মহেশতলা এলাকার সেই রাস্তা। রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে বাজি। —নিজস্ব চিত্র।
ভাঙাচোরা ইটের সরু রাস্তা শেষ হয়ে গিয়েছে এক জায়গায়। বাঁ পাশে পানা ভর্তি পুকুর। ডান দিকে ছোট মাঠ। সেখানেই সাইকেল রেখে পুকুরের গা ঘেঁষে কাঁটাগাছ ভর্তি জঙ্গলের পথ দেখিয়ে খালেদ মোল্লা বললেন, ‘‘এখানেই নাকি বাজির ক্লাস্টার হবে।’’ কিন্তু রাস্তা কোথায়? বছর চল্লিশের যুবক বললেন, ‘‘বাবুরা এসে প্রায়ই দেখে যান, কিন্তু কবে কাজ শেষ হবে, কেউ জানে না। সুরাহা না পেয়ে আমরা আগের মতো বাড়িতেই বাজি তৈরি শুরু করে দিয়েছি।’’
কিন্তু বিপদ ঘটলে?
যুবকের উত্তর, ‘‘বাজি বিস্ফোরণে এক বছরে ২২টা মৃত্যু হয়েছে এই তল্লাটে। কিন্তু সংসার চালানোর টাকা নেই। অন্য কাজেরও সুযোগ নেই। আমাদের কাছে এই ভাবে বেঁচে থাকা যা, মৃত্যুও তা-ই!’’
বজবজ-মহেশতলায় নন্দরামপুর দাসপাড়ার সরকার প্রস্তাবিত বাজি ক্লাস্টারের (এক জায়গায় পুঞ্জীভূত) এই জমি পর্যন্ত পৌঁছনোর পথে দেখা গেল, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের ভাল রকম হাওয়া লেগেছে এই তল্লাটে। ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই এলাকার ইট বেরিয়ে থাকা চুন-সুরকি খসা দেওয়ালে নির্বাচনী প্রচারের ছড়াছড়ি। কোথাও দেওয়াল লিখনে বাড়ি তৈরির টাকা রাজ্য সরকারই দিয়ে দেবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও দেওয়ালে লেখা, ‘বাজিবান্ধব যে, ভোট পাবে সে’। ভোট-পরিবেশে বাজির স্বপ্ন ফেরি করতে ব্যস্ত এই এলাকার বহু নেতাও। মহেশতলা, বজবজ, বারুইপুরের ‘বাজি মহল্লা’র নেতা তথা ‘প্রদেশ আতশবাজি ব্যবসায়ী সমিতি’র সম্পাদক শুকদেব নস্কর বললেন, ‘‘ভোটের পরেই ক্লাস্টারের সবটা হয়ে যাবে। কাজ কিন্তু জোরকদমেই হচ্ছে!’’ কিন্তু এলাকার বাসিন্দাদের বড় অংশের অভিযোগ, পঞ্চায়েত ভোটের আশ্বাস পূরণ হয়নি এখনও। প্রায় এক বছর কেটে গেলেও বাজির ক্লাস্টার তৈরি হয়নি। উল্টে এই সুযোগেই ঘরে ঘরে নতুন করে শুরু হয়ে গিয়েছে বাজির ‘মারণ-ব্যবসা’।
একই অবস্থা দক্ষিণ শহরতলির ‘বাজি মহল্লা’ হিসাবে পরিচিত চম্পাহাটির বেগমপুর, হারাল, সোলগলিয়া বা মহেশতলার নুঙ্গি, পুটখালি, বলরামপুরে। এই সব এলাকায় ঘুরলেই শোনা যায়, প্রতি বছরই বাজি বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় এখানে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর ‘খবর’ বাইরে পৌঁছয় না বলে স্থানীয়দের দাবি। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও সমান ভাবে সামনে আসে। রমেশ বর্মণ নামে নুঙ্গি খাঁ পাড়ার এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রেফতারির পরে বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয় না। আদালতে পুলিশ জেল হেফাজতের দাবি জানায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই বলা হয়, বিস্ফোরক তেমন মেলেনি বা ফেটে গিয়েছে। নয়তো বাজি তৈরির সময়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে না বলে তৈরি করা বাজিতে আগুন ধরে গিয়েছে জানিয়ে দুর্ঘটনার মতো করে বিষয়টি দেখানো হয়।’’ অভিযোগ, যে হেতু বাজি তৈরির উপকরণ তেমন বাজেয়াপ্ত করা হয় না এবং আরও জেরার প্রয়োজনের কথা বলে না পুলিশ, তাই জেল হেফাজত হয় ধৃতের। দিনকয়েক জেল হেফাজতে কাটিয়েই জামিন পাওয়া যায়। বেরিয়ে নতুন করে অনেকেই শুরু করেন বাজির ব্যবসা।
চম্পাহাটির হারালের বাসিন্দা রত্না সাধুখাঁ আবার শিশুদের বারুদ মাখা হাতেই বাজির ব্যবসা জমে ওঠার অভিযোগ জানালেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘বাজির কারবারে সারা বছর শিশুরাই অন্যতম সম্পদ। তাদের অনেকেই সারা বছর স্কুলে যায় স্রেফ মিড-ডে মিলের জন্য। তার পরেই সোজা বাজির কাজে। পরিবারের বড়রাই ছোটদের বাজির কারখানায় দিয়ে আসেন রোজগারের আশায়। কারখানার মালিকদের কাছেও এমন শিশু শ্রমিকের চাহিদা বেশি। সাধারণ শ্রমিকদের যেখানে দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি এবং তিন বেলা খাবারের টাকা দিতে হয়, সেখানে ১০০টি চকলেট বোমার জন্য ২০-২৫ টাকা এবং ১০০টি রংমশালের জন্য ৫০ টাকা হিসাবে মজুরি দিলেই খুশি ছোটরা।’’
মহেশতলারই একটি মসজিদ লাগোয়া গাছের তলায় বসে কথা হচ্ছিল বছর পঁয়তাল্লিশের শেখ সুফিয়ানের সঙ্গে। সামান্য কথাবার্তাতেই হাঁফিয়ে উঠছিলেন তিনি। বললেন, ‘‘ছোট থেকে বাজির কারখানায় কাজ করতে করতে এই অবস্থা হয়েছে। নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে অনেকের শরীরেই। সব চেয়ে বেশি হয় চর্মরোগ। গভীর ঘা বা ফোস্কা পড়া এখানে 'জলভাত'।’’ এর পরে কিছুটা দম নিয়ে বললেন, ‘‘প্রায় প্রতি ঘরে শ্বাসনালি, ফুসফুসের সমস্যা। চোখের সমস্যাতেও ভোগেন অনেকে। অনেকেরই খুব কম বয়সে চোখে ছানি পড়ে গিয়েছে।’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘নির্বাচন আসে আর যায়, আমাদের ভবিষ্যৎ ঝাপসা থেকে আরও ঝাপসা হয়।’’
আরও একটি নির্বাচন কি এই মানুষগুলোর জীবনের অস্পষ্টতা কাটাবে? উত্তর মেলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy