সুকান্ত মজুমদার। —ফাইল চিত্র ।
ট্রাক্টরের সঙ্গে ট্রলি জুড়ে ‘রেল-গাড়ি’। এক কামরা বালুরঘাট-শিয়ালদহের। অন্যটি বালুরঘাট-দিল্লির। লোকসভা ভোটের আগে, দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট আসনে রেল-বৃত্তান্ত আলোচনার কেন্দ্রে। প্রচারে এই ‘ট্রেন’ বালুরঘাটের বিজেপি প্রার্থী সুকান্ত মজুমদার ব্যবহার করছেন। তৃণমূল প্রার্থী বিপ্লব মিত্রের প্রচারেও থাকছে রেল-প্রসঙ্গ। তবে উঠছে প্রশ্ন, তেভাগার জেলায় বহুধাবিভক্ত তৃণমূলের সঙ্গে টক্করে সুকান্তকে রেল দেখাতে হচ্ছে কেন!
হিলির সন্ন্যাসীতলায় প্রচারে রাজ্যের মন্ত্রী বিপ্লব বলছেন, ‘‘সুকান্ত বালুরঘাট-শিয়ালদহ এক্সপ্রেস চালু করিয়ে গৌড়-লিঙ্ক এক্সপ্রেস বাতিল করালেন। ওঁর কৃতিত্ব কী?’’ বালুরঘাটের বিজেপি বিধায়ক, অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ীর জবাব, ‘‘এলাকার উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন খুব জরুরি। গৌড়-লিঙ্ক এক্সপ্রেস মালদহে গিয়ে মূল গৌড় এক্সপ্রেসের সঙ্গে জুড়ে চলত। যাত্রীদের সময় নষ্ট হত।’’ বিপ্লবের অভিযোগ, বুনিয়াদপুরে রেলের প্রস্তাবিত ওয়াগন কারখানা সুকান্ত ‘কলকাঠি’ নাড়ায় বাতিল হয়েছে। জেলা বিজেপি সভাপতি স্বরূপ চৌধুরীর বক্তব্য, ওয়াগন কারখানার জন্য প্রস্তাবই হয়েছিল। বরাদ্দ হয়নি। বিজেপির দাবি, দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্তের উদ্যোগে মালদহ-ভাটিন্ডা ফরাক্কা এক্সপ্রেস সম্প্রসারিত হচ্ছে বালুরঘাট পর্যন্ত (উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল যদিও সে ব্যাপারে রেল-বোর্ড থেকে নির্দেশ পায়নি)। বালুরঘাট-হিলি রেল প্রকল্পে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। স্বরূপের পাল্টা জিজ্ঞাসা, ‘‘তৃণমূল কী করেছে?’’
‘‘দল কিছু করবে কী, আগে ভিতরের সমস্যা সামলাক,’’ বলছেন তৃণমূলের জেলা নেতা, যিনি বিপ্লব-ঘনিষ্ঠ নন। ২০১৯-এ বিপ্লবের নেতৃত্বে এবং তৃণমূলের একাংশের ‘অবদানে’ দলীয় প্রার্থী লোকসভায় হেরেছিলেন বলে ক্ষোভ রয়েছে দলের অন্দরে। বিপ্লবের বিরুদ্ধে তাঁর ভাইদের বিভিন্ন পদে বসিয়ে ‘পরিবারতন্ত্র’ চালানোর অভিযোগও রয়েছে। যদিও বিপ্লব সে অভিযোগ মানেননি।
বালুরঘাট লোকসভার মধ্যে তিনটি বিধানসভায়— বালুরঘাট, তপন এবং গঙ্গারামপুরে ২০১৯ এবং ২০২১-এ জেতেনি ঘাসফুল। কুশমণ্ডিতে লোকসভায় তৃণমূলের ‘লিড’ ছিল মাত্র ৭৪০ ভোটের। এ বার শাসক দলের জেলা কমিটিতে ‘মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ’ শিবিরের প্রাধান্য নিয়ে দলের অন্দরে কুমারগঞ্জের বিধায়ক তথা তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান তোরাফ হোসেন মণ্ডল সরব হন। পরে, গঙ্গারামপুর, কুশমণ্ডির ‘বিক্ষুব্ধ’ নেতারা কমিটিতে ঢোকেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সব শিবিরকে এক সঙ্গে চলার বার্তা দিয়েছেন। তবে লোকে দেখেছে গঙ্গারামপুরে অভিষেক এবং তপনে মমতার সভার মাঠ ভরেনি।
তোরাফ বলছেন, ‘‘জেলায় নির্বাচনী কোর কমিটির মাত্র একটা বৈঠক হয়েছে।’’ সম্প্রতি দলের বুথ, অঞ্চল, ব্লক, টাউন, জেলা স্তরে অন্তত ২৫০ কমিটিতে রদবদল হয়েছে বলে দাবি তৃণমূল সূত্রের। ‘‘এক অনুগামী বিধানসভায় ছ’হাজারের বেশি লিড দিয়েছিল। দলের পদে সে আর নেই!’’ হাহাকারের মতো শোনায় দলের এক জেলা নেতার গলা। তবে জেলা তৃণমূল সভাপতি সুভাষ ভাওয়ালের ভাষ্য, ‘‘অনেক কমিটি কাজ করছিল না। কাউকে না সরিয়ে, একাধিক জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যাঁরা বেসুরো গাইছিলেন, তাঁদের কর্মসূচিতে গুরুত্ব এবং স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে।’’
সাময়িক গুরুত্ব দিলেই যে সব সমস্যা মেটে না, দক্ষিণ দিনাজপুরে তা বোঝা উচিত ছিল তৃণমূলের, বক্তব্য এক আদিবাসী নেতার। দলে যোগদানের নামে জেলার তিন মহিলাকে দণ্ডী কাটানোর ঘটনা আদিবাসীরা ভোলেননি বলেও দাবি। তার উপরে রয়েছে তফসিলি শংসাপত্রের জন্য আবেদন করে না-পাওয়া, শংসাপত্র পেতে ‘ঘাসফুল-ফড়ের’ দাপটের মতো অভিযোগ। তপনের বিজেপি বিধায়ক বুধরাই টুডুর প্রত্যয়, ‘‘তৃণমূল থেকে বিজেপিতে এসে ফের তৃণমূলে যোগ দেওয়ার সময় বিপ্লব মিত্রকে দণ্ডী কাটতে হয়নি, আদিবাসীরা ভুলবেন না।’’ আবার আদিবাসী সংগঠন ‘সেঙ্গেল অভিযান’-এর মালদহ জ়োনের সহ-সভাপতি, হরিরামপুরের বিভূতি টুডু লিফলেট ছাপিয়েছেন, ‘মাঝি বদলাব, আদিবাসী গ্রাম বাঁচাব’। ‘মাঝি’ কে? ‘‘যিনি আদিবাসীদের জন্য সারনা ধর্ম কোড চালু করবেন,’’ জবাব বিভূতির।
আদিবাসীরা থাকুন বা না থাকুন, সংখ্যালঘুরা তৃণমূলের পক্ষে থাকবেন, উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারের নেতা সাহেরুল হক নিশ্চিত। গত লোকসভায় বালুরঘাট আসনের অংশ ইটাহার থেকে তৃণমূলের ‘লিড’ ছিল ২৭,৭৭৭। ইটাহার থেকে এ বার আইএসএফ বালুরঘাট আসনে প্রার্থী দিলেও সাহেরুলের বিশ্বাস, ‘‘লিড ৫০ হাজার ছাড়াবে।’’ ইটাহার বাসস্ট্যান্ডে বাজারে আসা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর প্রাপক রোজ়িনা বিবির মুখে বর্ধিত টাকা মেলার খুশি। কেরলে গিয়েছেন তাঁর স্বামী পরিযায়ী-শ্রমিক নাজিমুদ্দিন। রোজ়িনা বলেন, ‘‘স্বামী স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে সেখানে চিকিৎসা করাতে পারবেন। নিশ্চিন্ত অনেকটা।’’ ‘নিশ্চিন্ত’ ইটাহারের বিজেপি নেতা পার্থ ভারতীও। বলছেন, ‘‘এলাকার যে সব পরিযায়ী গুজরাত, হরিয়ানায় কাজে যান, তাঁরাই ইদে বাড়ি ফিরে বোঝাচ্ছেন, সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’’
সব পরিযায়ী কি সমান? হিলি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার অন্য পারে উঁচা গোবিন্দপুর গ্রামে পতাকায় দেখা মেলে ঘাসফুল-পদ্মের। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) নির্দিষ্ট সময়ে খুলে দেওয়া ফটক পেরিয়ে আসা বৃদ্ধের ক্ষোভ, এলাকায় উন্নয়নের দেখা নেই। তাই তাঁর নাতি গুজরাতে কাজে গিয়েছেন। গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ বিএসএফের ‘কড়াকড়িতে’। ‘‘উপরের তলার নেতারা কি জানেন, জীবন এখানে কেমন?’’ প্রশ্ন ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর প্রাপক প্রৌঢ়া লক্ষ্মী মণ্ডলের।
‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভার (১৬ এপ্রিল) পরে জেলায় আমাদের ভোট আরও বাড়বে,’’ আত্মবিশ্বাসী শোনায় গঙ্গারামপুরের বিজেপি বিধায়ক সত্যেন রায়কে। সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘আমার চালু করা ট্রেনেই বিপ্লব মিত্র তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার পরে কলকাতা থেকে জেলায় ফিরেছেন।’’ তবে আরএসপি প্রার্থী জয়দেব সিদ্ধান্তের জিজ্ঞাসা, ‘‘শুধু ট্রেন দিয়ে মানুষকে ভোলানো যায়?’’ তাঁর আশা, গত লোকসভায় রামে যাওয়া ভোট ফিরবে বামে। বংশীহারিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সভার পথ-প্রান্তে থেমে ‘রেল-গাড়ি’। পাশ কাটিয়ে জেলার নানা প্রান্তে ছোটে গেরুয়া পতাকায় সাজানো একের পরে এক বাস। বাসের মাথার ভিড় থেকে হাওয়ায় ভেসে আসে, ‘জয় শ্রীরাম’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy