Advertisement
Back to
Anubrata Mondal

তিহাড়ে বন্দি ‘উন্নয়ন’, ভোটে নেই ‘চড়াম চড়াম’

দিন কয়েক আগে ভোট প্রচারে বীরভূমে গিয়ে অনুব্রত ও তাঁর মেয়ে সুকন্যাকে জেলবন্দি রাখার বিষয়টি উল্লেখ করে বিজেপিকে আক্রমণ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

অনুব্রত মণ্ডলের বাড়িতে পুলিশি প্রহরা।

অনুব্রত মণ্ডলের বাড়িতে পুলিশি প্রহরা। — নিজস্ব চিত্র।

সোমা মুখোপাধ্যায়
বোলপুর শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৪ ০৫:৫৩
Share: Save:

বোলপুরে নিচুপট্টির বাড়িতে তিন শিফটে তিন জন করে পুলিশ কর্মী। আড্ডা মেরে, আতিপাঁতি করে মোবাইল ঘেঁটে, চা-জল খেয়েও সময় কাটে না। খাঁ খাঁ বাড়িতে কাজই নেই। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের আগে এই বাড়ি যখন গমগম করত, এক-এক দিন নিঃশ্বাস ফেলারও যেন ফুরসত মিলত না। পাঁচ জন বেরোচ্ছেন, তো ২৫ জন ঢুকছেন। বাড়ির সামনেও ভিড় জমে যেত এক এক সময়ে।

সেই রাজা নেই। রাজ্যপাটও নেই। কেষ্টর গড়ে কেষ্ট নিখোঁজ। বাড়ি থেকে, বোলপুর থেকে, দলীয় কর্মীদের পারস্পরিক আলোচনা থেকে মুছে গিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। দু’এক বার তাঁর অস্তিত্ব চোখে পড়ছে বটে, তবে তা দেওয়ালে। বিরোধীদের স্লোগানে। ‘দেখ খুলে তোর দু’নয়ন/ তিহাড় জেলে কম্বল পেতে শুয়ে আছে উন্নয়ন’।

দিন কয়েক আগে ভোট প্রচারে বীরভূমে গিয়ে অনুব্রত ও তাঁর মেয়ে সুকন্যাকে জেলবন্দি রাখার বিষয়টি উল্লেখ করে বিজেপিকে আক্রমণ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দাবি করেছিলেন, ভোট মিটলেই কেষ্ট মুক্ত। কিন্তু তাঁর ওই মন্তব্যে ছিটেফোঁটাও বাস্তব আছে বলে মনে করছেন না কেউই। এমনকি, বোলপুরে দলীয় কার্যালয়ে বসে দলের এক শীর্ষ স্তরের নেতাও বললেন, ‘‘ও সব তো ভোটের বাজারে কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার জন্য উনি বলেছেন। সবাই জানে ওই কথার ভিত্তি নেই।’’

‘ভিত্তিহীন’ কথার নমুনা অবশ্য এ ক্ষেত্রে আরও আছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সিউড়ির এক সভায় মমতা দাবি করেছিলেন, ‘কেষ্টকে জেলে আটকে রাখলেও মানুষের মন থেকে ওকে দূরে রাখতে পারেনি।’ ভোটের মুখে কোপাই নদীর অদূরে এক চায়ের দোকানি বললেন, ‘‘হ্যাঁ, মানুষের মনে তো আছেই। কিন্তু ভালবাসায় নেই। ঘেন্নায় আছে। নিজের পাপে নিজে জেল খাটছে। মানুষের চোখের জলের কোনও বিচার হবে না, সব সময় তো তা হতে পারে না।’’ রতনপল্লির রাস্তায় বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘আমরা বিশ্বাস করি, সব অন্যায়েরই কখনও না কখনও শেষ হয়। অনুব্রত জেলে যাওয়ায় সেই বিশ্বাসই আরও পোক্ত হয়েছে।’’ বস্তুত, সেই শেষ হওয়ার তত্ত্বেই বিরোধীদের ‘ভ্যানিশ’ করার হুমকি দেওয়া কেষ্ট মণ্ডলের নিজেরই ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাওয়াটা অনিবার্য বলে মনে করছেন অনেকে।

অনুব্রতকে ছাড়াই পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে। অনুব্রতকে ভুলেই লোকসভা ভোটও হবে। কাগজে-কলমে অনুব্রত-ঘনিষ্ঠরাই আপাতত জেলায় ভোট করাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু বোলপুরে দলীয় কার্যালয় দেখে ভোটের উত্তাপ টের পাওয়ার উপায় নেই। সবটাই কেমন নিভু-নিভু। মন্ত্রী তথা অনুব্রত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত চন্দ্রনাথ সিংহের বাড়িতে ইডি-র তল্লাশির পরে তিনিও প্রচারের আলো থেকে অনেকটাই সরে আছেন। ময়ূরেশ্বর, রামপুরহাট, খয়রাশোল, সিউড়ি ১-এর মতো জায়গায় বিজেপি-র কাছে তৃণমূলের চাপ বেড়েছে বই কমেনি।

জেলার এক শীর্ষ নেতা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, চাপ তো কিছুটা আছেই। সেই চাপের অন্যতম উদাহরণ দুবরাজপুর। ওই বিধানসভার মধ্যেই খয়রাশোল রয়েছে। খয়রাশোলে অনুব্রত গোষ্ঠী, কাজল গোষ্ঠী দুইয়েরই প্রভাব। গোপনে পরস্পরের পিঠে ছুরি মারার চেষ্টাও চলে। তার ফায়দা তোলে বিজেপি।’’ পাশাপাশি নলহাটি দু’নম্বর ব্লক নিয়েও শাসক দলের অনেক অস্বস্তি। নেতার কথায়, ‘‘অনুব্রতের উপস্থিতিতে এগুলো বাগে আনার অন্য কায়দা ছিল। এখন সেই দমটাই নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি কিছু থেমে থাকবে? না। মুখ্যমন্ত্রী হয়তো ভয় পাচ্ছেন, অনুব্রতের অনুপস্থিতিতে জেলায় বিজেপি বাড়তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে! আমরা সেটা মনে করি না। আসল কথা, ব্যক্তি হারিয়ে যেতে পারে। দল দলের মতো করে বিকল্প ব্যবস্থা বার করে নেবে।’’

অনুব্রত না থাকায় তাঁর জায়গা দখলের চেষ্টা করেছিলেন কাজল শেখ। যার জেরে দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। বিষয়টি বুঝে কাজলের রাশ টানার সিদ্ধান্ত নেন দলের প্রধান। একাধিক খুন ও সন্ত্রাসে অভিযুক্ত কাজল নিজেকে অনুব্রতের বিকল্প ভাবা শুরু করলেও দলের উপর মহলের চাপে আপাতত সমঝে থাকছেন।

তা হলে জেলায় ভোটটা করাচ্ছেন কে? দু'এক শব্দে এ প্রশ্নের উত্তর হয় না। কারণ, এখানে এখন প্রকাশ্যেই দলের ঢিলেঢালা অবস্থা। জেলার দু’টি লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় টানা ঘুরে বোঝা গেছে, বহু জায়গাতেই 'সবাই রাজা'! কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। বিজেপির নিজেদের ভিতরের গন্ডগোল প্রবল আকার না নিলে তৃণমূলের ছন্নছাড়া অবস্থা আরও প্রকট হত। বীরভূম কেন্দ্রের মনোনয়ন বাতিল হওয়া বিজেপি প্রার্থী দেবাশিস ধর এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশও করেছিলেন। বস্তুত দেবাশিসের সরে যাওয়ার নেপথ্যেও দলের অন্দরের নানা গল্প বাইরে আসতে শুরু করেছে। জেলায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিজেপি-র সাংগঠনিক দুর্বলতাই ছন্নছাড়া তৃণমূলকে অনেকটা বাড়তি সুযোগ করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

পাঁচ বছর আগের কথা। সে বার লোকসভা ভোটের আগে অনুব্রতর ‘ভোট করানো’র পন্থার আঁচ পেতে বীরভূমে যাওয়া। তখন সদ্য ওঁর মা মারা গিয়েছেন। ক্যানসার আক্রান্ত স্ত্রী কলকাতার হাসপাতালের আইসিইউ-এ। বিরোধীদের গুড়-বাতাসা কিংবা নকুলদানা খাওয়ানো, চড়াম চড়াম ঢাক বাজানোর মতো ‘সুপারহিট’ সংলাপের রচয়িতা বলেন, ‘‘পরিবারে যাই ঘটে যাক না কেন, দলকে জেতানোর দায়িত্বটা তো পালন করতেই হবে।’’ দেখেছিলাম দুপুর গড়াচ্ছে। কিন্তু তাঁর বাড়িতে তখনও দফায় দফায় পাত পেড়ে খাচ্ছেন দলীয় কর্মীরা। ঘন সবুজ পাঞ্জাবির মাঞ্জায় কেষ্ট উঠছেন গাড়িতে। পর পর সভা। সেখান থেকে রাতে কলকাতার হাসপাতাল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আবার বীরভূমের দিকে রওনা। ‘‘আমাকে ছাড়া দিদি ভরসা পান না’, বলেছিলেন অনুব্রত।

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগেও অনুব্রত বলেছিলেন, ‘‘ভয়ঙ্কর খেলা হবে। কোন বল-এ ছয়, কোন বল-এ চার, সেই ট্রেনিংটাই আসল।’’

এখন কি তবে প্রশিক্ষণহীন খেলায় তৃণমূলের উপরে বাড়তি চাপ? দলের নেতা-কর্মীরা সে কথা মানতে চাননি। বীরভূমের প্রার্থী শতাব্দী রায়ের সঙ্গে অনুব্রতের মনোমালিন্যের কথা প্রকাশ্যে এসেছে একাধিক বার। আবার অনুব্রতই কিছু জায়গায় শতাব্দীকে বৈতরণী পার করিয়ে দিয়েছেন, সে কথাও সকলে মানেন। অনুব্রতহীন বীরভূমের ভোটে তাঁর চাপ কতটা? শতাব্দী বললেন, ‘‘আগে দলের কর্মীদের ছোট ছোট সমস্যা যে গুলো ওই স্তরেই মিটে যেত, সে গুলো এখন আমার কাছে আসছে। বাদবাকি সমস্যা নেই। কারুর অনুপস্থিতি ভোটে প্রভাব ফেলে না, ফেলছেও না।"

'আলাদা আলাদা করে অস্তিত্ব রক্ষা'র এই ভোটে তাই এ বার রং নেই। টানটান চিত্রনাট্য নেই। অঞ্জন চৌধুরী ঘরানার সংলাপও নেই। আছে এক অমোঘ সত্যের উপলব্ধি। বীরভূম থেকে বহু দূরে তিহাড়ে জেলে অনুব্রতও কি টের পাচ্ছেন, ক্ষমতা, প্রতাপ, অর্থ সবই অনিত্য? পায়ের তলার জমি সরে গেলে কেউ মনে রাখে না!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy