Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

ভোটের হাওয়া উধাও, খেলার দরকারই নেই!

দেওয়াল লিখনে ভোট আছে ঠিকই, মোদী আসছেন, মমতা-অভিষেক আসছেন জেলায়, সে নিয়ে চর্চার আগ্রহও নেহাৎ কম নয়। সেই সব জনসভায় ভিড়ও হচ্ছে পর্যাপ্ত।

—প্রতীকী ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
বোলপুর শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৪ ০৮:১৪
Share: Save:

ভোট কবে?

শ্রী পল্লীর চা-এর দোকানিকে প্রশ্নটা করতেই তিনি দু’এক মুহূর্তে থমকালেন। তার পরে পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘এই ভোট কবে রে?’’ মুখ না তুলে বাসন মাজতে মাজতেই দ্বিতীয় জনের উত্তর, ‘‘এই তো সামনেই কবে যেন।’’ দোকানে যে ক’জন খদ্দের ছিলেন, তাঁরাও মনে করতে পারলেন না এলাকায় ভোট-টা ঠিক কবে! বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের অধিকাংশ এলাকায় ভোটের দিনক্ষণই বলতে পারছেন না অনেকে।

দেওয়াল লিখনে ভোট আছে ঠিকই, মোদী আসছেন, মমতা-অভিষেক আসছেন জেলায়, সে নিয়ে চর্চার আগ্রহও নেহাৎ কম নয়। সেই সব জনসভায় ভিড়ও হচ্ছে পর্যাপ্ত। কিন্তু ভোটের যে আবহ দেখতে অভ্যস্ত বোলপুর কেন্দ্র, এ বার তা কই? কলকাতা-দিল্লি থেকে বড় বড় নেতারা যতই যাতায়াত করুন, স্থানীয় স্তরে ভোট ঘিরে তৎপরতা এ বার চোখে পড়ার মতো কম।

যে বোলপুর থেকে গত কয়েকটি নির্বাচনে একের পর এক গা গরম করা স্লোগান উঠে এসেছে, যে স্লোগান পরবর্তী সময়ে গোটা রাজ্য জুড়ে বিতর্ক তৈরি করেছে, সেই বোলপুরের এ হেন মূর্ছা যাওয়ার দশা কেন? তাপমাত্রার পারদ কি এতটাই ধরাশায়ী করল এই কেন্দ্রকে?

এক বারের সাংসদ তথা বোলপুরের তৃণমূল প্রার্থী অসিত মাল বললেন, “না না, মূর্ছা যায়নি কেউই। রণনীতিটা বদলেছি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেশি প্রচার হয়েছে। তা ছাড়া, সারা বছর কাজ করলে ভোটের সময়ে এত বেশি তর্জন-গর্জন লাগে না!” এই বক্তব্যের পর অনিবার্য ভাবেই যে প্রশ্নটা উঠে আসে তা হল, আপনি কি বলতে চাইছেন অনুব্রতর আমলে সে ভাবে কাজ হত না? গর্জন আর বর্ষণেও অনেকটা ফারাক থাকত? অসিতবাবু বললেন, “সে কথা কোথায় বললাম? আসলে সংলাপ-স্লোগানের বদলে কাজের উপরে জোর দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে। সংলাপ দু'দিনের, কাজ তো বরাবরের। তা ছাড়া নীতি তো বদলাতেই পারে!”

শুধু ‘নীতি বদল’ নয়, ভোটের বাজারে একেবারে যেন চেহারা-চরিত্রই বদলে ফেলেছে বোলপুর। এই কেন্দ্রের অধীনে মোট ৭টি বিধানসভা কেন্দ্র। তার মধ্যে আবার তিনটি পূর্ব বর্ধমান জেলার মধ্যে পড়ে। গত বার এই লোকসভা কেন্দ্র থেকে অসিত জয়ী হন। তার আগে ২০০৯ সালে এখানে কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট প্রার্থী ছিলেন তিনি।
হেরেছিলেন সিপিএমের রামচন্দ্র ডোমের কাছে। ২০১৪ সালে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। তার পরে একবার বিধানসভা নির্বাচনে হেরে ২০১৯-এ এই কেন্দ্র থেকে লোকসভা ভোটে জেতেন। বস্তুত ২০১৪ সাল থেকেই অনুব্রত মণ্ডলের খাস তালুক হয়ে ওঠে এই কেন্দ্র। সে বার অনুপম হাজরা সাংসদ হলেও পরবর্তী সময়ে অনুপমের উপরে রুষ্ট, বিরক্ত হতে শুরু করেন অনুব্রত-সহ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। অনুপমের পরিবর্তে ২০১৯-এ প্রার্থী হন অসিত।

এ বার তিনি যতই কাজের তত্ত্ব দিন না কেন, এলাকার মানুষের ক্ষোভ, গত পাঁচ বছরে কোনও কাজই হয়নি। রাস্তা বেহাল, পানীয় জলের প্রবল সঙ্কট, বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবা, তালিকাটা নেহাৎ সংক্ষিপ্ত নয়। কিন্তু তাতে জেলা নেতৃত্ব কি আদৌ ঘাবড়াচ্ছেন? প্রশ্ন সহজ হবে জানা থাকলে যেমন পরীক্ষার আগে তেমন ভয় থাকে না, এ ক্ষেত্রেও কি তা-ই? প্রধান বিরোধী প্রার্থীর 'দুর্বলতা'ই কি বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে তৃণমূলকে? কারণ, বিজেপি প্রার্থী প্রিয়া সাহাকে নিয়ে শুরু থেকেই তো দলের অন্দরে হাজারো ক্ষোভ।

কীর্ণাহারের রাস্তায় প্রিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কিছু পোস্টার চোখে পড়েছে। এলাকার এক বিজেপি কর্মী বললেন, "এ তো কিছুই দেখছেন না। পোস্টারে ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল। উপরমহল থেকে চাপ আসায় বেশির ভাগ পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। কিছু পোস্টার তবু থেকে গেছে। আর থেকে গেছে আমাদের ক্ষোভ। ওটা তো আর ছিঁড়ে ফেলতে পারবে না কেউ।" প্রায় একই সুর শুনেছি নানুরের রাস্তাতেও।

মঙ্গলকোট, আউশগ্রামেও কম-বেশি এক প্রশ্ন। প্রিয়া কেন? সাঁইথিয়ার এই তরুণী ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরে যান। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও তেমন নিবিড় নয়। বোলপুরে বিজেপি-র দফতরের অদূরে দাঁড়িয়ে এক নেতা বলছিলেন, "আমাদের খাটার উৎসাহটাই চলে গেছে। এ রকম একটা কেন্দ্রে কোনও শক্তপোক্ত প্রার্থীকে তো দাঁড় করানো যেত। তা না করে যা করা হল সেটা তো প্রায় এই আসনকে প্লেটে সাজিয়ে তৃণমূলের হাতে তুলে দেওয়া। জেলা নেতৃত্বের কোনও মতামতই নেওয়া হয়নি। এর পরেও আমাদের মনোবল অটুট থাকা সম্ভব?"

প্রিয়া নিজেও ওয়াকিবহাল দলের বড় অংশের অসহযোগিতা নিয়ে। তাই তিনি সর্বত্র 'মোদীকার্ড' খেলছেন। "মোদীজির কথা ভেবে মানুষ আমাকে ভোট দেবেন। গত বেশ কয়েকটা নির্বাচনে তৃণমূলের অত্যাচারে মানুষ ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেননি। এ বার সেটা হতে দেব না।"

এই সব নানাবিধ কৌশলের পাশে অনেকটাই নিঃশব্দে নিজের প্রচার সারছেন সিপিএম প্রার্থী শ্যামলী প্রধান। স্বচ্ছ এবং লড়াকু ভাবমূর্তির জন্য জেলার রাজনীতিতে পরিচিত নাম শ্যামলী।
একাধিক বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে এবং ২০১৬-তে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। ২০২১-এ অবশ্য হেরে যান। কিন্তু তার পরেও এলাকার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কমেনি। ভোটের পাখি হয়ে না থেকে সারা বছর মানুষের প্রয়োজনে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীরাও কটু কথা বলতে পারছেন না।

শ্যামলী নিজে বলছেন, "ফল আমার হাতে নেই। শুধু চেষ্টাটা আছে। মানুষ সব জানেন। তাঁরা যদি নিজেদের ভোটটা দিতে পারেন, এখানে চাকা ঘুরবে।" বলছেন বটে, তবে অনেকেই বলছেন, সেই সুরে তেমন দম নেই।

ম্যাড়মেড়ে বোলপুরে এ বারও হয়তো 'খেলা হবে'। কিন্তু বাতাসে খেলার উত্তেজনাই উধাও। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের
এক অধ্যাপক হাসতে হাসতে বললেন, "এখানে অনেক কিছুই উল্টেপাল্টে গেছে। তাই রুদ্ধশ্বাস খেলার হয়তো দরকারও নেই। শাসক দল বলছে, 'কোন খেলা যে খেলব কখন ভাবি বসে সেই কথাটাই', আর বিরোধীরা তাদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলছে, 'তোমার আপন খেলার সাথী করো, তা হলে আর ভাবনা তো নাই।"

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2024 Spot Reporting Bolpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy