E-Paper

মতুয়া হাওয়া পালে টানতে মরিয়া লড়াই

রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি এ বারও প্রার্থী করেছে জগন্নাথ সরকারকে। বিপরীতে সদ্য বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়া মুকুটমণি অধিকারী। সিপিএম ভরসা রেখেছে অলোকেশ দাসের ওপর।

মতুয়া প্রধান রানাঘাট লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ-কে হাতিয়ার করছে রাম-ডান দুই পক্ষই।

মতুয়া প্রধান রানাঘাট লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ-কে হাতিয়ার করছে রাম-ডান দুই পক্ষই। —ফাইল চিত্র।

চন্দন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২৪ ০৭:৪২
Share
Save

‘‘বিজেপির তাস তো সিএএ। নাগরিকত্বের গোলকধাঁধায় ফেলে ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছে। কিন্তু কী ভাবে ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা’ তুলতে হয়, জানি। অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পে ১৯ লক্ষ নাগরিকের সঙ্গে কী কী হয়েছিল, ঘরে ঘরে গিয়ে বলছি।’’ ভোট আলোচনার ফাঁকে গড় গড় করে বলে গেলেন শান্তিপুরের শাসক তৃণমূলের এক পুরপ্রতিনিধি। তার পরে একটু থেমে যোগ করলেন, ‘‘সিএএ-র ভয়টা বোঝাতে পারলেই...।’’ দূরে বসে থাকা এক তৃণমূল কর্মী পাদপূরণ করলেন, ‘‘কেল্লা ফতে!’’

ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, মতুয়া প্রধান রানাঘাট লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ-কে হাতিয়ার করছে রাম-ডান দুই পক্ষই। তখন ‘হাওয়া’ ঘোরানোর এই মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কার্যত সিএএ-দাপটেই চাপা পড়ে যাচ্ছে নদীভাঙন, তাঁত শিল্পীদের হতাশার মতো এলাকার মূল সমস্যাগুলি।

রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি এ বারও প্রার্থী করেছে জগন্নাথ সরকারকে। বিপরীতে সদ্য বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়া মুকুটমণি অধিকারী। সিপিএম ভরসা রেখেছে অলোকেশ দাসের ওপর। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা নদিয়া জেলার রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্র মোট ভোটারের ৪৮ শতাংশ মতুয়া। ফলে প্রার্থীর জেতা-হারায় মতুয়ারা কোন পক্ষ নেবেন, তার উপর নির্ভর করে এখানকার ভোটের ভাগ্য। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে মতুয়া ভোটের বড় অংশ গিয়েছিল বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকারের দিকে। ২০২১ বিধানসভা ভোটেও তার বিশেষ নড়চড় হয়নি। লোকসভা আসনের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ছ’টিতেই জয়ী হয়েছিল বিজেপি। পরে উপনির্বাচনে তৃণমূল শান্তিপুর আসনটি জেতে। এ বাদে আর নবদ্বীপ ছাড়া বাকি সব আসনই বিজেপির দখলে। ফলাফল এখনও ৫-২। তাই লোকসভা ভোটে মতুয়া ভোটকেই ‘টার্গেট’ করছে সব রাজনৈতিক দল।

মতুয়া এলাকায় বাড়তি নজর দিচ্ছে শাসক তৃণমূল। শক্ত মাটিতে ‘ফসল’ ফলানোর চেষ্টার কসুর রাখছেন না তৃণমূল প্রার্থী মুকুটমণি। তাঁকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাচ্ছে দীর্ঘ দিন বিজেপির সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা। তাঁর কথায়, ‘‘রানাঘাটে বিজেপির সংগঠনটা আমি ছাড়া দেখার কেউ ছিল? পুরোটাই আমার হাতের তালুর মতো চেনা। শক্তি, দুর্বলতা— সবটাই জানি। ওরা চাইবে, টাকা ছড়িয়ে শেষ হাসি হাসতে। কিন্তু হাওয়া ঘুরছে।’’ এমনকি রাজ্য সরকারের জনমুখী প্রকল্পের সাফল্য ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হবে— সেই সুরও শোনা গেল তাঁর কণ্ঠে।

তবে বেসুরো গানও আছে। বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসে মুকুটমণির প্রার্থী হওয়ায় দলের নিচুতলার ছোট-মাঝারি নেতাদের অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। নেতৃত্বের ধমকি-চমকিতে শেষ মুহূর্তে কিছু জনকে মাঠে দেখা গেলেও উৎসাহে খামতি চোখে পড়ছে। বীরনগর পুরসভায় ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে একটি মাঠের পাশে বসে গল্প করছিলেন জনাকয়েক। তাঁদের একজন বললেন, ‘‘শাসকদলের ভোট-মেশিনারি সামলানো কয়েক জন তো প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে ঝিম মেরে রয়েছেন। লোক আছে, জন আছে, কিন্তু জোশটাই যেন বোঝা যাচ্ছে না।’’ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ‘কাটা’ বিজেপিতেও। কয়েক জনের হঠাৎ ‘উড়ে’ এসে ‘ছড়ি’ ঘোরানোকে মেনে নিতে পারছেন না নিচুতলার অনেকে। প্রার্থী যদিও সে সব পাত্তা দিতে নারাজ। জগন্নাথ সরকারের কথায়, ‘‘এখানে যে যা-ই বলুক, প্রথম স্থান নিয়ে কোনও লড়াই নেই। ওটা আগেই মানুষ ঠিক করে নিয়েছেন। বাকিরা কে দুই হবে, কে তিন, তার জন্য লড়ছেন।’’

তবে রানাঘাটের ভোট ময়দানে দুই দলই বামেদের আলাদা সমীহ করছে। লোকসভা ভোটে বামেরা তাঁদের ভোট ফেরাতে পারলে দাবার ছকের হিসাব যে সব উল্টে পাল্টে যেতে পারে, তা মেনে নিচ্ছে রাজনৈতিক মহলও। ভোট ফেরানোর চেষ্টায় কসুর রাখছেন না সিপিএম প্রার্থী অলোকেশ দাসও। এলাকা ঘুরে চলছে তাঁদের প্রচারও। প্রতি এলাকার সমস্যাকে আলাদা করে প্রচারে তুলে ধরছেন। সেখানে যেমন এসএসসি-র চাকরি বাতিল, নিয়োগ দুর্নীতির প্রসঙ্গ থাকছে, তেমনই আসছে শান্তিপুরের তাঁতিদের সমস্যা।

প্রতি ভোটে তাঁতিদের নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইলেও তাঁদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। বরং হাতে বোনা তাঁতকে আধুনিক প্রযুক্তির মুখে পড়ে কড়া টক্করের সামনে পড়তে হচ্ছে। তাঁতিপাড়ার যন্ত্রণা আরও বাড়িয়েছে বছরের পর বছর নদী ভাঙন। বছর তিন আগে নিজের ভিটে তলিয়ে যেতে দেখেছিলেন শান্তিপুর বিধানসভার বেলগড়িয়া ২ নম্বর পঞ্চায়েতের দীনবন্ধু বিশ্বাস। সেই থেকে আত্মীয়ের ফেলে রাখা কুঁড়ে ঘরই আশ্রয়। উঠোনে বসে শোনালেন, ‘‘ও-পার বাংলা থেকে সব ফেলে চলে এসেছিলাম। এ-পারে এসেও রাখতে পারলাম না। সকলে শুধু আশ্বাস দিল। সুরাহা কেউ করল না।’’

কর্মসংস্থান, বিগত পঞ্চায়েত ভোট দিতে না পারার আক্ষেপের চোরা স্রোতও রয়েছে এলাকায়। যা তৃণমূলকে স্বস্তিতে রাখছে না। কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভার গ্রামের রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক জন মহিলা। ভোট আলোচনার মাঝে তাঁদের এক জন উত্তর দিলেন, ‘‘৫০০-১০০০ হাজার টাকার লক্ষ্মীর ভান্ডারে কী হবে? ছেলে-মেয়ে তো চাকরি পাচ্ছে না! অনার্স নিয়ে পাশ করে সব ঘরে বসে রয়েছে।’’ তার পরেই খেদোক্তি, ‘‘এত দূর পড়া-লেখা শেখানো তো ওদের লক্ষ্মীর ভান্ডার নেওয়ার জন্য নয়!’’ পঞ্চায়েতে ভোট দিতে না দেওয়ার ক্ষোভের আগুন রয়েছে। চাকদার কালিবাজারে দোকানে আড্ডায় দাঁড়িয়ে স্থানীয় এক যুবক বললেন, ‘‘সে দিন আগুন জ্বলেছিল। ঘর থেকে কাউকে বার হতে দেয়নি। যারা বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে এত সব করল, তারাই এখন ভোট চাইতে আসছেন। কিন্তু সব কি সহজে ভোলা যায়?’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 Spot Reporting Ranaghat

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।