E-Paper

যে পক্ষই জিতুক, শান্তি চায় পাহাড়

পাহাড়ের মানুষই বলে দিচ্ছেন, ১৯৮৬ সাল থেকে পাহাড় কোনও একক নেতার হাতে থেকেছে। প্রথমে সুবাস ঘিসিং, তার পরে বিমল গুরুং।

—প্রতীকী ছবি।

কৌশিক চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:৪২
Share
Save

মা এবং ভাইকে নিয়ে ম্যাল চৌরাস্তার কোণে চা বিক্রি করেন জহর বস্তির দীপিকা রাই। গত কয়েক দিন দুপুর থেকেই দার্জিলিঙে শিলাবৃষ্টি। ম্যালে গুটিকয়েক লোককে নিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন দার্জিলিং লোকসভার নির্দল প্রার্থী বন্দনা রাই। আবহাওয়ার কারণে কিছুটা মন্দা ব্যবসায়। দীপিকা বলছেন, “ছোটবেলা থেকে দার্জিলিঙের আবহাওয়া অবাক করা। কখনও মেঘ, কখনও রোদ। ভোটের উৎসবও পাহাড়ে তাই। এখন এ, তখন সে। পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ যাঁর, তিনি জমিদার।’’ ফুটখানেক দূরে দাঁড়িয়ে দীপিকার বৃদ্ধা মা মনমায়া বললেন, ‘‘ভোট দিয়ে কী হবে! চা-ই বিক্রি করতে হবে। রাজার নিয়ন্ত্রণেই থাকতে হবে। তবে শান্তি থাক,
পর্যটক আসুক।’’

মনমায়ার মতোই যেন পাহাড়েও এ বারে ভোট নিয়ে মাতামাতি কম। সমতলের মতো নিয়মিত মিছিল, মিটিং, সভা, পথসভা থেকে দেওয়াল লিখন, পোস্টার— কার্যত কিছুই নেই। পুলবাজার বিজনবাড়ি বাজারে তিনতলা হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্তার সভা শুনছিলেন আশিস গুরুং। বললেন, ‘‘বছর বছর সবাই প্রতিশ্রুতিই দেয়। গোর্খাদের কিছু হয় না।’’ একটু থেমে বললেন, ‘‘আমাদের শান্তি চাই। পুরনো ইতিহাস মনে করতে চাই না।’’

সোনাদা বাজারে তৃণমূল প্রার্থী গোপাল লামার প্রচার দেখছিলেন মুদির দোকানদার বিজয় থাপা। বিজয়ের দাবি, ‘‘ভূমিপুত্র নেতারা সবাই।’’ জুড়ে দেন, ‘‘সুবাস ঘিসিং থেকে বিমল গুরুং হয়ে অনীত থাপা— আসলে সবারই কর্তৃত্ব কায়েম রাখার লড়াই।’’ তাঁরও সেই এক কথা, ‘‘আসল হল পাহাড়ের শান্তি। তা হলেই সব ঠিক।’’

শান্তি চাই তো বটে, কিন্তু কর্তৃত্ব কায়েমের লড়াইটা কী?

পাহাড়ের মানুষই বলে দিচ্ছেন, ১৯৮৬ সাল থেকে পাহাড় কোনও একক নেতার হাতে থেকেছে। প্রথমে সুবাস ঘিসিং, তার পরে বিমল গুরুং। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পরে সেই ছবি বদলে গিয়েছে। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে তিনটি আসন কোনও এক পক্ষের হাতে থাকেনি। বরং ভোট কাটাকাটিতে বিজেপির প্রার্থীরা দু’টি আসন জিতে নিয়েছেন বলে বিরোধীদের দাবি। একই সঙ্গে গত দু’বছরে আরও একাধিক নির্বাচন দেখেছে পাহাড়। পুরভোট, জিটিএ এবং পঞ্চায়েত ভোট। এ বারে দুয়ারে লোকসভা ভোট। আর আগের অভিজ্ঞতা থেকে পাহাড়বাসীর দাবি, যতই সমতলে চারটি বিধানসভা থাকুক না কেন এই কেন্দ্রে, কিন্তু পাহাড়ের প্রভাব যথেষ্ট। এই সব আলোচনার মধ্যেই তাঁরা দেখিয়ে দিচ্ছেন, ‘বহুদলীয়’ লড়াইয়ে পাহাড়ে সবাই এখন চেষ্টা করছেন কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণের। কী ভাবে?

অনীত থাপা যেমন শাসক দল তৃণমূলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে প্রাক্তন আমলা গোপাল লামাকে প্রার্থী করে পাহাড়ে নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে চাইছেন। জিএনএলএফ সাংসদ রাজু বিস্তারই সঙ্গে। আবার রাজুর সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক বাঁচিয়ে তুলে তিনি চাইছেন নিজের অস্তিত্ব ফের কায়েম করতে। আর এক শক্তি অজয় এডওয়ার্ডের হামরো পার্টি। তারা জোট করেছে কংগ্রেসের সঙ্গে। তবে কংগ্রেসের মুনীশ তামাং কতটা হাতের আর কতটা অজয়ের, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে দলেই।

এই পরিস্থিতিতে গোর্খাদের জন্য পৃথক রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের আবেগ, ১১ জনজাতির তফসিলি হিসাবে স্বীকৃতি— সবই যেন পিছিয়ে পড়ছে নিয়ন্ত্রণের রাজনীতির কাছে।

গত ১৫ বছরে বিজেপি পাহাড়ে নানা দাবিদাওয়া মেটায়নি— এমন অভিযোগকে সামনে রেখেই লড়ছেন অনীত। বিজেপির আবার দাবি, তারা পাহাড়বাসীর সমস্যা সমাধানের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে। যদিও এ বার সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বা কংগ্রেস, কেউই নিজেদের ইস্তাহারে গোর্খাদের নিয়ে শব্দ খরচ করেনি। লোকসভার সাতটি বিধানসভার মধ্যে অঙ্কের বিচারে এগিয়ে বিজেপি।

গত দু’বছরের একাধিক ভোটের ফল অবশ্য সব ক্ষেত্রে বিজেপির পক্ষে সন্তোষজনক নয়। সমতলে শিলিগুড়ি পুরসভা, মহকুমা পরিষদ, পাহাড়ে জিটিএ, পুরভোট এবং পঞ্চায়েত ভোট। সে সব থেকে এ বার পাহাড়তলিতে নিয়ন্ত্রণ রাখতে মরিয়া তৃণমূল। আসনের বিচারে দার্জিলিঙের অধীন উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমান বলেন, “এলাকার মহিলারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিজেরা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর প্রচার করছেন। গত বারের (লিড ৪৪,৭৭৭) রেকর্ড ভাঙবে চোপড়া।”

অনীত সভায় বলছেন, “পাহাড়ের উন্নয়ন, শান্তি বজায় রেখে আঞ্চলিক দল বাঁচানোর লড়াই করছি। ভূমিপুত্র প্রার্থী নিয়ে আমরাই শুধু লড়ছি।” সেখানে বিজেপির রাজু বিস্তা, দেশের প্রাক্তন বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে অনেকটা ‘লড়াই’ করে টিকিট পেয়েছেন। তাই প্রধানমন্ত্রী মোদীর গ্যারান্টির সঙ্গে গোর্খা স্বভিমান বাঁচানোর কথা বলছেন। সঙ্গী বিমল গুরুং। তিনি বলছেন, “গোর্খাদের আবেগ, মান বাঁচাতে লড়াই হচ্ছে। দুর্নীতি ঠেকাতে লড়াই হচ্ছে।” কংগ্রেস প্রার্থী মুনীশ তামাং বলছেন, “কেউ কথা রাখেনি। পাহাড়ে যেটুকু কথা সবই কংগ্রেস রেখেছে।”

পাহাড়ে বড় চা বাগান ৮৭টি। গত দু’-তিন বছর ধরে একাধিক বাগানে অচলাবস্থা। শ্রমিকদরদী হতে গিয়ে দার্জিলিং চা-কে ‘ব্লাড টি’র আখ্যাও বিরোধীরা দিয়েছে। পাহাড়ের শাসক দল পাল্টা দিয়েছিল, ‘আত্মার চা’। চা শ্রমিকদের জমির পাট্টা, আবাসের টাকার ঘোষণা করে রাজ্য কিছুটা সুবিধা পেয়েছে। যদিও প্রথম দিকে, শ্রমিকদের নিজের বসবাস করা জমি ও চাষের জমির পরিবর্তে অন্য জমির পাট্টা দেওয়ার কথা ওঠায় বিরোধীদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। আপাতত স্থিতাবস্থা বজায় থাকলেও চা শিল্পে জড়িতদের দাবি, কোভিড পর্বের পর থেকে দার্জিলিং চা অনেকটাই বাজার হারিয়েছে। যা নিয়ে কেন্দ্র, রাজ্য বা বিরোধী, কারও তৎপরতা নেই।

এবং এই সবের মধ্যে আছেন বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা। বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন কার্শিয়াং থেকে। এ বারে দলীয় প্রার্থী না-পসন্দ হওয়ায় নির্দল প্রার্থী। তিনি কি ভোট কেটে রাজু বিস্তার বিপদ ঘটাবেন? কালিম্পঙের ডম্বরচকের পাশে, চশমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নিহাল মুখিয়া বললেন, “যে যার ইচ্ছে ভোট কাটুক। শুধু পাহাড়টা শান্ত থাকুক।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 Darjeeling TMC BJP Spot Reporting

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।