E-Paper

‘চাঁদির জুতো’য় দখলদার তুলে রাম-পথে প্রাচীর পান্ডিয়ানের

বৈশাখের গরমেও গিজগিজে ভিড় তটে। ভোট নিয়ে আদিখ্যেতা নেই পুরীর। কে কোন দলের প্রার্থী সকলেই খবর রাখেন। উত্তেজিত আলোচনাও চলে রাজনীতির। তবে পোস্টার, ফেস্টুন মারা হয় ভোটের আগের রাতে।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:২১
Share
Save

ভুবনেশ্বর থেকে ব্রহ্মগিরির পথে কিছুটা এগিয়ে বাঁ দিকে তাকাতেই বিস্ময়। দিগন্তে ও-ই পুরীর জগন্নাথ মন্দির না! এত কাছে?

গাড়ির চালক বিষ্ণু পরিডা জানালেন, ফাঁকা জায়গা বলে এমন ভ্রম হচ্ছে। এখান থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে। তবে পুরীর জনকল্লোল এড়িয়ে ভক্তজনকে সটান জগন্নাথ মন্দিরের অদূরে নবনির্মিত বহুতল ‘জগন্নাথ বল্লভ পার্কিং লট’-এ পৌঁছে দিতে আড়াই কিলোমিটার চার লেনের যে বাইপাস সড়কটি নবীন পট্টনায়ক সরকার তৈরি করেছে, ভুবনেশ্বর থেকে তা শ্রীসেতু হয়ে গন্তব্যে পৌঁছচ্ছে এক ঘণ্টা কম সময়ে।

পার্কিং লট থেকে জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদুয়ার পৌঁছে দিতে তৈরি হয়েছে নতুন প্রশস্ত সড়়ক ‘শ্রী দণ্ড’। দু’পাশের দখলদার হটিয়ে মন্দিরের সামনে রথযাত্রার মহাসড়ক ‘বড় দণ্ড’-কে করা হয়েছে আরও চওড়া। ভোল বদলে গিয়েছে জগন্নাথ মন্দিরেরও। শ’পাঁচেক বছর আগে যবনদের আক্রমণ মোকাবিলায় যে সুউচ্চ মেঘনাদ পচেরি (প্রাচীর) দিয়ে মন্দিরকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল, দখলদারদের প্রকোপে এত দিন তার খুব অল্প অংশই চোখে পড়ত। প্রায় ৬৫০ ঘর দখলদার সরিয়ে সেই মন্দির প্রাকারের বাইরে নির্মিত হয়েছে ৭৫ মিটার চওড়া পরিক্রমা রাস্তা। তার পাশে বসেছে নানা ছায়াবৃক্ষ। ভক্তদের জিরিয়ে নেওয়ার অজস্র আসন, পানীয় জলের বন্দোবস্ত, কিছু খাদ্যসামগ্রীর বিপণিও। মেঘনাদ পচেরিও এখন সম্পূর্ণ দৃশ্যমান।

মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে জগন্নাথ দর্শণার্থীদের জন্য এখন তৈরি ১১ সারি শক্তপোক্ত স্টেনলেস স্টিলের রডের খাঁচা, যার মধ্য দিয়ে বিনা ধাক্কাধাক্কিতে জগন্নাথ দর্শনে এগিয়ে যেতে পারবেন ভক্তরা। মন্দিরের দেখভালে নিযুক্ত সরকারি এক কর্তা অনঙ্গদেব সোঁয়াই জানালেন, অতিমারি পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ মন্দিরে গড়ে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ লক্ষ ভক্ত সমাগম হচ্ছে, আগের চেয়ে অনেক বেশি। উৎসবের বিশেষ দিনে এই সংখ্যা ১০ লক্ষও ছাপিয়ে গিয়েছে। কিন্তু নতুন বন্দোবস্তে ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।

২০১৯-এর ৩মে সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড় ফণী-র ছোবলে নীল হয়ে যায় পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন জনপদ পুরী, ঋগ্বেদে যার উল্লেখ মেলে পুরুষমণ্ডম নামে। মৎস্য পুরাণ, ব্রহ্ম পুরাণ, নারদ পুরাণে আবার পুরুষোত্তমপুর নামে ডাকা হয়েছে সাগরতীরের এই জনবসতিকে, যার বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা ছিল শঙ্খ সংগ্রহ। শঙ্খ ক্ষেত্র নামেও ডাকা হত তাই অধুনা পুরীকে। রাজ্যের শাসক বিজু জনতা দলের নির্বাচনী প্রতীকও শঙ্খ। ভুবনেশ্বরে গঙ্গানগরে নবীন পট্টনায়কের দলের চোখ ধাঁধানো দফতরটির নামও ‘শঙ্খ ভবন’, যার ভিতরে ঢুকলেই সুবিশাল কাচের বাক্সে রাখা জগন্নাথ মন্দিরের মডেল। পিছনে মাথার উপরে দেওয়াল জোড়া ছবি জগন্নাথ-বলভদ্র-সুভদ্রার।

ফণী-অতিমারির ঝাপটার মধ্যেও নির্দিষ্ট সময়ে জগন্নাথ মন্দিরের ৬৫০ ঘর দখলদার দোকানি, মঠ-মিশন, পাণ্ডাবাড়ি সরিয়ে নির্মাণ কাজ শেষ করা— বড় কম কথা নয়! বিশ্বস্ত আমলা ভি কে পান্ডিয়ানকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নবীন। প্রতি সপ্তাহে এক দিন সশরীরে হাজির হয়ে কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৯ বছরের তামিল পান্ডিয়ান। দখলদার তুলতে ‘চাঁদির জুতো’ ব্যবহারের কৌশল প্রয়োগ করেছেন অক্লেশে। জানিয়ে দিয়েছেন, এই যে বাজার দরের বহু গুণ টাকা সরকার ক্ষতিপুরণ দিচ্ছে, আইনি বাগড়ার রাস্তায় হাঁটলে পরে কিন্তু একটা টাকাও মিলবে না। বাগড়া পড়েওনি কাজে। মন্দিরের ২ কিলোমিটারের মধ্যে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে দখলদারদের। অবশেষে নরেন্দ্র মোদী রামমন্দির উদ্বোধনের ৫ দিন আগে ১৭ জানুয়ারি মন্দির প্রকল্প উদ্বোধন করে দিলেন নবীন। প্রতিপক্ষ বিজেপির রাম-রথের পথে যেন খাড়া করে দিলেন মেঘনাদ পচেরি।

প্রতিষ্ঠিত বহু বাঙালি পরিবারের বাস শ্রীক্ষেত্রে। শুধু ভক্ত ও পর্যটক হিসাবে নয়, ভাগ্যান্বেষণেও পুরীতে পাড়ি জমানো বাঙালির ছড়াছড়ি। স্বাধীনতার পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাস্তচ্যুত হয়ে আসা এক দল বঙ্গভাষী মানুষকে পুনর্বাসন দেওয়া হয় ওড়িশার নীলগিরি, দণ্ডকারণ্যের পাশাপাশি পুরীর গৌড়বাটশাহী এলাকাতেও। শহরের আড়ে-বহরে বাড়বৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক গৌড়বাটশাহীতে এখন অজস্র হোটেল, হলিডে হোম, রেস্তরাঁ, মণিহারি দোকান।

ফণী-র চোট সামলে ওঠার আগেই অতিমারির দীর্ঘ লকডাউনে অস্তব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল এই পর্যটন নগরীর বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা। বাঙালি পর্যটন ব্যবসায়ী কার্তিক দাসের অকপট স্বীকারোক্তি, “লক ডাউন উঠে যাওয়ার পরে এই ৩ বছরে মুখ তুলে চেয়েছেন জগন্নাথ।” কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেন, “ওই তিন বছরের বন্ধ থাকা রোজগার পরের এক বছরেই সুদে-আসলে তুলে নিয়েছেন পুরীর মানুষ। গত ২-৩ বছর পুরীতে অফ সিজ্‌ন দেখেনি কেউ।”

বৈশাখের গরমেও গিজগিজে ভিড় তটে। ভোট নিয়ে আদিখ্যেতা নেই পুরীর। কে কোন দলের প্রার্থী সকলেই খবর রাখেন। উত্তেজিত আলোচনাও চলে রাজনীতির। তবে পোস্টার, ফেস্টুন মারা হয় ভোটের আগের রাতে। হোটেল সংরক্ষণের ব্যবসা আদতে আরামবাগ সংলগ্ন মেদিনীপুরের একটি গ্রামের বাসিন্দা অসিত দাসের। সিপিএমের সঙ্গে মারামারিতে নাম জড়িয়ে পড়ায় স্ত্রী-পুত্র নিয়ে অনির্দেশ যাত্রায় পুরীতে চলে এসেছিলেন কংগ্রেস কর্মী অসিত। বলেন, “আজও আমি কংগ্রেস সমর্থক। পুরী ঘুরে গিয়ে সবাই নবীনবাবুর প্রশংসা করে। কিন্তু এত বড় সাগরতট, লাখো মানুষ, কোথাও একটা পাবলিক টয়লেট খুঁজে পাবেন না। এদের উন্নয়ন, পকেট ভরার উন্নয়ন। মানুষের কথাই কেউ ভাবে না!”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 BJD naveen patnaik puri Odisha Spot Reporting

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।