Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

বাইরে ‘হাওয়া নেই’, মোদীতেই ঝুঁকে সিআর পার্ক

দীর্ঘদিন ধরেই এখানে কংগ্রেসের পতাকা অদৃশ্য। এমনকি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা শর্মিষ্ঠাও এই এলাকার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছিলেন।

PM Narendra Modi

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৪ ১০:১৪
Share: Save:

প্রবাসে দৈবের বশে কচি পাঁঠার পাতলা ঝোলে এমন আস্ত আলু দিতে পারেন একমাত্র সত্যদা! বাইরে অশৈলি নৃত্য করছে লু, তাপমাত্রা পঁয়তাল্লিশ ছাড়িয়েছে সেই কখন। এমন ভয়াবহ তাণ্ডবে অতি সহজপাচ্য মাংসের ঝোল খাওয়ার সুযোগ প্রবাসীকে দিতে পারেন একমাত্র সত্যদা ওরফে সত্যরঞ্জন দত্ত। রাজধানীর বাঙালির প্রিয় নিবাস চিত্তরঞ্জন পার্কের দু’নম্বর মার্কেটের কোনা ঘেঁষে ‘মা তারা রেস্তোরাঁ’র মালিক। কিষাণগঞ্জের এই বঙ্গসন্তান সত্তরের দশকের শেষ থেকেই এই চিত্তরঞ্জন পার্কে।

“মানুষের উৎসাহ এ বার ভোট নিয়ে কম, বুঝলেন? ভাবটা এমন, দূর, এই গরমে কষ্ট করে বুথে গিয়ে হবেটা কী! মোদী বিনামূল্য রেশন দিয়ে মানুষের মন জয় করে বলছেন, তিনিই গরিবদের খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু এই যোজনা তো মনমোহন সরকারের আমলের। আমাদের মতো ছোট দোকানদারদের তো করের জালে ফাঁসিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। আমাদের মতো হাতে বানানো রুটি আর কেউ করতে না এই তল্লাটে। তাই কোভিডের সময় টিকে থাকতে পেরেছি। আশপাশের সমস্তথানা, বাড়িতে টানা ওই রুটি আর তরকারি বিক্রি করে টিকে থেকেছি,” জানাচ্ছেন এই দু’নম্বর মার্কেটের সবার প্রিয় সত্যদা।

তিনি প্রিয়, কিন্তু এখানে রাজনৈতিক ভাবে সংখ্যালঘুও বটে। ভোটের চব্বিশ ঘণ্টা আগে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই মনে হল। বিরাট মোদী হাওয়া রয়েছে এলাকায়, বিষয়টি এমন নয়। বরং এ বারের ভোটে চিত্তরঞ্জন পার্ক যেন কিছুটা আড়ালেই। সত্তরের দশকের গোড়া থেকে দিল্লির ভোট দেখার স্মৃতি রয়েছে কমলা নেহরুকলেজের দর্শনের প্রাক্তন অধ্যাপিকা, বি ব্লকের বাসিন্দা মালবিকা সেন মজুমদারের। বলছেন “এ বারের মতো শুনশান ভোটবাজার কোনও বার দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আগে আমাদের ব্লকের মাঠে ভোটের আগে সব দলেরই বক্তৃতা হত। এ বার কোনও প্রচারের আওয়াজ নেই। বিজেপি-র প্রাক্তন কাউন্সিলর আনন্দ মুখোপাধ্যায় অসুস্থ। আপ-এর নেতারা মনে হয় দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লির কানহাইয়া কুমার আর চাঁদনি চকের আসন নিয়েই বেশি লড়াই দিচ্ছে।” মালবিকার মতে, “এখানকার বাঙালিদের মধ্যে রাজনীতির প্রশ্নে মিশ্র মানসিকতা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেজরীওয়াল যে বক্তৃতা দিচ্ছেন, তা যেন কিছুটা লক্ষ্যচ্যূত হয়ে যাচ্ছে। নিজে কী কাজ করেছেন, তার বিশদ উল্লেখ না করে, তাঁর জেল যাওয়াএবং মোদীকে আক্রমণের দিক নিয়েই বেশি বলছেন।”

“এখানে দুর্গাপুজো হচ্ছে আর সুষমা স্বরাজ আসছেন না, এমন কখনও হয়নি। সঙ্গে নিয়ে আসতেন তাঁর ছোট্ট মেয়েকে। একবার তো আনন্দ মুখোপাধ্যায়ের হয়ে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ে বাঁশুরী এখন বড় হয়ে নয়াদিল্লি লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর প্রতি এখানকার বাঙালিদের একটা স্বাভাবিক টান তো থাকবেই”, জানালেন এক নম্বর মার্কেটের সবচেয়ে ব্যস্ত বিল্ডার-প্রোমোটার যাদবচন্দ্র দে। তেষট্টি সালে সীমান্ত পার হয়ে বরিশাল থেকে সোজা দিল্লি চলে এসেছিলেন সপরিবার। তার পর তিলে তিলে তৈরি করেছেন নিজের পায়ের তলার জমি। এক নম্বর মার্কেটের বিখ্যাত কালীমন্দিরের নির্মাণ শুরু হয়েছিল তাঁর উদ্যোগ এবং পরিশ্রমে। নিজে কালীভক্ত, ‘মায়ের ইচ্ছা’ ছাড়া কথা বলেন না। রামমন্দির নির্মাণ সংক্রান্ত পুণ্যের ফল স্থানীয় ভোট বাজারে পড়বে বলেই মনে করেন যাদববাবু। “এখানে সনাতন হিন্দু বাঙালিরা রয়েছেন। যাঁরা দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার ফলে রামকে নেহাৎ কোনও বইয়ের চরিত্র নয়, উত্তর ভারতীয়দের মতোই অবতার বলে মান্য করেন। প্রবাসে রাম রাম বলার তাৎপর্যই ভিন্ন।”

দীর্ঘদিন ধরেই এখানে কংগ্রেসের পতাকা অদৃশ্য। এমনকি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা শর্মিষ্ঠাও এই এলাকার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছিলেন। ‘জয় মা তারা দুর্গা ভান্ডারের’ মালিক পশ্চিম মেদিনীপুরের লোক পিন্টু মণ্ডল। বলছেন, “আগেও মূল্যবৃদ্ধি ছিল, এখনও রয়েছে। নতুন কিছু তো নয়। আমরা ৪৫ হাজার টাকা দোকানের ভাড়া দিয়ে ঠাকুরের আশীর্ব্বাদেব্যবসা তো করে যাচ্ছি গত দশ বছর। এখন তো গরম। সন্ধ্যার দিকে আসুন, আপনার সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলারই সময় পাব না এত ভিড়!” তাঁর কথায় যে দম রয়েছে, তা নির্বাচনের সংখ্যাতত্ত্বই বলে দিচ্ছে। এর আগের দু’টি লোকসভা নির্বাচনে দিল্লি লোকসভার সবক’টি আসনে ঝড় তুলে জিতেছে বিজেপি। বিধানসভায় আপ-এর আধিপত্যকে শিকেয় তুলে কেন্দ্রের ভোটে দিল্লিবাসী ঢেলে ভোট দিয়েছে মোদীকে। আবার যেই পুরসভা ভোট হয়েছে, চিত্তরঞ্জন পার্ক-এর ওয়ার্ডে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। সাম্প্রতিক নির্বাচনে মাত্র ৪০৪ ভোটে জিতেছেন আপ প্রার্থী।

যার খ্যাতি গোটা রাজধানী জুড়ে, সেই সিআর পার্ক মাছ বাজারেও রয়েছে আপ-এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ। ট্যাংরা, চিতল, পাবদায় জল ছেটাতে ছেটাতে টাবু রায় বলছেন, “মহল্লা ক্লিনিকে গিয়ে দেখুন কী হাল হয়েছে! সবই তো বন্ধ। আমরা মাছের ব্যবসায়ী, আমাদের তিনশো লিটার জল লাগে প্রতি দিন। কেজরীওয়ালের সরকার যা জল দেয়, তাতে কিছুই হয় না। না-বাড়িতে, না-বাজারে। আমাদের আলাদা করে কিনতে হয়। বিজলি দুশো ইউনিট বিনা পয়সায় দিচ্ছে, কিন্তু দুশো এক ইউনিট খরচ হলেই পুরোটার দাম দিতে হচ্ছে। এলাকায় একটা বড় সরকারি হাসপাতাল নেই। এইমস-এ গিয়ে লাইন দেওয়ার সময় কি আছে আমাদের? সরকারি স্কুল ছাড়া আর কিছুই নেই কেজরীওয়ালের, সাধারণ মানুষের জন্য।”

চিত্তরঞ্জন পার্কের হাওয়া যে মোদীর দিকেই বইছে, তা স্পষ্ট। এ কথা আরও স্পষ্ট হয়ে গেলঅন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডারে গিয়ে দরবেশ আর বোঁদে কেনার সময়। “দেখুন রাজ্যের ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। বিধানসভা ভোটের সময় আসুন, তখন বুঝিয়ে বলব। কিন্তু এটা দেশের ভোট। সেখানে মোদীর কোনও বিকল্প নেই। ইন্ডিয়া জোট যে সরকার গড়তে পারে, এটা কেউ বিশ্বাস করছেন না। কিন্তু এটা সবাই মানেন যে, মোদী শত্রুশিবিরে ঢুকে গিয়ে জঙ্গিদের মেরে আসার ক্ষমতাধরেন। বিদেশের মাটিতে দেখবেন তাঁর কী দাপট! এটা ঠিকই যে, এ বারে আমরা বাঁশুরি স্বরাজ বা কোনও বিজেপির বড় নেতাকে আসতে দেখিনি প্রচারে। কিন্তু তার দরকারও নেই। এখানের বাঙালি ভোট মোদীকেই দেবেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE