প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ভরা গ্রীষ্মের দুপুরে খণ্ডহরের মতো দাঁড়িয়েছিল শ্রমিক আবাসন। একদা দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের ‘সুবর্ণযুগে’ এ সব আবাসন গমগম করত। কারখানার ঘণ্টি, কচিকাঁচাদের হুল্লোড়, গেরস্তবাড়ির চেনা শব্দে চারপাশ ভরে থাকত। এখন সে সব শুধুই ইতিহাস।
ভোট এসেছে দুর্গাপুরে। নানা দলের পতাকা উড়ছে, মাইক ফুঁকে তরজা, কুকথার যুদ্ধ চলছে। সে সবের মাঝে শিল্পাঞ্চলের হারানো গৌরব ফেরানোর কথা অস্পষ্ট। অন্তত কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দলের দুই বাঘা প্রার্থীর গলায় তো বটেই। তার বদলে চাকরি চুরি, চাল চুরি, একশো দিনের কাজের টাকা— এ সবই ঘুরেফিরে আসছে বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ এবং তৃণমূল প্রার্থী কীর্তি আজাদের গলায়। দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ছিলেন মেদিনীপুরের সাংসদ। তাঁকে নিজের চেনা ময়দান থেকে একেবারে বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে পাঠিয়েছে দল। নতুন মাঠে নেমেই অবশ্য নিজস্ব ঢঙে ব্যাট শুরু করেছেন। বিপক্ষে থাকা প্রাক্তন অফ স্পিন বোলারকে প্রায়শই তুলোধোনা করছেন। মাঝেমধ্যে লোপ্পা ক্যাচ যে তুলছেন না, এমনও নয়।
এ বার তীব্র গরমে চারদিক পুড়ছে। দিনেদুপুরে প্রচার বন্ধ রাখছে সবাই। তাই নিত্যদিনই ভোর-ভোর নেমে পড়ছেন গেরুয়া শিবিরের পোড়খাওয়া প্রার্থী। লাঠি হাতে প্রাতর্ভ্রমণ থেকেই শুরু করছেন প্রচার। তার ‘চায়ে পে চর্চার’ ঢঙে বাজার এলাকায় ছোট-ছোট সভা। দুর্গাপুরের চণ্ডীদাস বাজারে তেমনই এক সভায় দেখা মিলেছিল তাঁর। সাতসকালেই বক্তৃতা শুরু করলেন তার সপ্তকে। তবে এলাকার উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি কিংবা শিল্পের হাল ফেরানোর কথা তেমন শোনা গেল না। তার বদলে ‘পিসি, ভাইপো, ভাই’ ইত্যাদি শব্দবন্ধের সঙ্গে সেঁটে রইল নানা দুর্নীতির কথা। রাজ্যের প্রথম শিল্পাঞ্চলের হাল ফেরানোর কথা যে শোনা যাচ্ছে না, তা অবশ্য মেনে নিচ্ছেন বিজেপির কর্মীরাও। এ-ও বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার হাল ফেরানোর কথা তো খোদ দিল্লিই বলছে না। দিলীপই বা আগ বাড়িয়ে বলেন কী করে? এমনিতেই তো তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সম্পর্ক ‘মধুমাখা’। তবে বিজেপি আত্মবিশ্বাসী, প্রচার যা-ই হোক না কেন, শেষ হাসি হাসবেন দিলীপই। কথাটা যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তা মেনে নিচ্ছেন একেবারে নিচুতলার তৃণমূল কর্মী থেকে দুর্গাপুরের অটো কিংবা টোটো চালকদের অনেকেই। কারণ, দুর্গাপুরের দু’টি বিধানসভায় পদ্মের প্রতি চোরা সমর্থন আছে। তার উপরে একদা বিজেপির সাংসদ, কীর্তিকে বাইরে থেকে এনে দুর্গাপুরে প্রার্থী করায় অনেকেই মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন। কীর্তি নিজেও যে এই ময়দানের চরিত্র গভীর ভাবে বুঝতে পারছেন, তা নয়। প্রচার হোক বা সংবাদমাধ্যমে আলাপচারিতা, বার বারই তুলে ধরছেন একশো দিনের কাজ কিংবা আবাস যোজনায় কেন্দ্রীয় বঞ্চনার কথা। অথচ বর্ধমান-দুর্গাপুর এই কেন্দ্রে যেমন শিল্পাঞ্চল আছে, তেমনই আছে ভাতার, মন্তেশ্বরের মতো কৃষি ক্ষেত্রও। যদি সাংসদ হন, তা হলে এই কেন্দ্র নিয়ে কী বলবেন? প্রাক্তন ক্রিকেটারের সটান জবাব, ‘‘গোটা রাজ্যের কথা বলব। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ থেকে গোটা রাজ্যের বঞ্চনার কথা বলব।’’ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তৃণমূলের এক ছাত্র নেতা। প্রার্থীর কথা শুনে স্বভাবমতোই মাথা ঝাঁকালেন তিনি। মুখে কোনও কথা সরল না।
একান্তে তৃণমূল নেতারা অবশ্য মানছেন, গত বার দুর্গাপুরের উপরে ভর করেই বিজেপি শেষ ধাপে হারিয়ে দিয়েছিল। এ বার শুধু দুর্গাপুরের দুই বিধানসভা কেন্দ্র নয়, চিন্তায় রেখেছে গলসি এবং বর্ধমান (দক্ষিণ)-এর একাংশও। মন্তেশ্বর নিয়েও মাথা ঘামাতে হচ্ছে। বাকি জায়গা অবশ্য এখনও তৃণমূলের গড়। এই আশা-আশঙ্কার মাঝে তৃণমূলের অনেক নেতা তাকিয়ে থাকছেন তৃতীয় পক্ষের দিকে।
তৃতীয় পক্ষ, অর্থাৎ বাম-কংগ্রেস জোট। গেরুয়া-জোড়াফুল শিবিরের নেতা, কর্মী হোক বা রাজনীতি নিয়ে সচেতন আমনাগরিক— অনেকেই বলছেন যে, বামেরা যদি গত বারের তুলনায় এ বার নিজেদের ভোট বাড়াতে পারে, তা হলেই পদ্ম সরিয়ে ফের ঘাসফুল ফুটতে পারে। পরিসংখ্যানও তাই বলছে। ২০১৪ সালে সিপিএম প্রার্থী সইদুল হক পেয়েছিলেন প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোট। ২০১৯-এ তা নেমে যায় প্রায় ১১ শতাংশে। ঘাটতি প্রায় ২২ শতাংশ। সে বারই বিজেপির প্রায় ২৪ শতাংশ ভোট বেড়েছিল। ফলে কার ভোট কার ঘরে গিয়েছিল তা একেবারেই সোজা পাটিগণিত।
সিপিএম প্রার্থী, বর্ধমানের প্রাক্তন কলেজ অধ্যক্ষ সুকৃতী ঘোষালও আশাবাদী ভোট ফিরবে তাঁর ঝুলিতে। দিনরাত দৌড়চ্ছেন তিনি। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরছেন, হাঁটছেন, ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছেন। তরজা, কুকথার ভোটে সুকৃতীর গলাতেই জোরালো ভাবে শোনা যাচ্ছে, বন্ধ কারখানা খোলা, শিল্পাঞ্চলের পুনরুজ্জীবনের কথা। বলছেন, ‘‘রাজ্যের সরকার, কেন্দ্রের সরকার— দু’পক্ষই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি করেছে। সে কথা তো বলতেই হবে। কিন্তু তার বাইরেও তো বর্ধমান-দুর্গাপুরের শ্রমিক, কৃষকের কথা থাকে।’’ তাঁর প্রচারে উঠে আসছে, শিল্পের আধুনিকীকরণ, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, কৃষক বিমার দাবি।
তীব্র দহন, ভোটের উত্তাপ— সব মিলিয়েই চারদিক উত্তপ্ত। এমনই এক দুপুরে দুর্গাপুরের বাইরে বড়ডোবায় দেখা হয়েছিল সুনীল বাস্কের সঙ্গে। বাড়ির বাইরে গাছের ছায়ায় ভাঙা সাইকেলকে আদরযত্ন করছিলেন। ভোট নিয়ে প্রশ্নে মাথা তুলে তাকালেন। তার পর কুয়োর জলের মতো ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘‘ভোট দিলে আমার বিএ পাশ ছেলে কি খেতমজুরি ছেড়ে চাকরি করতে পারবে?’’
ভোটের সময় এ সব প্রশ্ন সত্যিই বড় কঠিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy