ্গেরে সারা বছর ধরেই ব্যাপারটা চলতে থাকে। আর আমরাও চেষ্টা চালিয়ে যাই মিনি গান ফ্যাক্টরিগুলি খুঁজে বার করতে। বছরের সব সময়েই পুলিশ এসব উদ্ধার করছে।’’
তবে মুঙ্গের পুলিশ গত ছ’মাসে গোটা এলাকায় যত অস্ত্র কারখানা খুঁজে বার করেছে, সেই হিসাব অবশ্য বলছে, তৎপরতা বেড়ে গিয়েছে ভোটের হাওয়ায়। যেমন, গত বছরে সব মিলিয়ে ৩০টির মতো মিনি গান ফ্যাক্টরির সন্ধান মিললেও এই মার্চেই ছ’টি জায়গার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। আর তাতে দেখা যাচ্ছে— গঙ্গার নির্জন দিয়ারাতেই শুধু নয়, গ্রামের গৃহস্থের ঘরের আড়ালেও গজিয়ে উঠেছে অস্ত্র কারখানা। পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘আগে গ্রামে গ্রামে অস্ত্র কারখানার খোঁজ মিলত। তবে পুলিশের তৎপরতায় সেটা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন বেশি মিলছে দিয়ারা এলাকা থেকে। আর পাওয়া যচ্ছে পাহাড়ের নীচে, জঙ্গলেরনির্জন এলাকায়।’’
মুঙ্গেরের দিয়ারা এলাকাটা ৩০-৩৫ কিলোমিটার বিস্তৃত। বর্ষায় গোটা জায়গাটাই জলের তলায়। তারপর ধীরে ধীরে জেগে ওঠে একসময়। সেই সময় থেকেই ফসল ফলানোর তোড়জোড়। গম গাছের সবুজ নরম শরীরে খেলে যায় নদীর বাতাস, বেড়ে যায় চাষিদের আনাগোনা। খোলা মাঠের ভিতরে টাঙানো হয় তাঁবু। আর চাষিদের পাশাপাশি কোথা থেকে যেন এসে পড়ে বন্দুক তৈরির কারিগরেরাও। ভুট্টা গাছের খেত যত উঁচু হয়, ততই বাড়তে থাকে লুকিয়ে কাজ করার নিশ্চয়তা।
গঙ্গার দিয়ারা বাদ দিলে বেআইনি অস্ত্র তৈরি ও বিক্রির অন্য আঁতুড়ঘরটি রয়েছে পাহাড়, জঙ্গল ঘেরা বিহারের লখিসরাই আর জামুই জেলার কাছে। মুঙ্গের, লখিসরাই কিংবা জামুই— তিনটি জেলাই মাওবাদী প্রভাবিত। ঝাড়খণ্ডের সীমানায় নির্জন বনভূমিতে যাতায়াতের অসুবিধা। সেই সুযোগ নিয়েই এখানে বেআইনি অস্ত্র কারখানার রমরমা। যদিও অন্ধকার জগতের এই ব্যবসা এখন শুধু মুঙ্গের নয়, ছড়িয়ে পড়েছে বিহারের অন্য জেলাগুলিতেও। এমনকি, অন্য রাজ্যেও!
তবে সব বদনাম কেন শুধু মুঙ্গেরেরই হবে? তার পিছনে অবশ্য রয়ে গিয়েছে অন্য ইতিহাস। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy