লালুপ্রসাদ যাদব। ছবি: পিটিআই।
পটনার গান্ধী ময়দানে শপথ শেষ হতেই সঙ্গীদের নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আড়াই কিলোমিটার হেঁটে সবাইকে অবাক করে দিয়ে নতুন মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়িয়ে পড়লেন রাস্তার মোড়ের পানের দোকানে। এমন একটা বিশেষ দিনে জর্দা পান যে না খেলেই নয়, আর সেটা হতে হবে নিজের পছন্দের দোকানেরই!
সময়টা ১৯৯০। কংগ্রেসের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বিহারে নতুন সরকার গড়লেন লালুপ্রসাদ যাদব। শপথের ঘণ্টাখানেক কেটেছে কি কাটেনি— তার মধ্যেই নতুন মুখ্যমন্ত্রীর এমন কাণ্ড দেখে চমকে গেল গোটা বিহার। পটনার ডাকবাংলো চকে সেই পানের দোকানটি আজও রয়েছে। যদিও মালিক কেদারনাথ বেশ কিছু দিন আগেই মারা গিয়েছেন। প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে লালুপ্রসাদকে পান সেজে দিয়েছিলেন যিনি, সে দিনের বছর কুড়ির যুবক বিজয় চন্দ্রবংশী আজ প্রৌঢ়ত্বের কোঠায়। ‘বাণারসী পান দোকান’ আপাতত তিনিই চালান।
সেই সব পুরনো দিনের কথা ভাবলে আজও অবাক হয়ে যান বিজয়। বলেন, ‘‘অনেক আগে থেকেই উনি আমাদের দোকানে আসতেন। অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্প করতেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার পরেই লালুজি এতটা পথ পায়ে হেঁটে পান খেতে আসবেন, সেটা কেউ কল্পনাও করেনি।’’ মুখ্যমন্ত্রী ও পানের দোকানির সম্পর্ক অবশ্য সে দিনেই শেষ হয়ে যায়নি। কয়েক দশকের জমানো স্মৃতি ফিরে আসে চন্দ্রবংশীর কথায়। ‘‘কেদারনাথজি ছিলেন দোকানের মালিক। লালুজি ওঁকে ভীষণ পছন্দ করতেন। কেদারনাথজির সঙ্গে রোজই যেতাম মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে। তখন কোথায় সিপাই, কোথায় কী! কেউ আটকাত না আমাদের।’’ জেহানাবাদের মানুষটি এখন স্মৃতিতে ডুব দিয়েছেন— ‘‘ডাকবাংলো চকের পাশ দিয়ে গেলে লালুজি অনেক সময়েই গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়তেন। দোকানের আশপাশে ভিড় হয়ে যেত। আবার কখনও উনি পান নিয়ে যেতে পুলিশকেও পাঠাতেন।’’
এখন ওই বাড়ির আর কেউ আসে না? প্রশ্ন শুনে বিষণ্ণতা চন্দ্রবংশীর কণ্ঠে। ‘‘সময় কি থেমে থাকে? নাকি সবাই এক রকম হয়? লালুজি জেলে গেলেন, তার পর থেকেই অসুস্থ। আর ওই বাড়ির ব্যাপারটাও বদলে গিয়েছে। কে আর আসবে? শুধু মুড হলে বড় ছেলে তেজপ্রতাপ লোক পাঠিয়ে পান কিনে নিয়ে যান।’’
আর তেজস্বী? আরজেডি তো এখন তাঁরই হাতে। এ বারের ভোটে তেজস্বী কি পারবেন বিজেপিকে আটকাতে? কথাটা শুনতেই মুহূর্তেই বদলে গেল শরীরী ভাষা! জোশ ধরা পড়ে চন্দ্রবংশীর ভাবভঙ্গিতে। কথা বলতে বলতে দোকান ছেড়ে আগেই নেমে এসেছিলেন। এ বার আলো ঝলমল রাতের রাস্তায় দূরে মিলিয়ে যাওয়া গাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘এই বিহারে লালুজিই প্রথম বুঝিয়েছিলেন— গরিব, পিছড়েবর্গের মানুষকে মর্যাদা না দিলে চলবে না। তবে উনি ছিলেন কমিক চরিত্র। কিন্তু তেজস্বী কথাবার্তায় একেবারে অন্যরকম। লালুজির মতো মানুষের সঙ্গে মেশার ক্ষমতা নেই ঠিকই। তবে লালুজির বিরাসত (উত্তরাধিকার) এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলেই তো মনে হয়।’’
বিহারে লোকসভা ভোট শুরু হয়ে গিয়েছে। সাত পর্বে চলবে দু’মাস ধরে। আগামী বছর আবার বিধানসভার ভোট। এই লড়াইয়ে শরিকদের নিয়ে বিহারে মোদীর রথ আটকে দিতে পারেন কি না তেজস্বী, তা নিয়ে চারদিকে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। আর কিডনি প্রতিস্থাপনের পর পটনায় বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই দিন কাটছে লালুর। সিঙ্গাপুরের হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পরে সীমিত সংখ্যক লোকেদের সঙ্গেই দেখা করেন। রাবড়ী দেবীর ১০ নম্বর সার্কুলার রোডের বাসভবনে মাঝেমধ্যে ঘনিষ্ঠ নেতারা আসেন, পরামর্শ চান। লালুর কথাবার্তাতেও আর আগের মতো রসিকতা ঝরে পড়ে না। কিছুদিন আগে গান্ধী ময়দানে জনবিশ্বাস র্যালিতে বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু অসুস্থতা যেন তাঁর শরীরী ভাষায় ফুটে উঠেছে। লোকসভা ভোটে জেলায় জেলায় গিয়ে দলের প্রচারের দায়িত্ব এ বারও পুরোপুরি তেজস্বীর কাঁধে। ৩৪ বছর বয়সি তেজস্বী বাবার পরামর্শ মেনে দল চালাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর কাজকর্মের পদ্ধতি একেবারেই আলাদা।
কতটা আলাদা, ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝালেন পটনায় দীর্ঘদিন কাজ করা এক সাংবাদিক। বললেন, ‘‘দেখুন, লালুপ্রসাদ লড়াই করে উঠে আসা নেতা। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর মিশে যাওয়ার ঘরানাটাই ছিল অন্যরকম। গভীর বিষয়কেও হালকা চালে আমজনতার কাছে নিয়ে যেতে পারতেন। সেই গুণ তেজস্বীর কোথায়? তেজস্বী বরং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিকে রক্ষা করছেন। তবে তাঁর কথাবার্তা অনেক পরিণত, সংযত। আর কর্পোরেট সংস্থা যে ভাবে দফতর চালায়, অনেকটা সেই ভাবেই দল চালাচ্ছেন তিনি।’’
বাবা-ছেলের আরও একটা ফারাক প্রকট হয়ে গিয়েছে কিছুদিন আগেই। নীতীশ কুমার গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে মিলে সরকার গড়লেন। কিন্তু সেই ঘটনার পরেও সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করলেন না তেজস্বী। চাচা নীতীশকে যতটুকু আক্রমণ, সেটা করলেন শুধুমাত্র বিধানসভায় ভাষণ দেওয়ার সময়েই। ব্যাপারটা দেখে অবাক অনেকেই। যে লালু পুকুরে খাবার দিতে দিতেও বলতেন, ‘মছলিয়ো বিজেপি কো হটাও’, তাঁর পুত্র কি না এতবড় ঘটনার পরেও একেবারে চুপ!
আরজেডির দফতরে বসে পালাবদলের যে ব্যাখ্যাটা হাজির করলেন দলের সাধারণ সম্পাদক রণবিজয় সাহু, তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সমীকরণের মিল অনেক। রণবিজয় বলেন, ‘‘লালুজি পিছড়ে বর্গের মানুষকে জাগিয়েছিলেন। আর তেজস্বীজি পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করে সেই কাজকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তেজস্বীজি। সেই কাজে তিনি সফলও।’’ ভোটের হাওয়ায় নেতার টেবিলে খবরের কাগজের উপরে স্তূপ করে রাখা চিড়ে ভাজা, বাদাম। অপেক্ষাকৃত ছোট নেতারা টেবিল ঘিরে হাত চালাচ্ছেন। রণবিজয় বলেন, ‘‘আগের বারের বিধানসভা ভোটের ফলই তো দেখিয়ে দিল, তেজস্বী যাদব কতটা জনপ্রিয়। যুবকদের চাকরির দাবিকে উনি লড়াইয়ের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। তেজস্বী যুব সমাজের আইকন। উনি কী করতে পারেন, এই ভোটেই সেটা টের পাবেন। তার পর সামনের বছর বিধানসভা ভোটটা আসতে দিন না!’’
আবার সেই নতুন সরকারের স্বপ্ন! কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যদি হয়েও যান তেজস্বী, শপথের দিন তিনি কোনও পানের দোকানে পৌঁছবেন না— এটুকু অন্তত হলফ করে বলে দেওয়াই যায়।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy