বেনারসি শাড়ির দোকানে রমজান আলি। —নিজস্ব চিত্র।
‘‘দুটো শাড়ি হাতে তুলে দেখুন। ওজনেই বুঝতে পারবেন, কোনটা তাঁতে তৈরি, আর কোনটা মেশিনে!’’
রমজান আলি তাঁর কোলে এক জোড়া বেনারসি শাড়ি মেলে ধরেছেন। একটার দাম তিরিশ হাজার টাকা। অন্যটার দাম পাঁচ হাজার। তিরিশ হাজার টাকার শাড়ি পালকের মতো হালকা। পাঁচ হাজার টাকার শাড়ি বেশি ঝলমল করছে। ওজনেও ভারী।
“সবাই এসে এই পাঁচ-ছয় হাজার টাকার বেনারসি শাড়িই কিনে নিয়ে যায়। এমনিতেই নোট বাতিলের পর থেকে বিক্রিবাটা কমেছে। তার পর জিএসটি। কোভিড এসে তো কোমর ভেঙে দিয়েছিল। এখন বিক্রিবাটা বেড়েছে। কিন্তু ব্যবসা আর আগের মতো নেই। লোকে আর দরাজ হস্তে টাকা খরচ করতে চাইছে না। মেশিনে তৈরি কম দামি শাড়ির চাহিদাই বেশি। তাঁতে তৈরি আসল বেনারসি শাড়ির বিক্রি খুবই কম। সব থেকে মার খাচ্ছেন তাঁতিরা।”—আফসোস করছিলেন রমজান আলি।
নরেন্দ্র মোদীর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীর ভেলুপুরে রমজানদের তিন প্রজন্মের পুরনো শাড়ির ব্যবসা। পুরনো শাড়ির দোকানে সাদা গদিতে বসে কেনাবেচা হয়। খানিক দূরে নতুন কায়দার শো-রুমও খুলেছেন। রমজানদের শাড়ির আড়ত থেকে গড়িয়াহাট, হাতিবাগান, বড়বাজারের বিভিন্ন বিপণিতে বেনারসি শাড়ি পাঠানো হয়। কিন্তু তাঁর মুখে হাসি নেই। কারণ, বেনারসি শাড়ির তাঁতিদেরই নাভিশ্বাস উঠেছে। রোজগার কমায় বেনারসি শাড়ি বোনার কাজ ছেড়ে দলে দলে তরুণরা কেউ সুরাতে, কেউ বেঙ্গালুরুতে কাজ করতে চলে যাচ্ছেন। কেউ হোটেল-রেস্তরাঁয় কাজ করছেন বা টোটো চালাচ্ছেন।
বারাণসীর মদনপুরা, ভেলুপুর, পিলি কোঠি, ডাল মান্ডি, আলেইপুরের অলিগলিতে বেনারসি শাড়ির আঁতুড় ঘর। বারাণসীতে ১ জুন ভোটগ্রহণ। নির্বাচনের মরসুমে বেনারসির আঁতুড়ঘর থেকে প্রশ্ন উঠেছে, নরেন্দ্র মোদী বারাণসীর সাংসদ হয়ে বেনারসি শাড়ি শিল্পের জন্য কী করেছেন? কেন তিনি তাঁতিদের জন্য কোনও সুরাহার বন্দোবস্ত করলেন না?
রমজানের শাড়ির গদিতে শুকনো মুখে দাঁড়িয়েছিলেন এহসান আলি। বারাণসীর কাছে আলেইপুরে বাড়ি। ঘরেই শাড়ি তৈরির তাঁত। পাওয়ারলুম বা যন্ত্রচালিত তাঁতও রয়েছে। এহসানদের পরিবার গত একশো বছর ধরে বেনারসি শাড়ি বুনছে। “বাপ, দাদা, পরদাদা, সবাই এই কাজ করত। এখন আমরা চার ভাই শাড়ি বোনার কাজ করি।” কিন্তু চার ভাই কাজ করেও মাসে ১০-১২ হাজার টাকার বেশি রোজগার করতে পারেন না। “কারণ, এখন হাতের তাঁতে তৈরি বেনারসি শাড়ি তৈরির বরাত হয়তো মাসে একখানা মেলে। হ্যান্ডলুমে একটা শাড়ি বুনতে হয়তো কুড়ি দিন লেগে যায়। তবে তাতে আয় বেশি। সেই তুলনায় পাওয়ারলুমে মাসে ৪০টা শাড়ি তৈরি করি। কিন্তু ওতে বেশি মজুরি মেলে না।”
বারাণসীর গোধূলিয়া মোড় থেকে মাইল দেড়েক দূরে পিলি কোঠির ঘরে ঘরে বেনারসি শাড়ির শাড়ির ‘বুনকর’ বা তাঁতিদের ঠিকানা। আরফিন আনসারির ঘরে দিনভর পাওয়ারলুম চলে। বিদ্যুতের বিল জোগাতে ঘাম ছুটে যায়। সমাজবাদী পার্টির সরকারের আমলে বিদ্যুতের ভর্তুকি দেওয়া হত। যোগী আদিত্যনাথ সরকারের আমলে সেই ভর্তুকি তুলে দিয়ে নতুন মাসুল নীতি চালু হয়েছে। আনসারি বলেন, ‘‘আগে ৭৫ টাকা বিল আসত। এখন ৮০০-৯০০ টাকা বিল আসে। এ নিয়ে অনেক আন্দোলন, অনুরোধ, দরবার করা হয়েছে। লাভ হয়নি।’’
রমজান আলির মতো ব্যবসায়ী ‘গদ্দিদার’, বেনারসি শাড়ির তাঁতি বা ‘বুনকর’, যাঁরা বেনারসি শাড়ির গায়ের নকশা বা কারুকার্য এঁকে দেন, সেই ‘নকশেদার’ মিলিয়ে বারাণসীর প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ বেনারসি শাড়ি শিল্পের উপরে নির্ভরশীল। দেশের প্রধানমন্ত্রীর লোকসভা কেন্দ্রে সেই বেনারসি শাড়ির শিল্পে এখন হাহাকার উঠেছে। নোট বাতিল, কোভিডের ধাক্কায় ব্যবসা মার খাওয়ায় গদ্দিদারদের রোজগার কমছে। পাওয়ারলুমে শাড়ি তৈরি হচ্ছে বলে তাঁতিদের মজুরি কমছে। এক-একটি শাড়ির গায়ের কারুকার্য বা নকশা এঁকে দেওয়ার জন্য ‘নকশেদার’-রা এক থেকে দু’হাজার টাকা পান। শাড়ির বিক্রি কমায় তাঁদেরও রোজগার কমেছে।
বারাণসীর অলি-গলিতে ঘুরলে গুঞ্জন শোনা যায়, গুজরাত থেকে নরেন্দ্র মোদী এসে বারাণসীতে ভোটে লড়ছেন। তাঁর মতো বেনারসি শাড়ির সুতো, যাবতীয় যন্ত্রাংশ সবই আসছে গুজরাত থেকে। বারাণসীতে কারখানা তৈরির দাবি থাকলেও তা পূরণ হয়নি। কিন্তু এ সব নিয়ে মুখ খোলা মানা।
‘‘তার থেকেও বড় দুঃখ কী জানেন? এই বেনারসি শাড়ি নিয়েও ধর্মীয় ভেদাভেদের রাজনীতি শুরু হয়েছে’’—মদনপুরার এক প্রবীণ বেনারসি বুনকর বলেন, ‘‘যাঁরা শাড়ি বোনে, তাঁদের ৮০ শতাংশই মুসলিম। গদ্দিদারদের বেশির ভাগই হিন্দু। শাড়ি যেমন তানা-বানার সুতোয় বোনা হয়, এত দিন বেনারসি শাড়ি তৈরিতে দুই ধর্মের মানুষ তানা-বানার মতো একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে ছিল। এখন বুনকরদের মনে ধারণা তৈরি হয়েছে, তাঁরা মুসলিম বলেই মোদী বা যোগী সরকার কোনও পদক্ষেপ করছে না। আর বিজেপি বলছে, শুধু মুসলিমরাই অভাব-অভিযোগ করছে। এর মোকাবিলায় বিজেপির মদতে বুনকর হিন্দু যুবা বাহিনী তৈরি হয়েছে।’’
সপ্তদশ শতাব্দীতে গুজরাতে দুর্ভিক্ষের জেরে তাঁতি, ব্যবসায়ীরা উত্তর ভারতে চলে এসেছিলেন। মোগল সম্রাটদের দাক্ষিণ্যে তাঁরা বারাণসীতে থাকত শুরু করেন। বারাণসীর সিল্কের শাড়ি বেনারসি নামে বিখ্যাত হয়।আর এখন?
রমজান আলি বলেন, ‘‘এখন বারাণসীর বুনকরদের ছেলেরা সেই গুজরাতের সুরাতের সিন্থেটিক শাড়ির কারখানায় মজুরি করতে চলে যাচ্ছে। না হলে শাড়ি তৈরির তাঁত বিক্রি করে টোটো কিনছে। কী করবে? শাড়ি বুনলে দিনে ৩০০ টাকা রোজগার। টোটো চালিয়ে তা-ও পাঁচ-সাতশো টাকা আয় হয়। শিল্পীরা শ্রমিক হয়ে যাচ্ছেন। এটাই দুঃখের।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy