Advertisement
E-Paper

আর বিভাজন নয়, উন্নয়ন চায় উত্তর-পূর্ব দিল্লি

চার বছর আগের দিল্লির ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক অশান্তির গ্রাউন্ড জ়িরোতে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিল্লি লোকসভা কেন্দ্রের শিববিহার তিন মাথার মোড়ে।

—প্রতীকী ছবি

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০২৪ ০৯:০০
Share
Save

পরম যত্নে লস্যির মাথায় মালাই সাজাতে সাজাতে কথা বলছিলেন অনিল নেগি। গলায় ঝরে পড়ল হতাশ মেশানো ক্ষোভ, ‘‘অনেক হয়েছে হিন্দু-মুসলিম নিয়ে রাজনীতি। ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। গরিবি বেড়েছে এলাকায়। আমরা চাই রাস্তা ঠিক হোক, দু’পাশের আবর্জনা দূর করার একটা পাকা ব্যবস্থা হোক, শৌচালয়, হাসপাতাল, ভাল স্কুলের অভাব, নজর দেওয়া হোক সে দিকে।”

চার বছর আগের দিল্লির ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক অশান্তির গ্রাউন্ড জ়িরোতে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিল্লি লোকসভা কেন্দ্রের শিববিহার তিন মাথার মোড়ে। যার এক দিকে শিবপুরী যেখানে মূলত হিন্দুদের বাস। অন্য দিকে মুসলমান অধ্যুষিত মুস্তাফাবাদ। হিংসার সময় এই শিববিহার তিন মাথার মোড়ের রাস্তা হয়ে উঠেছিল ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান বর্ডার’। এক দিক থেকে পাথর, গুলি ছুটলে, অপর দিক থেকে পাল্টা জবাব অ্যাসিডের বোতল, পেট্রল-বোমায়। সিএএ-বিরোধী আন্দোলন এবং তার বিরুদ্ধে বিজেপি নেতাদের হুঁশিয়ারিকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ছ’দিনের হিংসায় উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ৫৩ জন নিহত হয়েছিলেন।

কেউ যেন তিন বছর আগের হিংসার জের টেনে ভোটে সুবিধে নিয়ে যাক— এমনটা চাইছেন না স্থানীয় কোনও পক্ষই। যেমন অনিল নেগির প্রাচীন দোকান ‘রাধে রাধে লস্যি শপ’ হিংসার সময় কুখ্যাত হয়ে যাওয়া ‘রাজধানী পাবলিক স্কুল’-এর পাঁচটা বাড়ি পরেই শিবপুরী অর্থাৎ হিন্দু বলয়ে। তাঁর দোকান জ্বলে গিয়েছিল, কিন্তু পেয়েছিলেন মাত্র বিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ। কেন্দ্রে মোদী বা রাজ্যে কেজরীওয়াল— কেউই ফিরে দেখেননি, এমনটাই অভিযোগ আদ্যন্ত হিন্দু ধর্মাচরণ করা এই মানুষটির।

গোটা দিল্লির জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ মুসলিম হলে, এই উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ওই শতকরা প্রায় ৩০ শতাংশ। এটা ২০১১ জনগণনার হিসাব, এখন যা আরও বেড়েছে স্বাভবিক ভাবেই। স্থানীয় স্টেশনারি দোকানের বয়স্ক মালিক ধরমবীর বলছেন, “ওই অশান্তির পর দেখা যাচ্ছে ক্রমশ হিন্দুরা এই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আর পুরনো দিল্লি থেকে মুসলিমরা ভাল দামে নিজেদের বাড়ি বেচে দিয়ে এই মুস্তফাবাদ ভিড় জমাচ্ছেন। এখানে বোধহয় তাঁরা এখন নিরাপদ বোধ করছেন, আর সস্তায় বাড়ি পেয়েও যাচ্ছেন। তবে এখানে শিয়া এবং সুন্নি মুসলিমের অনুপাত সমান সমান এবং উভয়ের মধ্যে অশান্তি কিন্তু লেগেই থাকে। সুন্নিরা বেশির ভাগই কাবাড়িওয়ালা। এ বার আপ এবং কংগ্রেস একজোট হওয়ায় মুসলিম ভোটের ভাগাভাগি হবে না বলেই মনে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এখানকার কংগ্রেস প্রার্থী কানহাইয়া কুমারের ভোটের ভবিষ্যৎ যথেষ্ট ভালই বলব।”

দুপুরের তীব্র তাপ এড়াতে শিবপুরীর বাসিন্দা, পেশায় রাজমিস্ত্রি বাবলু গৌতম বসেছিলেন একটি চায়ের দোকানের ভিতরের অন্ধকারে। “শুনুন আমরা কোনও রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাইনি। ঢোকার মুখে ওই বিরাট খোলা খালটা দেখলেন। আমাদের সয়ে গিয়েছে, কিন্তু গন্ধে বমি এসে যাবে বাইরের লোকের। রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না, এত সরু আর খোঁদলে ভর্তি। আর কবে উন্নয়ন হবে এখানে? গত ১০ বছর সুযোগ পেয়েছেন মনোজ তিওয়ারি, করেছেন কিছু? এ বারেও প্রচার শুরু করছেন, ভারত মাতা কি জয় বলে, শেষ করছেন টুকরে টুকরে গ্যাংয়-এর বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে। আমরা চার বছর শান্তিতে আছি, সে ভাবেই থাকতে চান সাধারণ মানুষ।”

মুসলিম পল্লি অর্থাৎ মুস্তাফাবাদের মনে কিন্তু যথেষ্ট ভয়। কথা শুরু করা মাত্রই স্থানীয় হিন্দুরা অন্তত জোর গলায় বিজেপি লোকসভা প্রার্থী বা আপ বিধায়কের বিরুদ্ধে, অথবা উন্নয়নের পক্ষে জোর গলায় আওয়াজ তুলছেন। মুসলিম সমাজ কিন্তু কী ভাবছেন খোলাখুলি প্রকাশ করতে চাইছেন না, রেখে ঢেকে কথা বলেছেন। মুস্তাফাবাদে বিরাট স্কুল ইউনিফর্মের দোকান রাশিদ কুরেশির। ধীরে কথা বলা এই প্রবীণ মানুষটিকে দেখেই বোঝা যায় কোনও হাঙ্গামার মধ্যে থাকতে চান না। কিন্তু না চাইলেও তাঁর ‘জি এস স্কুল ইউনিফর্ম’-এর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সংঘাতকালে। বলছেন, “আমরা গোটা দিনই কাজকর্ম নিয়ে থাকি, তা-ও ব্যবসায় গত কয়েক বছর ধরে মন্দা। স্কুলে ভর্তির মরসুমে বিক্রিবাটা ভাল হয়, অন্য সময় বাজারে তেজি নয়। লোকের হাতে টাকা কোথায় যে খরচ করবে?”

সে না হয় হল, কিন্তু ভোটটা কাকে দেবেন এবার? নির্বিবাদী মানুষটি বলে চলেন, “দেখুন আমরা তো বাইরে থেকে আসিনি। এখানকারই লোক প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। আমরা চার বছর আগে হেডলাইনে চলে এসেছিলাম ভুল কারণে। অনেক নেতা আমাদের নিয়ে বক্তৃতাও দিলেন দেখলাম। কিন্তু কোনও নেতা এসে দেখেছেন এই এলাকা আবর্জনার ডিপো হয়ে গেছে, জলে পচন ধরেছে, দুর্গন্ধ? এখানে দাঙ্গার পর বহু মানুষের কাজ গিয়েছে। অনেকেই তাদের রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ হিন্দুরা আর সেই সময়ে মুসলিমদের দোকানে খেতে চাইছিলেন না। দারিদ্রের চিহ্ন এখন এখানে সর্বত্র। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে, দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে কথা হোক। আমরা হিন্দু-মুসলিম নিয়ে রাজনীতির নরক দেখে নিয়েছি।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 Spot Reporting Delhi

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}