Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

ছায়া-বাজিতেই ভোটের আলোক সন্ধান

অধিকারী বাড়ির মেজো ছেলের রাজনীতি ঘরের শহর কাঁথি থেকেই শুরু হয়েছিল। তবে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পরে তাঁর বড় জয় এই তমলুকে, ২০০৯ সালের লোকসভায় লক্ষ্মণ শেঠের বিপক্ষে।

—প্রতীকী ছবি

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য
তমলুক শেষ আপডেট: ২২ মে ২০২৪ ০৮:৩১
Share: Save:

তীব্র দহনে স্কুলে আগাম গরমের ছুটি। খুদে ছাত্রটি বাবা-মায়ের দোকানঘরের বেঞ্চেই সুকুমার রায়ে সুর তুলেছে— ‘রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেক রকম পুঁজি!’

খদ্দের দাঁড়িয়ে। তমলুক ছাড়িয়ে ময়নার পথে এক চিলতে সেই দোকানে পাঁউরুটিতে মাখন লাগানোর ফাঁকে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মা, ‘‘রোদের আবার ছায়া কী রে! গনগনে রোদেই তো সব জ্বলছে।’’ ছেলেও পাল্টা গলা তুলল, ‘‘বইয়েই তো লিখেছে— আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা।’’

সত্যিই রোদ গনগনে। পারা উঠছে তেতাল্লিশ-চুয়াল্লিশে। ভোটের তমলুক অবশ্য ছায়াময়। পক্ষ-বিপক্ষ-প্রতিপক্ষ— ‘বহিরাগত’ সব প্রার্থীর উপরেই প্রলম্বিত ভূমিপুত্রের ছায়া। তিনি শুভেন্দু অধিকারী।

অধিকারী বাড়ির মেজো ছেলের রাজনীতি ঘরের শহর কাঁথি থেকেই শুরু হয়েছিল। তবে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পরে তাঁর বড় জয় এই তমলুকে, ২০০৯ সালের লোকসভায় লক্ষ্মণ শেঠের বিপক্ষে। ২০১৪-তেও তমলুকে জেতেন। ২০১৬-তে মমতা তাঁকে বিধানসভায় নিয়ে আসেন, নন্দীগ্রাম থেকে জিতিয়ে। তখন উপ-নির্বাচনে এবং তার পরে ২০১৯-এ তমলুকে জিতলেন দিব্যেন্দু অধিকারী— দাদার ছায়া হয়েই। দলবদল এবং নন্দীগ্রামে মমতাকে হারানোর পরে বিরোধী দলনেতার ছায়া বঙ্গ বিজেপিতে দীর্ঘতর হয়েছে। সেই ভরসাতেই জেলায় এ বার গেরুয়া প্রার্থী প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

শহুরে মানুষ। রোদ-জল কিংবা গাঁয়ের লোক— কোনও কিছুর সঙ্গে গা ঘেঁষার অভ্যাসই যে প্রাক্তন জজসাহেবের নেই, তা দিব্য বোঝা যাচ্ছে। বিকেলের মুখে দিনের প্রথম কর্মসূচিতেও তাঁর বক্তব্য মেরেকেটে তিন মিনিট। সেখানেও শক্ত শক্ত কথা। লক্ষ্মীর ভান্ডার মমতা নিজের টাকায় দিচ্ছেন না, চাকরি দুর্নীতি মামলার আইনি খুঁটিনাটি বোঝাচ্ছেন হদ্য গাঁয়ের মেয়ে-বউদেরও। আমজনতা কি অতশত বুঝবে? ‘‘সবাই তো নিরেট নয়। আশা করি বুঝবে,’’— রক্ষী বেষ্টিত প্রাক্তন বিচারপতির কণ্ঠ উদ্ধত। আর স্থানীয়রা কাছাকাছি গেলে তো তেড়ে আসছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে কু-কথা বলায় কমিশনের কোপেও পড়েছেন। এক বিচারপতি আগেও এই জেলায় ভোটে লড়েছিলেন। পদ্মা খাস্তগীর। তাঁকে কিন্তু হারতে হয়েছিল।

সভায় অভিজিতের সঙ্গী, দলবদলু বিদায়ী সাংসদ দিব্যেন্দু অবশ্য মাইকে বলছেন, ‘‘বিচারপতি সাহেব জিতে দিল্লি গেলে তাঁর অনুমতিক্রমে আমিই আপনাদের ভালমন্দ দেখব।’’

সেই ছায়া কাহিনি।

পূর্ব মেদিনীপুর শিক্ষায় আগুয়ান জেলা। ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন। স্কুলে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগেও এগিয়ে জেলা। বিজেপির তাস তাই, নিয়োগ মামলার এই প্রাক্তন বিচারপতি। তবে নিয়োগ-দুর্নীতির ছায়া শুভেন্দুর উপরেও। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, শিক্ষকের চাকরি পেতে তৃণমূলে থাকাকালীন অধিকারীদের টাকা দেওয়ার অভিযোগ। জেলার ছেলেদের অন্য জেলা থেকে পরীক্ষায় বসিয়ে চাকরি করে দেওয়ার অভিযোগও জানালেন অনেকে। তাই চাকরিহারাদের (সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত স্থগিত) একজোট করে পাল্টা রব তুলছে তৃণমূলও। চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনের নেতা মহিউদ্দিন মাহিও লড়ছেন তমলুকে, আইএসএফ প্রার্থী হিসেবে। গুঞ্জন, সংখ্যালঘু ভোট কেটে বিজেপির সুবিধা করে দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। মাহি প্রচারও করছেন মূলত সংখ্যালঘু এলাকাতেই।

তৃণমূল প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্যের প্রচারেও থাকছে চাকরি-কথা। তিনি বোঝাচ্ছেন, ‘প্রাক্তন বিচারপতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই চাকরি মামলায় একের পর এক রায় দিয়েছিলেন।’ তবে শুভেন্দুর ছায়ার সঙ্গে কুস্তি তিনিও করছেন। যতই লিখুন না কেন ‘তৃণমূলের ভাঙিয়ে নেতা/নয়কো সহজ ভোটে জেতা’, ‘খেলা হবে’র লেখক মানছেন, রাশ তাঁদের প্রাক্তনীর হাতেই। গোটা এলাকা চষছেন। হরিনাম সঙ্কীর্তন থেকে নিজস্বী, সাইকেলে-লঞ্চে প্রচার— সবেতেই আছেন। তবু চোখেমুখে উদ্বেগ। স্বীকার করছেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে প্রার্থী তো আসলে শুভেন্দু অধিকারী।’’ সঙ্গে জুড়ছেন, ‘‘নন্দীগ্রাম আর ময়নার বাকচা যদি লিড দেয়, বেরিয়ে যাব।’’

এই দেড়খানা বিধানসভা এত গুরুত্বপূর্ণ কোন অঙ্কে? স্পষ্ট করেননি দেবাংশু। পরিসংখ্যান বলছেন, নন্দীগ্রাম, হলদিয়া ও ময়না— তমলুক লোকসভার অধীন ৭টি বিধানসভার মধ্যে একুশের ভোটে এই তিনটিতে পদ্ম ফুটেছিল। বাকি চারটিতে জেতে তৃণমূলই। ওই ভোটের নিরিখে মাত্র ২১ ভোটে এই লোকসভায় এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। তবে গেল পঞ্চায়েত ভোটের হিসেবে তৃণমূল অনেকটাই এগিয়ে। তবু, কে আসলে ঘরের শত্রু, ভয় সেটাই।

নন্দীগ্রামে মমতার হারের পরে এই অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছিলেন জমি আন্দোলনের নেতা শেখ সুফিয়ান। সন্ধেবেলা বাড়িতেই দেখা মিলল তাঁর। ‘জাহাজ বাড়ি’র মালিক জানালেন, ‘‘দলের একটা মিটিং করে এলাম। নন্দীগ্রাম অনেকটা লিড দেবে, দেবাংশু জিতছে।’’ যদিও তাঁর অফিসঘরে বসতে ধুলো ঝাড়তে হল। ভোট ব্যস্ততার লেশমাত্র ছাপ সে ঘরে নেই।

নন্দীগ্রামে ঘাসফুলের তুলনায় পদ্ম পতাকার বহর বেশি। হেরে যাওয়ার পরে মমতা এক বারও কেন এলেন না, আছে সে ক্ষোভও। সন্ত্রস্ত বাকচা থেকে নন্দকুমার থেকে মহিষাদল— সর্বত্র আর এক ক্ষোভ, লক্ষ্মীর ভান্ডারে টাকা ঢোকেনি। জেলার অনেক পঞ্চায়েতই বিজেপির। তাই ধারণা, বিরোধী বলেই টাকা বন্ধ।

সিপিএম বলছে মানুষের হাতে কাজ আর অধিকারের সঙ্গে অর্থ উপার্জনের কথা। মনে করাচ্ছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে গাল পাড়া শুভেন্দুও এখন বুদ্ধ-স্তুতি করছেন। জোটের প্রার্থী এখানে সিপিএমের সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। হাই কোর্টের তরুণ এই আইনজীবীর সঙ্গে নন্দীগ্রামের মহেশপুর বাজারের মতো প্রত্যন্ত এলাকাতেও ছেলেছোকরারা নিজস্বী তুলছেন। তরুণ প্রজন্মের অনেকে বলছেন, ‘‘রাম তো বেড়েছে বাম ভেঙে। এই ছেলেটা সেই ভোট অনেকটা ফেরাবে।’’

কিন্তু আপনি ভোট পেলে তো আখেরে দেবাংশুর লাভ? সায়নের জবাব, ‘‘ভোট কাটাকাটির খেলাটা এখানে অন্য হবে না তো!’’ তাঁর ব্যাখ্যা, মুখ্যমন্ত্রিত্বের ইচ্ছে নিয়ে তৃণমূল
ত্যাগ করা শুভেন্দু কি অভিজিতের মতো শিক্ষিত, বাঙালি মুখকে জেতাবেন? তাঁর পথে কাঁটা পড়বে না তো তা হলে? একই কথা বললেন দেবাংশুও।

নিজের জেলা হাতছাড়া হলে শুভেন্দুর রাজনৈতিক পুঁজি কী থাকবে? জুতসই জবাব মেলেনি। তবে বিজেপি নেতারা প্রত্যয়ী, ‘‘শুভেন্দুবাবু নিজের জেলার দু’টো আসন মোদীজিকে উপহার দেবেনই।’’

তমলুক জুড়ে হনুমানের বাড়বাড়ন্ত। মূর্তি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সে সব মূর্তি দাঁড়িয়ে রামচন্দ্রের ছায়া হয়েই।

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2024 Tamluk Spot Reporting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE