—প্রতীকী ছবি।
অন্ধকার বাসন্তী হাইওয়ে চিরে বিঁধছে মিটিংয়ের শব্দ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জাঁদরেল তৃণমূল নেতা সওকাত মোল্লা প্রার্থী সায়নী ঘোষের সমর্থনে ‘ঐতিহাসিক সভা’র কথা বলছেন। ফোনেই শুনিয়েছিলেন, এমনটা ভাঙড়ে কেউ দেখেইনি! শুধু হিন্দু সম্প্রদায়কে নিয়ে জনসভা। সন্ধ্যা ৭টায় মিটিং শুরু। নারায়ণপুর অঞ্চলের তিন নম্বর কলোনির মাঠে ৬ হাজার লোক জড়ো হবে। রাত পৌনে ন’টায় পৌঁছে মালুম হল, সওকাত বাড়িয়ে বলেননি।
মাঠের ধারে সভা শেষে ভোজের আয়োজন। ভাত, বাঁধাকপির তরকারি, মুরগির মাংস। চালতাবেড়িয়ার রিনা রুইদাস বা আটগাছার ধনঞ্জয় মণ্ডলেরা এক সুর, বছরভর ভাল-মন্দয় তৃণমূলই পাশে থাকে। সভায় রামমন্দিরের জবাবে তারকেশ্বর, কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বরে ‘মমতাদির কাজের’ কথা বলা হচ্ছে। গত লোকসভা ভোটে এক লাখি লিডের ভাঙড়, সংযুক্ত মোর্চার আইএসএফ প্রার্থীর কাছে বিধানসভায় খুইয়েছে তৃণমূল। এ বার বামেদের সঙ্গে আইএসএফের সমঝোতা ভাঙলেও জোড়াফুলশিবির সন্তুষ্টিতে ভুগছে না, বোঝাচ্ছে এই সভা। পঞ্চায়েত ভোটোত্তর সংঘর্ষের ঘটনায় আরাবুল ইসলাম জেলে। দলে খুচরো গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের আভাস। ভাঙড়ে তৃণমূলের এ ভোটের কাপ্তান সওকাত বলছেন, “এ আমাদের তফসিলি সঙ্ঘের মিটিং। ভাঙড় বিধানসভায় বিজেপির ভোট ২০১৯-এর ২৪ হাজার থেকে ২০২১ সালে ৩৮ হাজার হয়েছে। বিজেপি এখানেও উস্কানি ছড়িয়ে হিন্দু ভোট এককাট্টা করছে। তাই বাংলায় আমরাই হিন্দু, মুসলিম সবার পাশে…বার্তাটা দিতে হত।”
নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রদায়িক তাসে ভোট মেরুকরণের চেষ্টায় যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র কোনও মঙ্গলগ্রহের অংশ নয়। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর সুমন, সুগত বসুর কেন্দ্রে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বর শেষ কথা বলে না। যাদবপুর, টালিগঞ্জের মতো শহরাঞ্চলে বামেদের সংগঠন এখনও মজবুত। কিন্তু সন্তোষপুরের লেকের ধারে বৃদ্ধদের আড্ডা বা বারুইপুরের আটঘরায় চা-দোকানে ‘মোদীজির অস্মিতা’র প্রতি সম্ভ্রম।
‘মোদীর সৈনিক’ অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘তৃণমূলই আসলে সাম্প্রদায়িক’ বলে আঙুল তুলছেন। বিজেপি-র জাতীয় কাউন্সিল সদস্য, খবরের কাগজে কলাম লেখা গেরুয়া প্রার্থীর মোদীর জোরেই পরিচয়। তবে হৃদয়ে বাংলা যোগ বোঝাতে সরস্বতী পুজোর ঠাকুরমশাইয়ের ভঙ্গিতে ভাঙড়, বারুইপুর, টালিগঞ্জে কবিপ্রণামের আসর বা মতুয়াদের অনুষ্ঠানে হাজিরা দিয়ে চলেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বা ‘আরবান নকশালগিরি’র কড়া সমালোচক। যাদবপুরের দর্শন বিভাগে অরবিন্দ ঘোষকে নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির কথাও বলতে ভুলছেন না দিল্লি প্রবাসী অনির্বাণ।
যাদবপুরের শিক্ষাপ্রাঙ্গণটি দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের অন্তর্গত। সেই ক্যাম্পাসের প্রতিবাদ, বিপ্লবীয়ানা দিয়ে গ্রাম, শহর, মফস্সলে বিস্তীর্ণ যাদবপুর লোকসভাকে বোঝা অসম্ভব। তবু এ ভোটে যদুবংশের কৌলীন্যেরও টক্কর। হালতুর ছেলে সৃজন ভট্টাচার্য ‘হোক কলরব’-এর সময়ে যাদবপুরে ছাত্র-নেতা। ইতিহাসের ছাত্রের রাজনীতিতে হাতেখড়ি বিশ্ববিদ্যালয়েই। আদতে বিক্রমগড়ের মেয়ে সায়নীও তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রাক্তনী। তবে অভিনয়ের চাপে এক বছর বাদে কলেজ ছাড়তে হয়েছিল। এক যুগ বাদে যাদবপুরের প্রার্থী হয়ে ফেরা তাঁর ‘ঘর ওয়াপসি’ও।
জনসভায় রাত সাড়ে দশটাতেও সায়নীকে ধরতে হচ্ছে ‘হৃদমাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না…!’ যাদবপুরে এক বার জিতে ইদানীং কেউ থাকেন না। সায়নী বোঝাচ্ছেন, “কবীর সুমন, সুগত বসু, মিমি চক্রবর্তীরা আমার মতো ফুলটাইম রাজনীতিবিদ ছিলেন না।” মিমির সঙ্গে দলের দূরত্বের পরে অভিনেত্রী, তারকার জৌলুসও খানিক শাঁখের করাত। সাজপোশাকে ‘তোমাদের লোক’ হয়ে ওঠা সায়নী নিয়ম করে বলছেন, “গত তিন বছরে আমি মাত্র তিনটি ছবি, ৩০০টিরও বেশি সভা করেছি! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আপনারাই বঙ্গ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। আমি আপনাদের ঘরের মেয়ে, বার বারের সাংসদ হতে এসেছি!” উল্টোপাল্টা মিম দিয়ে আক্রমণ করে বিজেপি-র তাঁকে রাজনীতিতে ঠেলে দেওয়ার কথা হাসিমুখেই বলছিলেন তৃণমূলের যুব নেত্রী। সভায় বলছেন, ‘‘নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় মিথ্যে অভিযোগে জড়াতে চেয়ে ইডি পাঠিয়ে ১২ ঘণ্টা জেরা করে বিজেপি আমায় দমাতে চেয়েছিল। পারেনি।’’ সায়নীর মতে, "সংসদে মহুয়াদি’র মতো বিজেপির ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে গলা তোলাটাই সময়ের দায়।”
সুরে, কথায়, গদ্যে, পদ্যে, বাংলা, হিন্দিতে সায়নীর বক্তৃতার পাশে সৃজন কথা বলেন শান্ত স্বরে, থেমে থেমে। শুধু বলছেন না, শুনছেনও বিস্তর। বিভিন্ন পেশার মেয়েরা, অস্থায়ী কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ, বিশিষ্ট নাগরিকদের মতো নানা ক্ষেত্রের জনতাকে নিয়ে ছোট ছোট সভার ফাঁকে বলছেন, “ধর্ম নিয়ে রাজনীতির হাওয়ায় আমরা একটা বিকল্প ভাষ্য তৈরির চেষ্টা করছি। বিভিন্ন রুটি, রুজির সঙ্কটের কথা মেলে ধরছি।” তবে যাদবপুর জুড়ে বন্ধ কারখানার ক্ষত উস্কে সিপিএমকেই দুষছে তৃণমূল।
সৃজন প্রত্যয়ী, “বিজেপি নেই! এখানে কিন্তু ক্রমশ সিপিএম-তৃণমূল দ্বিমুখী লড়াই-ই তৈরি হচ্ছে। জোট ভেস্তে গেলেও আইএসএফের কর্মী, সমর্থকদেরও বুঝিয়েছি, তৃণমূলের অত্যাচার বন্ধ করতে সিপিএমই ভরসা।” বিজেপি প্রার্থীর পাল্টা দাবি, “তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ বিজেপিকেই বেছে নিয়েছে।” ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকী আবার দাবি করছেন, “আমাদের উকিল প্রার্থী নুর আলমকে আমল না-দিলে ঠকবেন। ভাঙড় ছাড়া অন্যত্রও আমরা সংগঠনে মজবুত।”
ভাঙড় ছাড়া যাদবপুর, টালিগঞ্জ, সোনারপুর উত্তর ও দক্ষিণ, বারুইপুর পূর্ব ও পশ্চিম বিধানসভায় ২০২১-এ তৃণমূল এগিয়ে। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের দাবি, “যে যা-ই বলুক, ২০১৯-এর প্রায় তিন লাখ ভোটে জয়ের রেকর্ডও ভেঙে দেব।” তবু শেষ বেলার প্রচারে পদ্মের দাপাদাপি জোড়া ফুলকে চিন্তায় রেখেছে। সৃজনের সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তিও ফেলনা নয়। বৃষ্টির ক্ষণিকের স্বস্তি ছাপিয়ে এ গ্রীষ্মে নিম্নচাপের গুমোট বার বার ফিরে আসছে। আড়ালে কোন ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপটায় কী হিসেব এলোমেলো হবে, তা শিগগির বোঝা যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy