ভোটের ঘটালে চর্চায় সেই ‘মাস্টার প্ল্যান’। ফি বছর সেখানে বানভাসিদের এমন ভোগান্তিতে দাঁড়ি পড়বে কি? —ফাইল চিত্র।
রাতভর ঝড়-বৃষ্টির তাণ্ডব শেষে আকাশ কিছুটা ধরেছে তখন। কিন্তু গ্রামের কয়েক ঘর বাসিন্দার উৎকণ্ঠা কাটেনি। বরং নতুন লড়াই শুরু হয়েছে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত বৃদ্ধকে নিয়ে। দূরে পাকা রাস্তার উপর অ্যাম্বুল্যান্স আটকে গিয়েছে। ভিতরে ঢুকে বৃদ্ধকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না চালক। তাঁর পক্ষে কিছু যে করা সম্ভব নয়, সেটা বোঝেন পাড়ার লোকজনও। কারণ, বৃদ্ধের ঘর পর্যন্ত অ্যাম্বুল্যান্স যাওয়া তো দূর, ঝড়-বৃষ্টির পরে হেঁটে পেরনোরও রাস্তা নেই!
প্রথমে ভাবা হয়েছিল, হৃদরোগে আক্রান্তকে সাইকেলে চাপিয়ে পাকা রাস্তা পর্যন্ত আনা হবে। কিন্তু সাইকেলের চাকা কাদা ঠেলে এগোতে পারবে তো? সেই চিন্তায় বাতিল পরিকল্পনা। এর পরে বৃদ্ধকে কাঁধে তুলে নিলেন এক জন। পিছু পিছু চললেন আরও কয়েক জন। হাঁটু পর্যন্ত জমাট কাদা ঠেলে কোনও মতে এগোনো। অবস্থা এমন, যে মাঝে মধ্যেই পা হড়কাচ্ছে। কোথাও কাদা এমনই জমাট যে, সমস্ত শক্তি দিয়েও এগনো যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত কোনওমতে সকলে মিলে ধরাধরি করে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হল বৃদ্ধকে! কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা!
ঘটনাটি কেশপুরের মহিষদায়, গত বর্ষার। যা ঘাটাল কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারী ওরফে দেব-এর নিজের গ্রাম। এবং ঘাটাল লোকসভা আসনেরই অন্তর্গত।
সেই গ্রামে পৌঁছে দেখা গেল, ভোটের আগে সেখানে রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তবে দিন কয়েক হয়ে দেবের বাড়ির কাছে পৌঁছে কাজ আটকে রয়েছে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে বলে। সেখানেই জমা জলে দাঁড়িয়ে দেবের প্রতিবেশী বিপদ সরকার বললেন, ‘‘দশ বছরের সাংসদ আমাদের রাজু (দেবের ডাকনাম)। কিন্তু এই গ্রামের কথা সে ভুলে গিয়েছে।’’ বিপদ এর পর দেবের জেঠুর বাড়ি দেখিয়ে বলতে থাকেন, ‘‘শক্তিপদ, বিষ্ণুপদ, তারাপদ, গুরুপদ— দেবের বাবারা সব এই পাড়ারই লোক। দেবও মুম্বই থেকে রাজ্যে ফেরার পরে বেশ কিছু দিন এই গ্রামে ছিল। প্রথম বার ভোটে দাঁড়িয়ে জেঠুর আশীর্বাদ নিতে এসেছিল। জেঠু মারা যাওয়াতেও এল। কিন্তু কেন জানি না, এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই রাস্তা তৈরির কাজটা ভুলে গেল!’’ উত্তেজিত ভাবে তিনি বলেন, ‘‘দেবের বাড়ির এই বুথেই এর পর তৃণমূল হেরেছে।’’ তাতেই কি এখন ভোটের মুখে রাস্তা সারানো শুরু হয়েছে?
দেবকে ঘিরে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ নিয়েও। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, দশ বছর সাংসদ থাকার পরে হঠাৎ এই লোকসভা নির্বাচনের আগে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে দেবকে এতটা সরব হতে দেখা যাচ্ছে কেন? বিজেপি প্রার্থী হিরণ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘লোকে ওঁকে দেখলেই জিজ্ঞাসা করছে, সংসদে দশ বছরে এক বারও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কথা বলেছিলেন?’’
