—প্রতীকী ছবি।
শ্রীনগর থেকে ভোরবেলা জম্মুগামী জাতীয় সড়ক ধরে জাফরানের দিগন্তবিস্তৃত খেত দেখতে বেরিয়ে পড়ার বাড়তি মজা আছে। ঘুরে ফিরে আপনার দেখা হয়ে যাবে ঝিলমের সঙ্গে। বাদামবাগ, পাথরচৌক, পাম্পোর, কিচলিবাদ —একের পর এক জনপদ বদলে যাচ্ছে জানলার বাইরে। বার বার উপচে পড়ছে ঝিলম নদী, রোদের বদলানো রংয়ে নতুন সেজে। কোথাও সেনা ক্যান্টনমেন্টের ব্যস্ততা, কোথাও শিরমল রুটি বানানোর উমদা গন্ধ। এই রাস্তা চলে দিয়েছে পহেলগাঁওয়ের দিকে।
তবে অত দূর যেতে হবে না। পাম্পোর ছাড়ানোর পর থেকেই দিগন্ত ছোঁওয়া জাফরান সাম্রাজ্য আপনার চোখ ও মন টেনে নেবে। তারপর দেখবেন দু’পাশে শুধুই কেশরের দোকান। নানা আকার আয়তনের। একটু থেমে ভাল করে ঠাহর করলেই বোঝা যাবে, জাফরান বা কেশর বলে পর্যটককে টানা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখানে রয়েছে বিভিন্ন রংয়ের চেনা-অচেনা ‘ড্রাই ফ্রুট’। সেটাই প্রধান পণ্য, কারণ কেশরের উৎপাদনে এখন এতটাই টান, তার দাম এতই চড়া যে শুধু সেটি বেচে সম্পন্ন জীবন কাটানো শক্ত আজকের কাশ্মীরে। এই জাফরানের কথা ভেবেই আবুল ফজল বলেছিলেন, কাশ্মীর কোনও বিরক্ত আর বদ দিমাগ ব্যক্তিকেও খুশিতে নাচিয়ে তুলতে পারে। জাফরান খেতের রূপে মুগ্ধ ছিলেন নবরত্ন সভার অন্যতম এই রত্ন। কয়েকশো বছর ধরে জড়িয়ে আছে কাশ্মীরের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একে ভৌগোলিক স্বত্ব (জিআই ট্যাগ) দেওয়ার পর কেমন আছেন এখানকার কেশর-কৃষকেরা? “আমাদের এক দিকে মেরে রেখেছে ক্রমশ গরম হয়ে যাওয়া প্রকৃতি। অন্য দিকে, প্রশাসনের অবহেলা। আগে মার্চে বৃষ্টি হত। জানুয়ারি থেকে মার্চ চিল্লারি কালান অর্থাৎ বরফের সময় ছিল। কেশরের চাষ বরফ চায়। এখন তো উধাও। আর জিআই ট্যাগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা পূরণ করতে কৃষকদের যে ভাবে পাশে দাঁড়াতে হয়, সেই দায় এই লেফটেন্যান্ট গভর্নরের নেই। ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার ফলে যে বিরাট কোনও বিনিয়োগ এই কৃষি ক্ষেত্রে এল, এমনও নয়।” জাতীয় সড়ক থেকে কয়েক ধাপ নেমে খেতির শুরুতে ছোট জলের গাড়ি থেকে হোস পাইপে জল দেওয়ার তত্ত্বাবধান মহম্মদ মকবুল মীর। তিনিই বললেন উপরের কথাগুলো। নিজে সরকারের ঠিকা কর্মী। তিনিই বিরুদ্ধমনস্ক হয়ে উঠেছেন কেন? “এগারো সালে মনমোহন সিংহ সরকার শুরু করেছিল জাতীয় জাফরান মিশন যোজনা। খুব যে বেশি সহায়তা তাতে হত, তা হয়তো নয়, কিন্তু সে টুকুও তো বন্ধ এখন। সরকারের লোক এসে জরিপ করে উৎসাহভাতা দিত। এক কানাল (৫৪৪০ বর্গফুট) জমির জন্য দেওয়া হত ৩০ হাজার টাকা। বীজ লাগানোর সময়েও ভর্তুকির ব্যবস্থা ছিল। মোদী সরকারের আসার পরেও সে সব ছিল। কমে গিয়েছিল কোভিডের সময়ে আর বাইশ সাল থেকে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে কুড়ি বছর আগের থেকে এখন ৩০ শতাংশ কেশর উৎপাদন কমে গিয়েছে। আগে একটি মাঝারি কৃষক বছরে তিন কিলোগ্রাম খাঁটি জাফরান বেচতে পারত। আজ পারে এক কেজি।”
মকবুল এতটাই ভিতর থেকে জানেন বিষয়টা। কারণ, তিনি শুধু জল দেওয়ার কাজটাই করেন না, তাঁরও ছোট জাফরানের খেত রয়েছে। কিন্তু মন্দার ঠেলায় সরকারি ঠিকেদারদের সঙ্গে জুটে গিয়েছেন। জমি তাঁর প্রাণ বলে অন্য সরকারি ঠিকেদারদের মতো জাল পাম্প বসিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন না। বলছেন, “জাতীয় সড়ক প্রকল্প, কেন্দ্রীয় সিল্ক বোর্ডের সহায়তায় জল দেওয়া, সেচের কাজ শুরু করেছিল এখানকার সরকার কয়েক বছর আগে। কিন্তু যে সব ঠিকাদারদের বাছা হয়েছে তারা নিজেরা লাভের গুড় পকেটস্থ করে অচল পাম্প বসিয়ে শহরে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। কোনও রাজনৈতিক নেতার এখন কোমরের জোর নেই, বিধায়ক নেই। সরকারি আধিকারিকরা কে কার কথা শোনে।”
জিডিসি পাম্পোর ডিগ্রি কলেজ থেকে মানববিদ্যা নিয়ে স্নাতক হয়েছিলেন ফৈয়াজ নূর। আপাতত নিজেদের জাফরানের দোকান আর খেত সামলানোর পাশাপাশি চাকরির খোঁজ করছেন। বলছেন, “এখানে তো বেসরকারি কাজ পাওয়ার সুযোগ খুবই কম, চেষ্টা করছি সরকারি চাকরির জন্য। জাফরান ছিল আমাদের গৌরব। কেন্দ্রীয় সরকার যদি আমাদের সেচের সুবিধা করে দেয়, তাহলে আবার নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারি। অন্য চাষের দিকে যেন না চলেযেতে হয়।”
জাফরানের অন্য একটি দোকানের প্রবীণ মালিক বললেন, “এখনও সমস্যা হয় ইরানের কেশর নিয়ে। দামে সস্তা, স্বাদ-গন্ধ আর রঙেও কিছুটা কমজোরি এই কেশরকে কাশ্মীরি কেশরের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয় কাশ্মীরি কেশর নাম দিয়ে। ফলে উপযুক্ত দাম পায় না আসল কাশ্মীরি কেশর। সেই কেশর ফলানো চাষিরাও পান না পরিশ্রমের মূল্য।”
রাজ্যে রাজনীতির চাকা স্তব্ধ, চলছে শুধু প্রশাসনের চাকা, কিছুটা আবেগহীনভাবেই। স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের এই বিশ্বখ্যাত সম্পদ ভৌগোলিক মান্যতা হয়তো পেয়েছে। বিষণ্ণ কাশ্মীরের মুকুটে একটি পালকও বসেছে। কিন্তু হরিয়ানা, পঞ্জাব, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের মতোই জাফরান খেতের সঙ্গে সংলগ্ন প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার কৃষক পরিবারের কাছে দিল্লি ক্রমশই দূর হয়ে যাচ্ছে। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy