অরুণ যোগীরাজের কর্মশালায় চলছে মূর্তি তৈরির কাজ। —নিজস্ব চিত্র।
এ দিকে কেদারনাথের আদি শঙ্করাচার্যের মূর্তির ছোট্ট প্রতিরূপ। অন্য দিকে ইন্ডিয়া গেটে সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তির ফাইবারের মডেল। এক পাশে ছত্রপতি শিবাজির সিংহাসনে বসা মূর্তিতে শেষ ছোঁয়ার কাজ চলছে। আরেক পাশে পাথর কেটে ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠছেন তিরুপতির বালাজি।
মাইসুরুর গঙ্গোত্রী নামের মহল্লায় গাছগাছালি ঘেরা রাস্তা। কালো কাপড়ে ঢাকা ফটকের বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, ভিতরে বিশ্বকর্মার কর্মকাণ্ড চলছে। এক বার ঢুকে পড়তে পারলেই চক্ষু চড়কগাছ! চার দিকে আশ্চর্য সব পাথরের মূর্তিতে নিপুণ শিল্পকলার প্রমাণ। আর তার মাঝখানে বিশাল মাপের এক কালো পাথরের বেদী। তাতে দশাবতারের ছোট্ট ছোট্ট মূর্তি খোদাই করা। সঙ্গে অপূর্ব কারুকার্য। তবে তার ছবি তোলার অনুমতি নেই।
কেন? অযোধ্যায় রামমন্দিরে নরেন্দ্র মোদী যে রামলালার মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন, এই বেদীর উপরেই সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সেই রামলালার মূর্তির ভাস্কর অরুণ যোগীরাজের কর্মশালা। হাতে হাতুড়ি, ছেনি নিয়ে পাথরে প্রাণ দিতে ব্যস্ত অরুণের ভাই যশবন্ত শিবশঙ্কর। সঙ্গে আরও দশ-পনেরো জন শিল্পী। মাইসুরুর এই কর্মশালাতেই রামলালার মূর্তির নীল নকশা তৈরি হয়েছিল। তার পরে অযোধ্যায় বসে অরুণ রামলালার মূর্তি তৈরি করেছিলেন। রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রামলালার মূর্তি ধাতব বেদীতে অধিষ্ঠিত হবে। পাথরের বেদীখানা তাই অরুণ যোগীরাজ মাইসুরুতে নিজের এই কর্মশালায় এনে রেখেছেন।
মাইসুরু-সহ গোটা কর্নাটকের মানুষ গর্ব করে বলেন, এ রাজ্যের শিল্পী অরুণ যোগীরাজ অযোধ্যায় রামলালার মূর্তি তৈরি করেছেন। সেই মূর্তি যে পাথরে তৈরি, সেই কৃষ্ণশিলা নামের গ্রানাইট পাথরও কর্নাটকের পাথর খাদান থেকে তুলে আনা। কিন্তু গোটা রাজ্য ঘুরে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করুন, লোকসভা নির্বাচনে কর্নাটকে বিজেপি কি রামমন্দির নির্মাণ থেকে ফায়দা তুলতে পারবে? কেউ তাতে সায় দেবে না। এমনকি বিজেপি নেতারাও মেনে নেবেন, কর্নাটকে তাঁরা রামমন্দিরের কোনও সুফল আশা করছেন না।
দক্ষিণ ভারতে বিজেপির আদি ঘাঁটি কর্নাটকে কি রামমন্দিরের কোনও প্রভাব নেই? কর্নাটক বিজেপির রাজ্য কর্মসমিতির সদস্য এম এইচ শ্রীধর প্রশ্ন শুনেই আপত্তি তোলেন। “হতে পারে কর্নাটকের শিল্পী অরুণ যোগীরাজ রামলালার মূর্তি তৈরি করেছেন। হতে পারে এ রাজ্যের কৃষ্ণশিলা পাথরেই রামলালার মূর্তি তৈরি হয়েছে। তবে তা থেকে আমরা কোনও রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করিনি। অরুণ যোগীরাজের রামলালার মূর্তি নিজের শিল্পগুণে অযোধ্যার মন্দিরের জন্য বাছাই হয়েছে। আমরা এ নিয়ে রাজনৈতিক প্রচার করছি না।”
শুধু অযোধ্যা নয়। কেদারনাথে ১২ ফুটের আদি শঙ্করাচার্যের মূর্তি, ইন্ডিয়া গেটে ৩০ ফুটের সুভাষচন্দ্রের মূর্তি, মাইসুরুর হার্ডিঞ্জ সার্কলে জয়চামরাজেন্দ্র ওয়াডিয়ারের মূর্তি বা রামকৃষ্ণনগরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মূর্তি— সবই অরুণ যোগীরাজের তৈরি। রামলালার মূর্তি তৈরির পরে ফের তাঁর ডাক পড়েছে রামমন্দিরের দোতলায় অন্যান্য মূর্তি তৈরির জন্য। তাঁর খুড়তুতো ভাই যশবন্ত বলছিলেন, “আমাদের ঠাকুর্দা বাসবান্না মাইসুরুর রাজপ্রাসাদের গুরু সিদ্ধান্তি সিদ্ধলীলা স্বামীর কাছে মূর্তি গড়া শিখেছিলেন। রাজপ্রাসাদের গায়ত্রী মন্দিরে তাঁর কাজে মুগ্ধ রাজা সোনার ছেনি, রূপোর হাতুড়ি উপহার দেন। তাঁর ছেলে বি এস যোগীরাজও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী। অরুণ এমবিএ পাশ করেও আমাদের পারিবারিক শিল্পকলার কাজে জড়িয়ে পড়েছে। রামলালার মূর্তি অযোধ্যায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে এখন গোটা দেশ অরুণের নাম জানে।”
এমন সুযোগ পেয়ে বিজেপি ছেড়ে দিল? রামমন্দির থেকে কর্নাটকে ফায়দা তোলার চেষ্টা করল না? কর্নাটকে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের নেতারা মুচকি হাসেন। বিজেপি কি আর একেবারেই ফায়দা তোলার চেষ্টা করেনি! আলবাত করেছে। গত বছর বিধানসভা ভোটে হেরে যাওয়ার আগে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই ঘোষণা করেছিলেন, কর্নাটকের রামনগরে রামমন্দির তৈরি হবে। সেখানে বনবাসের সময়ে রাম ছিলেন বলে মানুষের বিশ্বাস। কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেই পাল্টা চাল দিয়েছে। সিদ্দারামাইয়া সরকার ঘোষণা করেছে, কর্নাটকে যত রামের মন্দির রয়েছে, তার সংস্কারে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। নতুন রামমন্দিরের জবাবে পুরনো রামমন্দিরের সংস্কার!
কর্নাটকের কংগ্রেস নেতা কৃষ্ণ বায়র গৌড়া বলেন, “আসলে গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনের সময়েই নরেন্দ্র মোদী টের পেয়েছিলেন, উগ্র হিন্দুত্বে লাভ হচ্ছে না। উনি হাম্পিতে গিয়ে বলেছিলেন, কংগ্রেস বজরং দলকে নিষিদ্ধ করতে চেয়ে জয় বজরংবলীর ভক্তদের নিষিদ্ধ করতে চাইছে। হাম্পির অঞ্জানাদ্রী পাহাড় হনুমানের জন্মস্থান বলে মানুষের বিশ্বাস। তার পরেও বিজেপি হেরেছে। লোকসভা ভোটে বিজেপি তাই আর এ রাজ্যে রামমন্দিরের ধুয়ো তোলেনি।”
রাজনীতিকে পাঁচিলের বাইরে রেখে অরুণের কর্মশালায় পাথর ছেনে মূর্তি গড়ার কাজ চলতে থাকে। ছাই রঙা গ্রানাইট পাথরের মূর্তি তৈরির শেষে নারকেল পুড়িয়ে তৈরি কালি ও নারকেল তেল মাখানো হয়। ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে কৃষ্ণশিলার আসল রূপ। রামলালার মূর্তির রঙের মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy