প্রচারের ফাঁকে মহম্মদ সেলিম। মুর্শিদাবাদের রানিনগরে। — নিজস্ব চিত্র।
খেটে খাওয়া মানুষের ভিড় সবে পাতলা হয়েছে। সমাবেশ শেষে শেখপাড়ার স্কুলের আধো অন্ধকার মাঠে জনতা এবং সমর্থকদের নানা আবদার মিটিয়ে প্রার্থী গিয়ে বসেছেন একটু দূরে দলীয় নেতার ঠেকে, ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি শুকিয়ে নেবেন বলে। সেখানেও ছাড় নেই। কেউ এসে বলছেন, স্কুল চাই আরও, ব্যবস্থা করে দিন। একেই তো এত শিক্ষকের চাকরি যাচ্ছে, গরমের ছুটির পরে এখনকার স্কুলে পড়ানোর লোক থাকলে হয়! চায়ের কাপ হাতে নিয়ে প্রার্থী বলছেন, জমির ব্যবস্থা করে দিন। স্কুল হয়ে যাবে। সিভিক ভলান্টিয়ার এসে শোনাচ্ছেন, কেমন অনিয়মের মধ্যে দিন চলছে।
এই দরবার দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে, ইনি প্রার্থী? না এলাকার জনপ্রতিনিধি? জলঙ্গি, ডোমকল, রানিনগর, ইসলামপুর, ভগবানগোলা, করিমপুরের গ্রামে-বাজারে মহম্মদ সেলিমকে ঘিরে যা চলছে, সে সব দেখলে উত্তরটা বারবার গুলিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
বিকেলের রোদে জলঙ্গির ধুলোমাখা রাস্তায় দেখে আসা মিছিলটাও উত্তর খোঁজার অভিযানে শামিল। ঢাউস সাউন্ড বক্স, ডিজে-র মিউজ়িক নিয়ে নাচতে নাচতে যাওয়া যে মিছিলের তরুণ বলছিলেন, “চোরের দল টাকা খরচ করছে। যা পাওয়া যাচ্ছে, একটু আনন্দ করে লিই (নিই)!” সেই অনাবিল স্বীকারোক্তির পরে মঞ্চে দেখা দিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের গত পাঁচ বছরের সাংসদ এবং এ বারেরও তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী আবু তাহের খান। সঙ্গে বহরমপুরের তারকা-প্রার্থী ইউসুফ পাঠান। তাহেরের বক্তব্য, “বিজেপিকে হারানোর ভোট এটা। বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলায় এবং দেশে লড়ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনাদের জন্য কী করেননি তিনি?” দিদির নামে ভোটে ফের লড়তে নেমে গেলেও গুরুতর অসুস্থতার ধকল কাটিয়ে তাহের এখনও মেঠো রাজনীতিতে স্বচ্ছন্দ নন। সেই সঙ্গেই পাঁচ বছরে তাঁকে সব সময় দেখতে না পাওয়া, সংসদে তাঁর ‘নীরবতা’ আর তার উল্টো দিকে সিপিএম প্রার্থী সেলিমের সংসদে পুরনো ভাষণের ভিডিয়ো-প্রচার— এই দুইয়ে মিলে বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। তাহেরের মিছিলে লোকে নাচছে, সেলিমের সভার পরে দাবি-দাওয়া নিয়ে দরবার চলছে।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরেও বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হয়েছিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র। লোকসভা ভোটে সেই প্রথা ভাঙা লড়াই-ই আরও বড় করে লড়ছেন দলের বর্তমান রাজ্য সম্পাদক সেলিম। লড়ছেন মানে কোমর বেঁধে যুদ্ধে নেমেছেন! সিপিএমের সব গণ-সংগঠন রাজ্য সম্পাদকের হয়ে ময়দানে। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, ঐশী ঘোষ-সহ মহিলাদের টিম নানা এলাকা চষে ফেলেছে। সঙ্গে রয়েছে কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ডোমকলে দাঁড়িয়ে তাঁর দলের কর্মী-সমর্থকদের বলে গিয়েছেন, “দরকারে জান দিয়ে দেবেন, তবু সেলিম ভাইকে হারতে দেবেন না।” ডোমকল, হরিহরপাড়ায় কংগ্রেস-সিপিএম সংঘর্ষের সেই রক্তাক্ত অতীত পাশে সরিয়ে রেখে দু’দল এখন পাশাপাশি।
কাঁটাবাড়ির ছোট ব্যবসায়ী ইমানুল বিশ্বাস বলছিলেন, “মুর্শিদাবাদের সমস্যা অনেক। এখনকার সাংসদ দিল্লিতে কিছু কথাই বলেন না। সেলিম সাহেবের অন্তত মুখ বন্ধ থাকবে না।” হাওয়া বুঝে সেলিমও তাঁর প্রচারে হাতের মাইক দেখিয়ে বলছেন, “আপনাদের মাইক হতে চাই! কথা আপনাদের, আমি পৌঁছে দেব।” এক দিকে কংগ্রেস-সিপিএম সমঝোতা আর অন্য দিকে সাংসদ হিসেবে অতীতের পারফরম্যান্স জোড়া স্বস্তি দিচ্ছে সেলিমকে।
মুর্শিদাবাদ এবং করিমপুর বিধানসভা এলাকায় প্রভাব আছে বিজেপির। মুর্শিদাবাদের বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষকেই এ বারের নির্বাচনে লোকসভার ভোটপ্রার্থী করেছে বিজেপি। কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএমের চক্কর থেকে বেরিয়ে এই লোকসভায় বিজেপিকে একটা সুযোগ দেওয়ার আর্জি জানাচ্ছেন গৌরী। তবে প্রচারের দৃশ্যমানতা যদি কোনও সূচক হয়, গৌরী পিছিয়ে আছেনই বলতে হবে।
সাম্প্রতিক অতীতের নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় ‘ভোট লুটে’র আশঙ্কাও চোরা স্রোতের মতো আছে কোথাও কোথাও। তবে রানিনগরে সিপিএমের এরিয়া কমিটির সম্পাদক জুলফিকর আলি ভুট্টোর দাবি, “এ বার ভোট লুট করতে এলে মানুষ তৈরি আছে। ডোমকল, রানিনগর, ইসলামপুর সব দিকেই।” কংগ্রেসের সব ভোট বামে আসবে? সিপিএমের জেলা সম্পাদক জ়ামির মোল্লার দাবি, এ বার জোট আগের চেয়ে অনেক মসৃণ।
প্রচার তো হল। এ বার ভোট? তৃণমূলের তাহের মনে করাচ্ছেন, “পঞ্চায়েত, বিধানসভা, লোকসভা কোনও ভোটে আমি কিন্তু হারিনি!” আর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে যাঁকে ‘বাজপাখি’ বলে গিয়েছেন? তিনি চোখ রেখেছেন শিকারেই। “অনেকে অনেক কিছু বলেছে, বলবে। কিন্তু এই ভোটের ফল বেরোনোর পরে বাংলায় সিপিএম শূন্য, এ কথাটা বলা বন্ধ হবে।” চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে রাতের টহলে বেরিয়ে পড়লেন সেলিম।
বিধানসভা ভোটের অঙ্কে কেন্দ্র ‘মাইনাস’, দলও শূন্য। সেই গহ্বর থেকে ‘প্লাসে’ পৌঁছনোর মরিয়া লড়াই দেথছে মুর্শিদাবাদ। কঠিন যুদ্ধের মধ্যেই বাম-কংগ্রেস মহলে রসিকতা চলছে, আলিবর্দি-সিরাজদের আমলে সুবে বাংলার যা ছিল রাজধানী, এ বার সেই মুর্শিদাবাদকেই বলতে হবে ‘জোটের রাজধানী’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy