Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

শিবু সোরেনের দুমকায় সীতার অগ্নিপরীক্ষা

ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সমাজের ‘গুরুজি’ শিবু সোরেনের প্রয়াত জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্গা সোরেনের স্ত্রী এই সীতা। কল্পনার মতো তিনিও ‘গুরুজি কা বহু’, একই সঙ্গে ‘দুর্গাদা কি বেওয়া’-ও।

সীতা সোরেন।

সীতা সোরেন। — নিজস্ব চিত্র।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
দুমকা শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২৪ ০৯:১৭
Share: Save:

সারা দেশের ভোটে বিজেপির ভরসা অযোধ্যার মন্দির ও সেখানে বিরাজমান রামলালা। আর ঝাড়খণ্ডের দুমকা আসনে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল এক অগ্নিপরীক্ষার মঞ্চ সাজিয়ে দিয়েছেন পদ্মের প্রার্থী সীতার জন্য।

সীতা সোরেন। ত্রেতা যুগে বিব্রত সীতার পাশে যেমন ছিলেন তাঁর দুই পুত্র লব আর কুশ, এই ঘোর কলিতে দুমকার লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী সীতার দুই পাশে দুই কন্যা বিজয়শ্রী ও রাজশ্রী, যাঁদের কাজ সমাজমাধ্যমে মায়ের দিকে উড়ে আসা সমস্ত বিষ-তিরকে প্রতিহত করা।

ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সমাজের ‘গুরুজি’ শিবু সোরেনের প্রয়াত জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্গা সোরেনের স্ত্রী এই সীতা। কল্পনার মতো তিনিও ‘গুরুজি কা বহু’, একই সঙ্গে ‘দুর্গাদা কি বেওয়া’-ও। ২০০৯-এ ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান বছর ৪০-এর দুর্গা, তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে যাঁকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে তুলে আনছিলেন ঝাড়খণ্ডি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ ‘গুরুজি’। দুর্গার মৃত্যুর পরে স্বামীর শূন্য আসন‌ জামা থেকে বিধায়ক হন সীতা। পর পর তিন বার দুমকা জেলার এই আসন থেকে জিতে বিধায়ক হলেও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) তাঁকে শিবুর উত্তরাধিকারী বাছেনি। রাজনীতিতে তখনও না-থাকা হেমন্তকে তুলে এনে ধীরে ধীরে দলের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। শিবু দলের সভাপতি, আর কার্যকরী সভাপতি হেমন্ত। ২০১৯-এ জেএমএম এই হেমন্তের নেতৃত্বেই কংগ্রেস, আরজেডি ও বাম দলগুলিকে নিয়ে শাসক বিজেপিকে পরাজিত করে ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতায় আসীন হয়।

হেমন্তের মুকুটে সাফল্যের পালক একটা একটা করে যোগ হয়েছে, আর সীতা তত একা হয়েছেন। একটা গালভরা পদ তাঁকে দিয়ে রেখেছিল দল— সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, যা নিয়ে ফিচেলরা তামাশা করতেন— ‘জেএমএমেরও সর্বভারতীয় সম্পাদক, আরশোলাও বাজপাখি!’ অবশেষে জমি কেলেঙ্কারির জেরে ইডি-র হাতে গ্রেফতার হলেন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত। সীতাকে আলগোছে জানানো হল, নিজের স্ত্রী কল্পনাকে কুর্সিতে বসিয়ে যেতে চান হেমন্ত। যে আত্মীয়ের মাধ্যমে হেমন্ত বৌদিকে এই বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন, সপাটে তাঁকে জানিয়ে দিলেন সীতা— কল্পনাকে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মানবেন না! দুর্গা সোরেনের স্ত্রী তিনি, পরিবারের বড় বহু, জামা থেকে ৩ বার নির্বাচিত বিধায়ক। চোদ্দ বছর রাজনীতিতে। তিনি থাকতে কী করে দেবরজি কল্পনার কথা বলেন?

শিবুর পরিবারের অনুগত বৃদ্ধ চম্পাই সোরেনকে মুখ্যমন্ত্রী করে ঘরের কোঁদল তো সামলানো গেল, কিন্তু আরও কোণঠাসা হয়ে পড়লেন সীতা, হাস্যাস্পদও। ২০১২-য় রাজ্যসভার ভোটে বিপুল অর্থের বিনিময়ে দলের প্রার্থীর বদলে নির্দল প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল সীতার বিরুদ্ধে। আয়কর অফিসারেরা তল্লাশি করে সীতার অনুগতদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা ২ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা উদ্ধার করেন। সেই মামলায় ৭ মাস জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান সীতা।

ঘরের কোঁদল বাইরে টেনে নির্বাচনী ফায়দা তুলতে ময়দানে নামল বিজেপি। শোনা যায় পুরনো সেই মামলাকে হাতিয়ার করে বিজেপির নেতারা সীতাকে জানিয়ে দেন, ‘হয় আমাদের দলে আসুন, না হয় ইডি-সিবিআইয়ের তলবে হাজিরা দেওয়ার প্রস্তুতি নিন। ফের কি জেলে যেতে চান?’ বিজেপিতে এলে লোকসভায় প্রার্থী করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি পেলেন সীতা, শ্বশুরের দল যে মর্যাদা তাঁকে দেয়নি, তা-ও দেওয়া হবে বলে জানালেন পদ্মের নেতারা। সব দিক ভেবে, মেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে পদ্মফুলের ‘ওয়াশিং মেসিন’-এ ঢোকারই সিদ্ধান্ত নিলেন সীতাদেবী। বিজেপি বলল, ‘রাবণের লঙ্কা থেকে অযোধ্যায় ফিরলেন সীতা।’ সীতা বললেন, “চোদ্দ বছরের বনবাস যেন শেষ হল। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ ও জগৎপ্রকাশ নড্ডাকে ধন্যবাদ।” বিজেপিও তাঁকে প্রার্থী ঘোষণা করে দিল দুমকা আসনে।

দুমকা মানে শিবু সোরেন। অন্তত ২০১৯-এ বৃদ্ধ অশক্ত শিবু সোরেন বিজেপির সুনীল সোরেনের কাছে পরাজিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এমনটাই ছিল। সুভদ্র, মৃদুভাষী যে সুনীল সোরেন শিবু সোরেনের মতো মিথকেও ৪০ হাজার ভোটে হারিয়ে দিয়েছিলেন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বেমালুম তাঁকে সরিয়ে সীতাকে প্রার্থী করে দিলেন দুমকা আসনে। বিজেপির নেতারা বললেন, ‘দুর্গাদা কি বহু’-র প্রতি গুরুজির পরিবার ও দল যে অবিচার করেছেন, দুমকার আদিবাসী মানুষ তার জবাব দেবেন ভোটে। আর নরেশ সোরেন, বাপী হেমব্রম, সোপা মুন্ডার মতো দুমকার আদিবাসী মানুষের একটা বড় অংশ বলছেন, “অবিচার হয়েছে কি হয়নি, পরের কথা। তাঁদের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হেমন্তকে জেলে ভরেছে যে বিজেপি, সীতা কী বলে তাদের দলে ভিড়ল? সবাই জানে ইডি-র ভয় দেখিয়ে বিজেপি সীতাকে হাত করেছে। কিন্তু, আমরা বীরসা মুন্ডার জাতি। মাথা নোয়াতে শিখিনি। সীতা কেন মাথা নুইয়ে ফেলল?”

বিজেপি সমর্থক বাবলু দের চায়ের দোকান দুমকা বাসস্ট্যান্ডের সামনে। সঙ্গে হিন্দি খবরের কাগজও বেচেন। বাঁ হাতের বড় মগে ডান হাতের ছোট মগ থেকে লম্বা করে চা ঢালতে ঢালতে বলেন, “সুনীল সোরেনের প্রতি অবিচার করা হল। পাঁচ বছরে ভাল কাজ করেছিলেন। চমৎকার মানুষ, জানেন তো? তাকে সরিয়ে সীতা সোরেন শেষে? তার নাম শুনেই তো আদিবাসী মানুষ গাল পাড়ছে! তারা দেবে ভোট?” গজগজ করতে করতে থাকেন প্রৌঢ় বাবলু, “ঠান্ডা ঘরে বসে থাকেন নেতারা। ভাবেন, কেমন দিলাম! আদিবাসীদের চেনেনই না।”

সীতা বলছেন, শিবু অশক্ত হওয়ার পরে তাঁর স্বামীই দলটাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মারা যেতে জেএমএম এখন ঝাড়খণ্ডী মূল্যবোধ থেকে বহু দূরে। দুর্নীতি ছেয়ে ফেলেছে দলটাকে। এক সাংবাদিক পাল্টা বলেছিলেন, আপনার বিরুদ্ধেই তো কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে নির্দলকে ভোট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার বেলা? মেজাজ হারিয়ে সীতা বলেছিলেন, “সে তো গুরুজিও সাংসদ ঘুষ মামলার আসামি। আমি তো আর প্রথম নই!” নরেশ সোরেন সে ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, “গুরুজির পরিবারের মুখে কালি ছেটাতে বিজেপির সঙ্গে মিলে চক্রান্তে নেমেছেন সীতা। তাঁর রক্ষা নেই।”

দুমকায় জেএমএমের প্রার্থী জনপ্রিয় আদিবাসী নেতা ও ৫ বারের বিধায়ক নলিন সোরেন। দুমকার বিধায়ক সীতার ছোট দেওর বসন্তের নেতৃত্বেই প্রচার চলছে নলিনের। সীতার প্রচারে বিজেপি কর্মীদের তেমন জোশ নেই। তবে শ্বশুরকুলের বিরুদ্ধে মায়ের লড়াইকে নেটমাধ্যমে প্রচারে আনছেন বিজয়শ্রী ও রাজশ্রী। দুমকার লড়াইয়ে বারে বারে উঠে আসছে রামায়ণের অনুষঙ্গ। বিজেপি পাশে থাকলেও আসলে দুমকার লড়াইয়ের ময়দান একাকী এক মহিলার অগ্নিপরীক্ষা।

সীতা বিলক্ষণ জানেন, পরাজয়ের অর্থ অবধারিত পাতালপ্রবেশ।

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2024 Spot Reporting Jharkhand
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy