E-Paper

মহাভারতের যুদ্ধ এ বার, বলছে ভোটের রেলগাড়ি

ভোটের ঘোলা জল ছাপিয়ে ক্রমশ মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাতের দিকে চলে যাচ্ছিল আড্ডাটা রোমাঞ্চকর ভাবে। মাঝে স্টেশনগুলিতে ওঠা নামা চলেছে, নতুন উদ্দীপনায় কথা শুরু হয়েছে।

—প্রতীকী ছবি।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ০৯:১৯
Share
Save

জনারণ্যে ভেসে যাচ্ছে চার্চগেট স্টেশনের বিশাল চত্বর। জনারণ্যে দমবন্ধ ভিলে পার্ল মুখী রেলের কামরা। অফিস ফেরত এই সন্ধ্যায়, জানলার সিট স্বর্গ, কোনও মতে বসার জায়গা পাওয়া গিয়েছে এটাই যথেষ্ট। সপ্তাহ শেষ হয়ে আসছে, তাই বোধহয় এই ভিড় ঈষৎ ফুরফুরে, মোবাইল থেকে চোখ তুলে ছোট ছোট জটলায় খোশগল্প। ভোটবাজারের পরিচিত কিছু শব্দ অচেনা মরাঠী সংলাপের মধ্যে বারবার কানে আসায়, হিন্দিতে আলাপচারিতা চলল নিম্নরূপ।

"এ বারের যুদ্ধ মহাভারতের যুদ্ধ। কেন বলুন তো? মহাভারতের যা ছিল সবই পাবেন কমবেশি। বিশ্বাসঘাতকতা, পিছন থেকে ছুরি, আত্মসম্মানের লড়াই, আবেগের যুদ্ধ, শিবির বদল, হিন্দু ধর্ম, পিতার সঙ্গে পুত্রসমের লড়াই, সম্রাটের ঘরে ফেউ হয়ে ঢুকে তাঁর রাজ্যপাট কেড়ে নেওয়া। সব।"

"ও সব তো আছেই, কিন্তু নামগুলোও দেখো দাদা। মহাবিকাশ আগাড়ির সঙ্গে লড়়ছে কে? মহাদ্যুতি জোট। মহারাষ্ট্রের সব পোস্টারে শুধুই মহাযুদ্ধের ঝাঁজ।"

"একনাথ শিন্দেজি যখন দল ভাঙলেন, সবাই ভেবেছিল, এ বার বিজেপি-র হাতের পুতুল হয়ে থাকবেন। তাঁর দুর্নীতি মাফ করার বিনিময়ে শিবসেনা ভাঙিয়েছে, চুকে গিয়েছে। এ বার বসে যাও বাছাধন হাতে গোনা কয়েকটা আসন নিয়ে, আর বাকি শক্তি ঢেলে দাও বিজেপি-র দিকে। তা কিন্তু হল না, ১৫টি আসন বাগিয়ে নিয়েছেন মহারাষ্ট্রের মোট ৪৮-এর মধ্যে। আর তাই নয়, রামটেক আর কোলাপুর বাদ দিলে তেরোটিতেই বুক ঠুকে লড়ছেন উদ্ধবের সঙ্গে। বুকে দম আছে বলতে হবে।" "ওটাকে দম বলে না দাদা, বলে বোকামি। মন্ত্রালয়ে আজ বিশ বচ্ছর হল, কিছু খবর তো রাখি। হরেক কিসিমের লোক আসে ধান্দায়। শিন্দেকে আসলে লড়তে হচ্ছে ঘরে বাইরে। বালাসাহেবের ছেলের জন্য আবেগ সর্বত্র। এ বার মুসলিমরাও ঢেলে ভোট দেবে আগাড়িকে। মরাঠি মনহুস অনেকটাই উদ্ধবের পক্ষে। এটাও না হয় মোদীজির নামে সামলানো যাবে। কিন্তু মহাদ্যুতির ভিতরেই ঘুঘুর বাসা!"

"লাখ কথার এক কথা। দক্ষিণ মুম্বই আসনটি দেখুন। উদ্ধব দাঁড় করিয়েছে অরবিন্দ সবন্তকে, যিনি কোভিডের সময়ে এলাকার হিরো। শিন্দের হয়ে দাঁড়ালেন যামিনী যাদব, ওয়াশিং মেশিনে যাকে সফেদ বানানো হয়েছে। যামিনী এবং তাঁর স্বামী যশবন্তের বিরুদ্ধে আইটি, সিবিআই কী হয়নি বলুন? কর্পোরেটর হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়েছেন চুরির। আর এতে কি ভাবছেন স্থানীয় বিজেপি চটেনি, ভোটে তার ছাপ পড়বে না? বিজেপি-র অন্তত দু'জন বিধায়ক ছিলেন এখানের দৌড়ে। বিধানসভার স্পিকার রাহুল নরউইকরও চেয়েছিলেন আসনটি। শিন্দে জেদ করে যামিনীকেই বাছলেন। ঠেলা সামলাতে পারলে হয়।"

"শুধু মুম্বই দক্ষিণ কেন দাদা, মুম্বইয়ের প্রতিটি আসনেই স্থানীয় বিজেপি-র সঙ্গে শিন্দের গণ্ডগোল। আর যাঁদের দাঁড় করানো হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তো দাগানো। মুম্বই উত্তরপূর্ব আসনে শিন্দে সেনা দাঁড় করিয়েছে রবীন্দ্র ওয়াকারকে। গত বছর অক্টোবর থেকে তাঁর পিছনে হাওয়ালার অভিযোগে ইডি, সিবিআই লেগে ছিল, বেগতিক দেখে তিনি দলবদলু। বৃহন্মুম্বই কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি অগ্রাহ্য করে একটি পাঁচতারা হোটেলও চালাচ্ছিলেন তিনি। বিজেপি জোটে তিনি ঢুকে নিজে বেঁচে যেতে পারেন, কিন্তু লোকের মনে তাঁর ছবিটা ভাবুন।"

"ঠানে আর কল্যাণে তো শিন্দে-বিজেপি লড়াই প্রকাশ্যে। দু'তরফই ভোটে দাঁড়াতে চেয়েছিল। বিজেপি-র প্রার্থী ছিলেন সঞ্জীব নায়েক, কিন্তু শিন্দে ঘরের জায়গা ছাড়বেন কেন, ঘনিষ্ঠ নেতা নরেশ মাসকে-কে টিকিট দিলেন। নবি মুম্বইয়ের কয়েক জন বিজেপি নেতা প্রতিবাদে দল ছাড়বেন বলেছেন, চ্যানেলে দেখলাম। এটা কিন্তু শিন্দে ভুল করেছেন, ঠানেতে বিজেপি-র শক্তি বরাবরই বেশি। এখন যদি ভোটের দিন স্থানীয় বিজেপি কর্মীরা সাবোতাজ করেন, নরেশের জেতা অসম্ভব।" "কল্যাণের আসনটি নিয়ে অবশ্য বিজেপি-র ক্ষোভ থাকলেও কিছু করার ছিল না। ওখানে ছেলে শ্রীকান্তকে দিতেনই একনাথ। একে তো শ্রীকান্ত ওখানকার সাংসদ। দ্বিতীয়ত, না দিলে মহাভারতে নতুন গৃহযুদ্ধ হত! কিন্তু মজাটা গেখুন, ওই আসনও চেয়েছিল বিজেপি।"

"উত্তর মহারাষ্ট্রের নাসিকে যা হল, তা তো আর লুকিয়ে চুরিয়ে নয়। শিন্দে হেমন্ত গডসেকে দাঁড় করালেন, ঠিকই আছে তিনি আগের বারের সাংসদ। কিন্তু বিজেপি নয়, ঝগড়া বাধাল মহাদ্যুতির অন্য শরিক অজিত পওয়ারের এনসিপি। তারা নাছোড়বান্দা, প্রবীণ মন্ত্রী ছগন ভুজবলকে ওখানে দাঁড় করাবে। বিজেপি-ও তাতে খুশি, কারণ ভুজবল দাঁড়ালে ওবিসি ভোট এককাট্টা হবে, উনি সেই লক্ষ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছিলেন। গোলমাল দেখে ভুজবল নিজেই সরে দাঁড়ালেন, আর মাঝখান থেকে ওবিসি সম্প্রদায় চটে গেল মহাদ্যুতির উপর।"

"আমি তো শুনলাম, ওই কেন্দ্রে ওবিসি-র তরফে ব্যানার টানানো হয়েছে মরাঠা প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ার জন্য। বিজেপি-র ওবিসি নেতা অনিল জাঠভ রেগে গিয়ে নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন গডসে-র ভোট কাটতে।"

"নাসিকে মরাঠা প্রার্থীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু গোটা রাজ্যে মরাঠাদের ক্ষোভও কিন্তু ফলাফলে ছাপ ফেলবে। তাতে এক জোড়া এনসিপি আর এক জোড়া শিবসেনার মধ্যে কার দিকে পাল্লা ভারী হবে তা শেষ মুহূর্তের আগে বলা যায় না। মরাঠা সমাজ ছিল যোদ্ধা, বিস্তীর্ণ জায়গা ছিল তাঁদের। পরে পরিবার বাড়ে, জায়গায় টান পড়ে, সরকার সিলিং এনে বিভিন্ন আইন করে জমি নিয়ে নেয়। মরাঠাদের দুর্দশা শুরু হয়, জমি জিরেতের, বাসস্থানের, কাজেরও। বাধ্য হয়ে তারা ওবিসি-পর্যায়ভূ্ক্ত হয়ে সংরক্ষণ চাইছে। আদালতে এই নিয়ে মামলা চলছে বহু বছর।"

"তবে কী জানেন, মরাঠাদের কেউ একাত্ম করতে পারল না, দেশমুখ, পটেল কেউ নয়। বিলাসরাও দেশমুখ কিছু চেষ্টা করেছিলেন, তিনি চলে যাওয়ার যে ধাক্কা কংগ্রেসের মরাঠা ভোটব্যাঙ্কে লাগল, আজও উদ্ধার হল না। আজ সমস্ত রাজনৈতিক শিবিরে মরাঠা ভোট ছড়িয়ে রয়েছে, এককাট্টা হতে পারেনি। কিন্তু একটা কথা লিখে নেবেন দাদা, মরাঠারা সাম্প্রদায়িক নয়। সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়েছে সেই কোন যুগ থেকে।"

ভোটের ঘোলা জল ছাপিয়ে ক্রমশ মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাতের দিকে চলে যাচ্ছিল আড্ডাটা রোমাঞ্চকর ভাবে। মাঝে স্টেশনগুলিতে ওঠা নামা চলেছে, নতুন উদ্দীপনায় কথা শুরু হয়েছে। কিন্তু এ বার খাতাপত্র, মোবাইল সামলে নামার সময় হয়ে গিয়েছে। সদ্য চেনা মুখগুলিকে, সদ্য শেখা মরাঠীতে 'ইয়েতো মি' (আবার দেখা হবে) বলে ভিড়ে ঠাসা গেটের দিকে এগিয়ে যেতে হল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 Spot Reporting Maharashtra

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।