Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

অঙ্কের নাম গোঘাট, ফুলের মধ্যেই কাঁটা

রাস্তার ধারে ধারে চাষের জমি। হুগলি জেলায় কোথাও তিন ফসলি, কোথাও চার ফসলি জমি হয়, বলছিলেন এক জন। মনে পড়ে গেল, সিঙ্গুর তো এই জেলাতেই।

—প্রতীকী ছবি।

দেবাশিস চৌধুরী
আরামবাগ শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২৪ ০৮:১১
Share: Save:

সাইকেল চেপে চলেছে মেয়েটি। হাসতে হাসতে। তাকে ঘিরে উড়ছিল সাদা প্রজাপতি। অকারণে যেমন ওড়ে। শিয়ালি থেকে গোলপুকুর যাওয়ার পথে।

রাস্তার ধারে ধারে চাষের জমি। হুগলি জেলায় কোথাও তিন ফসলি, কোথাও চার ফসলি জমি হয়, বলছিলেন এক জন। মনে পড়ে গেল, সিঙ্গুর তো এই জেলাতেই। মাঠের দিকে
তাকালে দেখা যায়, কোথাও বাদামের খেত। কোথাও তিলের। গাছগুলি হাওয়ায় দুলছে। সবে বৃষ্টি হয়েছে আগের বিকেলে। তীব্র গরমের পরে।

আরামের আমেজেই বসেছিলেন শেখ আব্দুল কালাম। বয়স তিন কুড়ি পেরিয়েছে। তবে বার্ধক্য ভাতা এখনও জোটেনি। দোকানের ভিতরে বসে চা তৈরি করে কাপে ঢালতে ঢালতে জানলার মতো খুপরি দিয়ে মুখ বার করছিলেন শেখ আব্বাস আলি। বলছিলেন, সেই কত্ত বছর আগে এখানে দু’টো খুন হয়েছিল। ব্যস, আর নয়। পাশেই রাস্তায় শহিদ বেদিতে লেখা, ‘রফিক মণ্ডল অমর রহে’।

এই সব তিল, বাদাম বা সদ্য কেটে নেওয়া ধানের খেত দেখলে কি বোঝা যায়, এখানে এই সব মাঠঘাট আগে কত খুনোখুনির সাক্ষী ছিল! পুরশুড়া, খানাকুল, আরামবাগ, গোঘাট... চার বিধানসভায় নাকি এক জনের কথায় সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত হল। অভয় ঘোষ। গোঘাট চৌমাথার কাছে গলির মধ্যে সিপিএমের অফিস। গোল বারান্দা সামনে। সেটাই ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণ-কক্ষ।

এখন সে দোতলা অফিসে হঠাৎ গেলে কাউকে না-ও পাওয়া যেতে পারে। বিকেলেও অনেক সময়ে তালা ঝোলে। তার মধ্যে আকাশ কালো করে আসে কালবৈশাখীর মেঘ। মনে পড়ে যায়, একটু আগে গোঘাটেরই হাজিপুর করপুকুরে চায়ের দোকানে যখন রাজনীতির কথা জমে উঠেছে, গুরুপদ দলুই, সুভাষ মল্লিক, চন্দ্রনাথ করেরা যখন সরকারি প্রকল্প, জলের লাইনের মতো বিষয় নিয়ে পরস্পরের কথা কাটছেন যুক্তিতে, তখন আর এক বৃদ্ধ এলেন। খালি গায়ে হালকা করে উড়নি জড়ানো। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘আগে এখানে এত কথা হলে সন্ধ্যায় তুলে নিয়ে যেত। তার পরে দুরমুশ।’’

গোঘাট, খানাকুল, আরামবাগে সে দিনের দেখা মেলা ভার এখন। তাই ২০০৪ সালে এই কেন্দ্র থেকে যেমন আশ্চর্য এক ‘মার্জিনে’ জিতেছিলেন সিপিএমের অনিল বসু, ৫ লক্ষ ৯৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে, তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে এগারোশো থেকে বড়জোর হাজার দশেকে।

খানাকুলের তাঁতিশাল পঞ্চায়েতের মাঝপুরে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছিলেন সিপিএম প্রার্থী বিপ্লব মৈত্র। তাঁর সামনে এই প্রসঙ্গ তুলতেই বিপ্লব বললেন, ‘‘আগে তো কিছু ভুলত্রুটি হয়েইছে।’’ তিন বারের বিধায়ক তাঁর বাবা বংশীবদন মৈত্র। বাবার মতোই সহজ জীবনে বিশ্বাসী প্রাথমিকের শিক্ষক বিপ্লব। খেয়ালও নেই, কখন চটির শুকতলা খয়ে গিয়েছে। তিনি কথা বলছেন, হাঁটছেন, হাত তুলে নমস্কার করছেন।

বামেদের কি এ বার ভোট বাড়বে? বিপ্লব বলছিলেন, ‘‘বাড়বে। গোঘাট, খানাকুল, আরামবাগে বাড়বে।’’

তাঁর এই অঙ্কের আশায় যে আরও এক জন বসে আছেন। তৃণমূলের প্রার্থী মিতালি বাগ। ঝড়জলের বিকেলে তারকেশ্বরের প্রচার কিছুটা থমকেছিল তাঁর। এর মধ্যেই দু’দণ্ড বসে জানিয়ে গেলেন, গোঘাটে বামের ভোট রাম ছেড়ে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। লক্ষ্মীর ভান্ডার যেমন তাঁকে দেবে বাড়তি হাওয়া, তেমনই রামের ভোট কমলে সেই হাওয়ায় বাড়তি অক্সিজেন পাবেন।

তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের একাংশও মনে করছে, ২০১৯ সালে যে ভোট বামের কূল ছেড়ে রামে গিয়েছে, তার কিছুটা ‘ঘর ওয়াপসি’ হবেই। বাম-কংগ্রেসের ভোট ২০২১ সালের বিধানসভায় নেমে গিয়েছে সাড়ে পাঁচ শতাংশের আশেপাশে। সেখান থেকে তা ১০-১১ শতাংশে উঠলেই মুখ থুবড়ে পড়বে অরূপকান্তি দিগরের স্বপ্ন।

কিন্তু সে ভোট ঘরে ফিরবে কি?

এই আসনের একমাত্র কেন্দ্র চন্দ্রকোনা, যা পশ্চিম মেদিনীপুরে। বিধানসভা ভোটে সেখানে ভাল ভাবেই জেতে তৃণমূল। সেখানকারই কোচগেরিয়া গ্রামের রানাপাড়ায়
দুপুরে তৈরি হচ্ছিল নতুন মন্দির। রাস্তা চওড়া হবে। কাটা পড়বে বটগাছটি সমেত শিবের থান। দুই পরিবার তাই ভাগ করে নিয়েছে মন্দির। তারই একটির চাতাল ধোয়ানো ঘিরে মেয়ে-পুরুষের ভিড়। সেখানেই বাড়ি রামপ্রসাদ রানার। বলছিলেন, ‘‘২০১১ সালের আগে সিপিএম-ই করতাম। তার পরে খুব মারধর হল। পালিয়েছিলাম। এখন ভোট দিই বিজেপিকেই।’’ বামে তিনি আর ফিরবেন না।

সে কথা বলতেই বিপ্লব সজোরে বলেন, ‘‘আর যা-ই হোক, এখানে তৃণমূল জিতবে না!’’ তা হলে বিজেপি জিতবে? একটু থতমত খেয়ে যান তরুণ। তার পরে বলেন, ‘‘আমরা জিতব। আমাদের ভোট বাড়বেই।’’

এই কেন্দ্রে তৃণমূলের জোর যদি হয় তারকেশ্বর, হরিপাল, বিজেপির তবে পুরশুড়া। সেখানে রাউতারা গ্রামে দুপুরে গাছপালার ছায়ায় মাচায় উঠে আড্ডা দিচ্ছিলেন বিভূতি বাগ, নেপাল বাগ, গোপাল বাগেরা। পিছনে বাঁশবনের ছায়ায় ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। বিভূতিরা অনেকেই বার্ধক্যভাতা পাননি। লাইন এলেও সব ঘরে জল পৌঁছয়নি। তবে বিভূতির ছেলে সুকুমার বলছিলেন, তাঁর মায়ের পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেলে স্থানীয় নার্সিংহোমে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে অস্ত্রোপচার হয়েছে। নিখরচায়।

জলের লাইন যায়নি হরিপালের জিনপুর গ্রামেও। আক্ষেপ করছিলেন নাজরিন খাতুন, পোস্ট বসেও পথবাতি হয়নি। তবে লক্ষ্মীর ভান্ডার পেয়েছে চন্দ্রকোনা থেকে হরিপাল, তারকেশ্বর থেকে আরামবাগ।

আর আছে ‘ঘরের কাঁটা’। আরামবাগের কাঁচগোরিয়ায় বৈদ্যনাথ মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে বিজেপি বিধায়ক মধুসূদন বাগ বলছিলেন, ‘‘সবাই মিলে দলের প্রার্থীর জন্য নেমেছি।’’ কিন্তু কানাঘুষোয় শোনা যায়, প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল তাঁরই। দলের এক জেলা নেতার ‘বদান্যতায়’ তা হয়নি। লিড-এর কথা বলতে গিয়ে প্রার্থী অরূপও গোঘাট, চন্দ্রকোনা, পুরশুড়ার নাম করেন। আরামবাগের কথা যেন ‘ভুলে’ যান।

যেমনটা শোনা যায় তারকেশ্বরে, তৃণমূলের এক জেলা নেতার ক্ষেত্রেও। তিনি সুরটি বেঁধে রেখেছেন নাকি সমে, যদিও বুঝতে দিচ্ছেন না কাউকে। তারই ঝংকারে তলে তলে মাটি পুরোটা ক্ষয়ে যাচ্ছে দলের। তৃণমূলের লোকজনই বলছেন, মিতালি তো লড়ছেন কার্যত হারা লড়াই। তার মধ্যে মাটি ধুয়ে গেলে তিনি কি থই পাবেন?

সাদা সাদা ফুলের পাপড়ির মতো প্রজাপতি উড়ছে আরামবাগের গোলপুকুরের রাস্তায়, কন্যাশ্রীর সাইকেল ঘিরে। কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2024 Spot Reporting Arambag
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy