কাশী বিশ্বনাথ করিডরের সামনে শিবের সাজে নকুল। —নিজস্ব চিত্র।
মাথায় শিবের মতো নকল জটা। তাতে লাল, সাদা ফুল সাজানো। গলায় জড়ানো প্লাস্টিকের সাপ ফণা তুলে রয়েছে। মুখে নীল রঙ। কপালে ত্রিনয়ন। পরনে বাঘছালের নকশা করা পোশাক। নকল রুদ্রাক্ষের মালা। এক হাতে থালায় প্রদীপ জ্বলছে। সঙ্গে হলুদ, লাল সিঁদুর। অন্য হাতে ছোট্ট ঠান্ডা পানীয়ের বোতল।
মহাদেব কি ‘কোল্ড ড্রিঙ্ক’ পছন্দ করেন? প্রশ্ন শুনে চোদ্দো বছরের নকুল ফিকফিক করে হাসে। বাড়ি তার বারাণসীর চেতগঞ্জে। রোজ সকালে শিব সেজে কাশী বিশ্বনাথ করিডরের সামনে চলে আসে। পুণ্যার্থী, বিদেশি পর্যটকদের কপালে সিঁদুরের তিলক কেটে দিয়ে পয়সা চায় নকুল। বাড়িতে বাবা-মা থাকলেও সংসার চলে না। তাই পেটের দায়ে শিব সেজে ভিক্ষে। তবে কেউ ঠান্ডা পানীয়ের বোতল কিনে দিলে নকুলের মন খারাপ কেটে যায়।
তখন খুশি মনে গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে কাশী বিশ্বনাথ করিডরের দিকে দেখায় নকুল। ‘‘এখানে গলিতে একটা দোকানে বাবা কাজ করত। অনেক পুরনো বাড়ির নীচে দোকানটা ছিল। পাশে ছিল শিবমন্দির। সব ভেঙে ফেলেছে করিডর তৈরির সময়।’’
একটি-দু’টি বাড়ি নয়। বারাণসীর সাংসদ হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের প্রকল্প ‘কাশী বিশ্বনাথ করিডর’ তৈরি হয়েছে। তার জন্য শ’তিনেক চার-পাঁচশো বছরের পুরনো বাড়ি, মন্দির ভাঙা পড়েছে। তিন ফুট চওড়া সরু সরু গলি ছিল। গলিতে ষাঁড় ঢুকে পড়লে এগোনো যেত না। সেখানে এখন নতুন সংসদ ভবনের স্থপতি বিমল পটেলের নকশায় তৈরি আলো ঝলমলে বিশ্বনাথ করিডর।
নরেন্দ্র মোদীর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীতে দু’দিন পরেই ভোট। তার আগে বারাণসীতে রাজনৈতিক বিতর্কের সব থেকে বড় বিষয় কাশী বিশ্বনাথ করিডর। এক দিকে বিজেপির দাবি, করিডর তৈরির পরে বারাণসীতে দেশ-বিদেশের পর্যটকের ঢল নেমেছে। অন্য দিকে সমাজবাদী পার্টি তথা ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের অভিযোগ, মোদী বারাণসীতে এসে তার চরিত্র বদলে দিচ্ছেন। পুরনো শিবমন্দির, ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত বাড়ি ভেঙে করিডর তৈরি হয়েছে। আধ্যাত্মিক শান্তি, জীবনের শেষে ‘মোক্ষলাভের’ ঠিকানা থেকে বারাণসী শুধুই পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠছে।
অস্সী ঘাটের কাছে বারাণসীর বিখ্যাত পাপ্পুর চায়ের দোকান। এক কথায় বারাণসীর কফি হাউস। দিনভর রাজনীতি থেকে সামাজিক সমীকরণ নিয়ে ‘চায়ে পে চর্চা’ চলে। ভোটের আগে সেই আড্ডায় প্রশ্ন উঠছে, মোদীর হাতে পড়ে বারাণসীর আত্মা কি হারিয়ে যাচ্ছে? বারাণসী ছিল ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী। বরুণা থেকে অস্সী নদীর মাঝে বারাণসীতে দেহত্যাগ করলে ‘মোক্ষলাভ’ হবে, এই ধারণায় মানুষ শেষ বয়সে কাশীবাসী হতেন। সেই বারাণসী কি এখন শুধুই পর্যটন ব্যবসায় ফায়দার অঙ্ক কষছে?
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক থেকে কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতির কারবারিদের ভিড়ে ঠাসা এই চায়ের দোকানকে কেন্দ্র করে হিন্দি সাহিত্যিক ‘কাশী কা অস্সী’ নামের বই লিখেছিলেন। পাপ্পুর দোকানে বসেই সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক হতাশা প্রকাশ করছিলেন, ‘‘কাশী কা অস্সী বইতে বারাণসীর যে জীবনযাত্রা ফুটে ওঠে, তা আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। পুরনো বাড়ি, মন্দির ভেঙে যখন করিডর তৈরি হল, তখনই ভয় পেয়েছিলাম। কাশীর চরিত্র বদলে এ বার আর পাঁচটা পর্যটন কেন্দ্রের মতো হয়ে যাবে।’’
বারাণসীর বিধায়ক নীলকণ্ঠ তিওয়ারির বক্তব্য, ২০২১-এর ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাশী বিশ্বনাথ করিডর উদ্বোধন করেছিলেন। তার পরের দু’বছরে ১৩ কোটি মানুষ বিশ্বনাথ ধামে এসেছেন। ২০১৯-এ কোভিডের আগে কাশীতে মাত্র ৬৯ লক্ষ মানুষ এসেছিলেন। আগে শ্রাবণ মাসে দিনে দু’লক্ষ পুণ্যার্থী বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিতে গেলে দমবন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হত। ছ’সাত ঘণ্টা লেগে যেত বিশ্বনাথের দর্শন করতে। এখন ভিড় সামলাতে অসুবিধা হয় না। নীলকণ্ঠের দাবি, নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে কাশীতে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনরুত্থান হচ্ছে।
উল্টো দিকে সমাজবাদী পার্টির নেতা বিবেক সিলাশের অভিযোগ, ‘‘করিডর তৈরির সময় মন্দির ভেঙে ১৬০টি শিবলিঙ্গ তুলে ফেলা হয়েছে। এখনও লঙ্কা থানায় গেলে দেখবেন, সমস্ত শিবলিঙ্গ পড়ে রয়েছে। নরেন্দ্র মোদী বলেন, মা গঙ্গা তাঁকে দত্তক নিয়েছেন। গঙ্গা সাফ করার শপথ করেছিলেন। সেই মা গঙ্গায় অস্সী নালার নোংরা জল পড়ছে। উনি বারাণসীর জন্য কারখানা আনতে পারেননি। সে সব গুজরাতে চলে গিয়েছে। তবে বারাণসীর গঙ্গায় বিলাসবহুল ক্রুজ চালু করেছেন। সেখানে মদ পরিবেশন করা হচ্ছে।’’ তাঁর প্রশ্ন, এটাই কি সাংস্কৃতির ঐতিহ্যের পুনরুত্থান?
বারাণসী উন্নয়ন সংস্থার কর্তারা বলছেন, করিডর তৈরির পরে বারাণসীতে পর্যটন বেড়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। গড়ে এক লক্ষ মানুষ বিশ্বনাথ দর্শনে আসছেন। শ্রাবণ মাসে সেই সংখ্যাটা দু’লক্ষে পৌঁছে যাবে। পর্যটকদের চাহিদা পূরণ করতে এখন দশাশ্বমেধ ঘাটের সঙ্গে অস্সী ঘাটের মতো একাধিক ঘাটে সন্ধ্যার গঙ্গা-আরতি চালু হয়েছে। হোটেলের চাহিদার সঙ্গে ভাড়া বেড়েছে। আগরা, মথুরার থেকেও এখন বারাণসীতে বেশি পর্যটক আসছেন।
‘বাবা বিশ্বনাথ কি নগরী’ বারাণসীর মাহাত্ম্য কি এখন পর্যটকের সংখ্যা দিয়ে বিচার হবে? পাপ্পুর চায়ের দোকানে প্রশ্নটা ঘুরপাক খায়। দশাশ্বমেধ ঘাটের সামনে শিব সেজে বসে থাকা পুঁচকে নকুল গঙ্গা-আরতির সময়ে দু’পয়সা বেশি রোজগার হলে কোল্ড ড্রিঙ্ক কিনে খায়। তার পর হাত তুলে বলে, ‘হর হর মহাদেব!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy