প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
দোকানে সে দিন কেনাকাটায় মন্দাই ছিল। তা ছাড়া, বিকেল তিনটেয় কে-ই বা আর জামা কিনতে আসে! চোখটা তাই একটু লেগে এসেছিল হেলাল আহমেদ শেখের।
“একটা বিকট আওয়াজে চটকা ভাঙল। প্রথমে ভাবলাম টায়ার ফেটেছে হাইওয়েতে। তার পরেই দেখি দোকানের কাচ চোখের সামনে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। স্রেফ ওই আওয়াজের কম্পনে। এরপর শুধুই ধামাকা। কান চাপা দিয়ে দোকানের কোণে বসেছিলাম কত ক্ষণ, আজ আর মনে নেই। তবে এটুকু জানি ওই এক বিকেলের ঘটনা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে।”
বিলক্ষণ বদলেছে হেলালদের জীবন, সেই সঙ্গে গত লোকসভা ভোটের ভবিতব্যও। আগেও কিছু নেই, পরেও নয়, পুলওয়ামার এই অঞ্চল বিশ্বকুখ্যাত হয়েছিল শুধুমাত্র ২০১৯-এর ১৪ ফেব্রুয়ারির বিকেলটির জন্য।
অবন্তীপুরা শহরের কাছে লেথিপোরায় পৌঁছেছি। যেখান থেকে জাতীয় সড়ক ঢিল ছোড়া দূরত্বের চেয়ে সামান্য বেশি। ঠিক যেখানে সিআরপিএফ জওয়ান ভরা ৭৮ গাড়ির কনভয়ে সাড়ে তিনশো কিলোগ্রাম বিস্ফোরক ভরা এসইউভি এসে ধাক্কা মেরেছিল। নিমেষে প্রাণ হারান ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান। অভিঘাতে জাতীয় সড়ক পেরিয়ে হেলালদের মতো বহু দোকান আর বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়।
হেলাল আহমেদের জামাকাপড়ের এই দোকানটি আবার মেরামত হয়েছে, আগের কোনও চিহ্ন নেই। কিন্তু বদলে গিয়েছে এলাকার চিত্রপট। সে দিন থেকে আজ পর্যন্ত, গত পাঁচ বছর এই সাদামাটা দোকানপাট আর ক্ষয়াটে পাথর ও কাঠের বাড়িওয়ালা অঞ্চলটি কার্যত সেনা দুর্গে পরিণত। হেলাল বলছেন, “আমরা যেন নরকে ডুবে যাই। বহু দিন বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন, জল নেই, রাস্তা বন্ধ, খাবার জোগাড় নেই, চার দিকে শুধুই সেনা প্রহরা।”
কিন্তু এটাও তো ঠিক এই জায়গাকে কে আর চিনত? আজ সবাই এক কথায় নাম জানে। এতে কি লাভ হল না কিছুটা? ক্ষতিই হয়েছে, জানাচ্ছে আশপাশ থেকে আসা ছোট্ট জটলাটি। ভিড়ের এক নাম না জানা কণ্ঠ জানায়, ‘‘এখানে পাহারা এত বেড়ে গিয়েছে আর ঘন ঘন কনভয়ের যাতায়াত, আমাদের জাতীয় সড়ক ব্যবহার করাই দায়। সেনা যাতায়াতের সময় দিনে পাঁচ বার অন্তত রাস্তা আটকে রাখে, বাচ্চারা পরীক্ষা দিতে যেতে যাওয়ার সময় যে কী মুশকিল হয় তা বলার নয়।”
অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নয়, নিজেই টের পেয়েছি এখানে এসে। ৪৫ মিনিটের বেশি গাড়ি রাখা যাবে না, সেনার এই কড়ারে মহল্লায় ঢুকে। তবে হেলালরা যাই বলুন, জাতীয় সড়কের ধারে কিন্তু বেশ কিছু শুকনো ফলের দোকান নতুন খুলেছে, হামলাস্থলের এক আধ কিলোমিটার আগে-পরে। এটা কি সন্ত্রাস-পর্যটন? মানুষ গত পাঁচ বছর কি বেশি এসেছেন পুলওয়ামার নাম ছড়িয়ে পড়ার পরে? স্থানীয় বাসিন্দা নিসার আহমেদ অবশ্য জানাচ্ছেন, সে রকম কিছু নয়। এই সড়ক এমনিতেই খুবই ব্যস্ত শ্রীনগর থেকে জম্মু যাওয়ার পথ হিসেবে। তাই যখন যে যে ভাবে পারেন, শুকনো কিসমিস আর কেশরের পসরা খুলে বসে গিয়েছেন। কিন্তু লেথপুরার দু’দিকে যে আধা মফস্সল গ্রাম, তাদের অবস্থার কোনও বদল ঘটেনি।
ভোটের প্রসঙ্গ পাড়তে নিসারের কথায়, "আমাদের এক জন নেতা না থাকাটা বড়ই অসুবিধার। সুপারিশ করার মতো কেউ নেই গত দশ বছরে। কাউকে ঝুটমুট রাতবিরেতে পুলিশ তুলে নিয়ে গেল, আমরা ভেবে পাই না কার কাছে যাব সুপারিশের জন্য। থানায় তো আমাদের কথা শোনে না।" তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, "এখানে কবে ভোট হবে, আপনাদের কাছে কোনও খবর আছে? দিল্লির নয়, আমাদের ভোট।"
দেড়শো কিলোমিটার দূরে রামবনে পাওয়া গিয়েছে লিথিয়ামের খনি। শুরু হয়েছে তার নিলাম। নিসারের পাশ থেকে এক যুবকের বক্তব্য, "৩৭০ তুলে নেওয়ায় এখন তো বাইরে যে কেউ এখানে জমি কিনে তাদের রাজ্য থেকে লোক আনাতে পারবে। শুনছি মহারাষ্ট্র থেকে অনেকে আসছে এই লিথিয়াম ব্যাটারির ব্যবসায় কাজের জন্য।"
তবে নিজেদের বিধায়ক এলেই যে সব সুরাহা, এই তত্ত্বের বিরোধিতাও করছে স্থানীয় মানুষের একাংশ। ফলের দোকানের প্রবীণ মালিক নাজমল হোসেন যেমন। বলছেন, "সব রাজনৈতিক দলই এখানে নিজেরটা দেখেছে, তা সে পিডিপি-ই হোক বা এনসি। আমজনতার কথা শুধু মনে পড়ত ভোটের আগে। এনসি-র মাসুদি ছিলেন এখানকার বিধায়ক, ২০১৪-র আগে। একই মহল্লায় বেছে বেছে নিজের দলের কর্মীদের বাড়ি টিউব ওয়েল বসাতেন সরকারের টাকায়। আমরা কোনও দলের সঙ্গে নেই, তাই আজও পাইনি।"
আমার বাহন-চালক অনেক ক্ষণ এসে তাগাদা দিচ্ছেন। সময় শেষ, জলপাই পোশাক এসে তাঁর উপর তম্বি করছে। এ বার গাড়ি নিয়ে মহল্লা ছাড়তে হবে। আশপাশে সর্ষে খেত, বাড়ির চালগুলোতে সশস্ত্র সিআরপিএফ। মাছির ওড়ার প্রতিও নজর রাখছেন তাঁরা, অতন্দ্র। অথচ সন্ত্রাসবাদ দূরস্থান, সেই একটি বিকেল ছাড়া সাম্প্রতিক ইতিহাসে লেথপুরায় বড় কোনও ডাকাতি, রাহাজানির গল্পও নেই, এতটাই নিস্তরঙ্গ জীবন এখানে।
সেনার এই সতর্ক জলপাইরঙা শাসনের মধ্যেই দু’পাশের আপেল উইলো গাছগুলোয় এ বার পাতা আসবে। ইস্কল যাওয়ার পথে থমকে দাঁড়াতে হবে শিশুদের। একটি টিউবওয়েল বসানোর স্বপ্ন নিয়ে লোকসভা ভোট দিতে যাবেন পুলওয়ামাবাসী। মনে মনে প্রার্থনা করবেন, ওই বিকেল যেন আর কখনও ফিরে না আসে। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy