E-Paper

উত্তরাধিকারী কে, ঘরের মাঠে সেয়ানে-সেয়ানে

বাবার আসনেই এ বার লড়ছেন কাঁথির অধিকারী বাড়ির ছোট ছেলে সৌমেন্দু অধিকারী। তবে দল বদলেছে, ফুল বদলেছে। আর মানুষের মন?

Soumendu Adhikari

সৌমেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২৪ ০৭:৫৯
Share
Save

যেন বাবারই পরীক্ষা।

সাতসকালে এক তাড়া কাগজ নিয়ে বৈঠকখানায় বসে গিয়েছেন বৃদ্ধ। পরনে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। স্মার্টফোনে সড়গড় নন। তবু তালিকা মিলিয়ে সেই ফোনেই একের পর এক নম্বর ঘোরাচ্ছেন। ইটভাটা মালিক সংগঠনের নেতা, কাজু ব্যবসায়ী থেকে তৃণমূলের মেজো-ছোট নেতা— মস্ত তালিকা। আর্জি একটাই, “শিশির অধিকারী বলছিলাম। এ বার আমি নই, ছোট ব্যাটাটা দাঁড়িয়েছে। ওকে আশীর্বাদ করবেন।” মনে করাচ্ছেন, “আমাদের সম্পর্ক তো আর আজকের নয়।”

বাবার আসনেই এ বার লড়ছেন কাঁথির অধিকারী বাড়ির ছোট ছেলে সৌমেন্দু অধিকারী। তবে দল বদলেছে, ফুল বদলেছে। আর মানুষের মন?

রামনগরের পথে চা দোকান চালান শাশুড়ি-বৌমা। শাশুড়ি পঞ্চাশের কোঠায়, বৌমা পঁচিশ। দু’জনেই লক্ষ্মীর ভান্ডার পান। বর্ধিত টাকাও পেয়েছেন। ভোটের হাওয়া কী? শাশুড়ির জবাব, “দুই ফুলই লড়ছে। তবে মেয়ে-বৌদের মধ্যে দিদি এগিয়ে।” বৌমার সুর ঈষৎ ভিন্ন, “চাল চুরি, চাকরি চুরির জবাবও কিন্তু মানুষ দেবে।”

আর ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ জবাব?

শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যাওয়ার পরে অধিকারীদের বিরুদ্ধে এটাই সব থেকে বড় অভিযোগ। সৌমেন্দুও দাদার পরপরই গেরুয়া খাতায় নাম তুলেছেন। ফলে, অভিযোগের বন্ধনীতে তিনিও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা এখন অধিকারীদের মীরজাফর, গদ্দার ছাড়া কিছু বলেন না। মারিশদার এক স্কুল শিক্ষকও বললেন, “নিজের স্বার্থে দলের সঙ্গে এমন আচরণ মানা যায় না।” উল্টো মতও আছে। দেশপ্রাণ ব্লকের এক কৃষিজীবীর কথায়, “না পোষালে ছেলে আলাদা সংসার করতেই পারে। তাই বলে মিথ্যে মামলা, প্রকাশ্যে গালিগালাজ কি ঠিক?” কুপুত্র যদিও বা, কুমাতা কখনও নয়— প্রৌঢ় মনে করালেন প্রবাদও।

জেলায় তৃণমূলের ‘কুকর্মের ভাগীদার' কিন্তু অধিকারীরাও। শিশির, শুভেন্দুদের আমলে এই জেলায়, বিশেষত খাসতালুক কাঁথিতে তৃণমূলের অধিকার তাঁদেরই ছিল। ফলে, কাটমানি, নিয়োগে দুর্নীতি, সমবায়ে টাকা নয়ছয়ের কাদা লাগছে অধিকারীদের পদ্মেও। নিজের জেলায় শুভেন্দুকে শুনতে হচ্ছে চোর স্লোগান। তাঁদের নিয়ে আদি বিজেপিতেও অসন্তোষ। শুভেন্দু এবং দলবদলুদের সঙ্গে পুরনো বিজেপির দূরত্ব মোটেই মেটেনি। আদি গোষ্ঠীর নেতা বললেন, “এঁদের এখন দলের সর্বোচ্চস্তরে ওঠাবসা। তাই সামনে কেউ কিছু বলছে না। তবে সবটা মেনেও নিচ্ছে না।” বিজেপির সাংগঠনিক বৈঠকেও বার বার কোন্দল কাঁটা বিঁধছে।

তবে সৌমেন্দুর প্রধান কাঁটা নিঃসন্দেহে প্রধান প্রতিপক্ষের জনপ্রিয়তা। কাঁথির তৃণমূল প্রার্থী উত্তম বারিক ‘কাজের ছেলে’ বলে পরিচিত। তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের সভাধিপতি, পটাশপুরের বিধায়ক। এলাকাবাসীই জানালেন, বন্যা, ত্রাণ, ক্লাব— উত্তম বছরভর মানুষের সঙ্গে থাকেন। সবুজ, গেরুয়া, লালের ভেদ না করে। ফলে জনপ্রিয়তার পারদ চড়েছে।

ভোটের ফল তা হলে অতি উত্তম হচ্ছে ?

তৃণমূল প্রার্থীর স্বর কঠিন, “প্রচারে ভাল সাড়া পাচ্ছি। তার পর দেখা যাক।” সবুজ পাঞ্জাবি ঘামে জবজবে। ছুটছেন ভগবানপুর, চণ্ডীপুর থেকে কাঁথি, দিঘা, রামনগর। সৈকত পর্যটনের উন্নয়ন থেকে মৎস্যজীবীদের প্রকল্প, দিঘায় জগন্নাথ মন্দির, তাজপুরে বন্দর— সবই থাকছে প্রচারে। লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী তো রয়েইছে। দলের লোকজন জুড়লেন, “অধিকারীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে দাদার টাকার জোরটাও আছে।” গুঞ্জন, টিকিট পেতেও নাকি...।

অধিকারী জমানা শেষে তৃণমূলের প্রথম পছন্দ ছিলেন মন্ত্রী অখিল গিরি ও তাঁর ছেলে সুপ্রকাশ। কিন্তু শুভেন্দুর মেসো অখিল ও মাসতুতো ভাই সুপ্রকাশ। গিরিদের উপর দল তাই পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারেনি। সেই শূন্যস্থানেই জেগেছেন উত্তম। গিরিদের গেরো অবশ্য কাটেনি। মন্ত্রী এবং মন্ত্রিপুত্র প্রচারে সে ভাবে থাকছেন না বলে অভিযোগ। কাঁথিতে মুখ্যমন্ত্রীর পদযাত্রার দিন তো মন্ত্রীর সঙ্গে জেলা নেতাদের হাতাহাতিও হয়েছে।

ভোট-যুদ্ধে এই দুই ভূমিপুত্রের মাঝে কংগ্রেস প্রার্থী ঊর্বশী ভট্টাচার্য। তিনি কলকাতার মানুষ। তবে জোটের প্রচারেও থাকছে জেলার কথা। কাজুর ক্লাস্টার থেকে মৎস্য বন্দরের পরিকাঠামো, কিংবা বন্যা প্রতিরোধে কেলেঘেই কপালেশ্বরী— কাজের কাজ যে তৃণমূল বা বিজেপি কেউই করেনি, সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। সঙ্গে বামেরাও রয়েছে। মনোনয়নের দিন লম্বা যৌথ মিছিলও হয়েছে। তবে প্রচারে লোক কই!

উত্তর কাঁথি, দক্ষিণ কাঁথি, রামনগর, পটাশপুর, ভগবানপুর, খেজুরি ও চণ্ডীপুর— এই ৭টি বিধানসভা নিয়ে কাঁথি লোকসভার বিন্যাস। একুশের বিধানসভার ফল অনুযায়ী চারটিতে এগিয়ে বিজেপি, তিনটিতে তৃণমূল। সব মিলিয়ে গোটা লোকসভায় ২৯,১৫৪ ভোটে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। পঞ্চায়েত নির্বাচনে অবশ্য তৃণমূলের পাল্লা ভারী। তবে তাদের ভাবনা ঘরের কোন্দল। সঙ্গে পুরনো মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির আনাগাগোনা। যে ভগবানপুরে এনআইএ আক্রান্ত হয়েছিল, সেখানকার এক তৃণমূল নেতা বললেন, “আমাদের ভোট মাস্টারগুলোকে এই সব করে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠাবে, বা তুলে নেবে। এটাই শুভেন্দুবাবুর রণনীতি।” এক জেলা নেতা জুড়লেন, “তৃণমূলের হাঁড়ির খবর অধিকারীরা জানে। তাই আমাদের লোকেরা ওদের সমঝে চলে।”

আর আছে পুরুষানুক্রমে ভোট করানোর অভিজ্ঞতা। এ সবের ভরসাতেই বুঝি সৌমেন্দু খানিক অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। ভগবানপুরের হদ্য গ্রামের এক চিলতে মাঠে কয়েকশো লোকের জমায়েত। সরু পথে বাইকের পিছনে চড়ে পৌঁছলেন পদ্মপ্রার্থী। কিন্তু কথায় কথায় লোকসভা ভোট বাদ দিয়ে ‘আমরা রাজ্যে ক্ষমতায় এলে’...। জয় নিয়ে এতটা নিশ্চিন্ত? এ বার কান এঁটো করা হাসি, “আমরা ক্ষমতায় এলে কী করব মানুষকে জানাতে তো হবে।” নিজে কাঁথির পুরপ্রধান ছিলেন। তবে বিধানসভায় কখনও লড়েননি। সে দিক থেকে বাবা-দাদাদের তুলনায় ‘স্টেপ জাম্প’ করে একেবারে লোকসভায়। বাবা-দাদার ভরসাই তা হলে শক্তি? কর্মীদের প্রতিবাদ, “না, না উনি নিজের যোগ্যতাতেই প্রার্থী হয়েছেন।” বিজেপির কাঁথি সাংগঠনিক জেলার অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সৌমেন্দু অবশ্য মাথা নিচু করে মানলেন, “মাথার উপর শিশিরবাবু, শুভেন্দুবাবু থাকার জোর তো আছেই।”

ছোট ফুলের বিরুদ্ধে দাদার অভিযোগ, পরিবারবাদ। বড় ফুলে ভাইয়ের ভরসা সেই পরিবারতন্ত্র।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 Contai Spot Reporting BJP

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।