১৯৫৯ সালে মানসিংহ রিপোর্টের ভিত্তিতে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৮২ সালে ঘাটালের শীলাবতী নদীর পাড়ে প্রকল্পের শিলান্যাস হয়। বরাদ্দ হয় টাকা। তার পর কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কাজ আর এগোয়নি। নতুন করে ফের ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি সংস্থা মাস্টার প্ল্যানের জন্য ডিপিআর তৈরির কাজ শুরু করে। তাতে ১৭৪০ কোটি প্রকল্প ব্যয় ধার্য হয়। ২০১৫ সালে জিএফসি (গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন) প্রকল্পের ছাড়পত্র দেয়। তার পর ফের ২০২২ সালে কেন্দ্র প্রকল্পটি ‘ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বর্ডার এরিয়া’ প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেয় রাজ্য সরকারকে। রাজ্য সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। গত বছর ‘ইনভেস্টমেন্ট ক্লিয়ারেন্স’ দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। তবে এখনও টাকা বরাদ্দ হয়নি। তৃণমূলের দাবি, গত বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সাংসদ, বিধায়কদের দিল্লিতে গিয়ে এ ব্যাপারে আন্দোলন করতে বলেছিলেন। তাতেই চাপে পড়ে ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্র। বিজেপির পাল্টা দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই উদ্যোগী হয়েছাড়পত্র দিয়েছে।
কিন্তু ঘাটালের সিপিআই প্রার্থী তপন গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘রাজ্যের তৃণমূল সরকার বা কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, কেউই টাকা দিতে চাইছে না। প্রচারে তৃণমূল নেত্রী বলে গিয়েছেন, রাজ্য নাকি একাই এই প্রকল্প করবে! যা অসম্ভব। এত টাকা রাজ্যের আছে নাকি?’’ কিন্তু ঘাটালের বাসিন্দাদের অনেকেই দেখা গেল, এই প্রকল্পের নাম শুনলেই চটে যাচ্ছেন। কেউ হতাশ চোখে বলছেন, ‘‘ভোট এলেই মানুষকে বোকা বানানোর জন্য ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কথা তোলা হয়। কিন্তু বার বার বোকা বানানো সম্ভব নয়, এ বার ভোটের ফলেই সব বোঝা যাবে।’’
জেলা তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলেও শোনা যাচ্ছে, আশঙ্কার চোরা স্রোত। অনেকেই বলছেন, ‘‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান এ বার দেবের বাঁচার রাস্তা হতে পারে, মরার পথও!’’ এই সঙ্গেই রয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ঘাটালের কেশপুর, ঘাটাল, দাসপুর, ডেবরা, পিংলা, সবং, পাঁশকুড়া পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রগুলির মধ্যে পাঁশকুড়া-পশ্চিম এবং ডেবরায় তৃণমূল পিছিয়ে ছিল বিজেপির থেকে। পিংলায় তৃণমূলের লিড ছিল মাত্র ১৬৯৮ ভোট। একার হাতে তৃণমূলকে টেনে তোলে কেশপুর। ৯২,০৭৪ ভোটের লিড দিয়েছিল এই কেন্দ্র। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির থেকে সেই লিড কমে দাঁড়ায় ২০,৭২০-এ।এমনকি, ঘাটাল বিধানসভা কেন্দ্রেও হেরে যান তৃণমূল প্রার্থী। শোনা যায়, সেই হার মেনে নিতে না-পেরে প্রকাশ্যেই তিনি নাকি সরাসরি দেবের দিকে আঙুল তোলেন। ফলে প্রশ্ন রয়েছে, এতেই অন্তর্ঘাতের রাস্তা তৈরি হবে না তো?
তৃণমূলের দাবি, পরিস্থিতি বুঝে ঘাটালে চষে বেড়াচ্ছেন দেব। যে গ্রাম কখনও দেব-দর্শন পায়নি, সেখানেও এ বার সভা হচ্ছে। পাল্টা ছুটছেন হিরণও। দেব যদি গ্রামে ঢোকেন, হিরণ পৌঁছে যাচ্ছেন ওই গ্রামেরই কারও বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ সারতে। ঘাটালের রত্নেশ্বর বাটির এমনই একটি গ্রামে হিরণ ভাত খেয়ে যাওয়ার দিন কয়েক পরে পৌঁছন দেব। আপনিও কি ভাত খেতে? দেব বলেন, ‘‘ভাত খাই আর না খাই, ঘাটালের সঙ্গে আমার প্রাণের যোগাযোগ। আমি এখানে ভোটে জিততে আসিনি, এসেছি ভালবাসা জিততে।’’
জলমগ্ন ঘাটালের স্মৃতিতে ভালবাসা ধুয়ে যাবে না তো? উত্তর কয়েক দিনেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy