E-Paper

রাজনীতির বোড়ে শিশুরাও

নিত্য নানা খেয়োখেয়ি দেখে বড় হতে চলা প্রজন্ম আদতে ভুলছে শৈশব। বাইরের লোকের সামনে, সংবাদমাধ্যমের সামনেও শেখানো বুলি আওড়াচ্ছে তারা।

—প্রতীকী ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৯:৩৩
Share
Save

নেতাদের ইচ্ছে মতো স্কুল চলে। যখন তখন ঝাঁপ বন্ধ। গরমের ছুটি, পুজোর ছুটির বাইরেও হরেক ছুটি। এলাকায় ঝামেলা, তাই স্কুলে পা রাখা বারণ। যখন যে পারছে, মাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, বাবা-দাদাকে পিটিয়ে-শাসিয়ে যাচ্ছে। তাই স্কুল যাওয়া যাবে না। ছোট ফুটফুটে মেয়েটার উপরে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের নজর পড়েছে। তাই স্কুলে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। এই
মুহূর্তে সব চেয়ে করুণ অবস্থা সন্দেশখালির শিশুদের।

নিত্য নানা খেয়োখেয়ি দেখে বড় হতে চলা প্রজন্ম আদতে ভুলছে শৈশব। বাইরের লোকের সামনে, সংবাদমাধ্যমের সামনেও শেখানো বুলি আওড়াচ্ছে তারা। বলতে বলতে আটকে গেলে কখনও আবার পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে অসহায় ভাবে। তাদের মুখে অনর্গল তৃণমূল/বিজেপির নেতাদের নাম উল্লেখ করে নানা প্রাপ্তবয়স্কদের অভিযোগ শুনে তাজ্জব বনে যেতে হয়। এলাকায় অনবরত গাড়ি ঢুকছে। রাজনৈতিক নেতাদের। সংবাদমাধ্যমের। বাচ্চারা ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢুকছে, “মা, আবার একটা মিডিয়া এসেছে...।”

যে তরুণী অপহরণ ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ এনেছিলেন, তাঁর ছ’বছরের মেয়ে যখন কোনও প্রশ্ন ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলতে শুরু করে, তার মায়ের উপরে কী অত্যাচার হয়েছে আর কী কী হতে পারত, তখন শিউরে উঠতেই হয়। বাড়ির কেউ তাকে ওই মুহূর্তে বাধা দেননি, কেউ চেষ্টা করেননি তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। শিশুটি মনে করছে তার পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সন্দেশখালির ঘরে ঘরে এখন এই ছবি।

শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে ভাইরাল হয়েছিল একটি শিশু। ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছিল রীতিমতো গুছিয়ে সে বলছে কী ধরনের অন্যায় হয়েছে, বলছে কারা কারা তা করেছে। ওই শিশুকে প্রশ্ন করেছিলাম, এত কথা তুমি জানলে কী ভাবে? তার উত্তর ছিল, “এটা আমাদের বাঁচার লড়াই। আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।” প্রত্যেকটা শব্দ, শব্দগুলো উচ্চারণের সময়ে তার মুখভঙ্গি— কোনওটাই শিশুর সঙ্গে মেলে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনও শিশু যখন বড়দের দুনিয়ায় প্রবেশ করে, তখন শুধু ‘বড়দের মতো কথা’ নয়, তার মধ্যে বড়দের মতো অবিশ্বাস, ক্রোধ, আতঙ্ক, ঘৃণা সব কিছুই তৈরি হতে থাকে। মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেল বলেন, “কোনও শিশু একটি ঘটনা কতটা সরাসরি প্রত্যক্ষ করছে, তার বা তার কাছের মানুষদের ওপরে কতটা সেটা ঘটছে, তার ওপরে সেই ঘটনার প্রভাব নির্ভর করে। দিনের পর দিন কাছের কোনও মানুষকে অত্যাচারিত, অপমানিত হতে দেখলে তার মনে তা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। একে বলে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’।”

গত ১০ ফেব্রুয়ারি সন্দেশখালিতে একটি শিশুর উপর অত্যাচারের অভিযোগ সামনে এসেছিল। এক শিশুকে তার মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল বলে অভিযোগ। শিশুটির মা অভিযোগ করেছিলেন, “ওরা আমার কোলের বাচ্চাকে ছুড়ে ফেলেছে। আমার চুলের মুঠি ধরে, নাইটি ধরে টেনেছে।” রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের প্রতিনিধিদল সেই সময়ে সন্দেশখালি যায়। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন চেয়ারপার্সন তুলিকা দাস। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, শুধু এমন অভিযোগের ক্ষেত্রেই কি কমিশনের ভূমিকা রয়েছে? যেখানে শিশুরা শৈশব, সারল্য, কোমলতা হারাচ্ছে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, সেখানে কি কমিশনের কিছুই করার নেই? তিনি বলেন, “অবশ্যই আছে। কমিশন ওই এলাকার শিশুদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলতে পারে, তাদের কাউন্সেলিং করতে পারে, অভিভাবক, স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে পারে।”

তা হলে বলে না কেন? সদুত্তর নেই।

কলোনি পাড়ায় একটি শিশু বাইরে কীর্তন গাইতে যেত। এই গোলমালে সব বন্ধ। তার মা বললেন, “আমাদের জীবন তো বদলে গেছেই। আমাদের বাচ্চাগুলোর জীবনও বোধহয় চিরতরে বদলে গেল। পাশে থাকার কেউ নেই।”

কী নিয়ে তা হলে বেঁচে আছে সন্দেশখালি? আন্দোলন এখন অতীতের খাতায়। শাহজাহান-শিবু-উত্তমদের অত্যাচারের অধ্যায় পেরিয়ে দিন বদলাচ্ছে ভেবে ভিন্‌ রাজ্যে কাজ খুঁজতে যাওয়া যে শ্রমিকেরা আবার বাড়ি ফেরার আশা দেখছিলেন, তাঁরা কঠিন বাস্তবে ফেরত গিয়েছেন। ভোটের ফল বেরোনোর পরে যে যার পাওনাগন্ডা বুঝে নেবে যে! যে ক্ষতি খালি চোখে দেখে বোঝা যায় না, অনুভব করতে হয়, সেই ক্ষতির ভার তাই বাড়ছে বিভিন্ন দ্বীপে। বিজেপির প্রার্থী রেখা পাত্রও কোলের সন্তানটিকে বাদ দিয়ে বাকিদের নিজের কাছে রাখতে পারছেন না। দূরে থাকা সন্তানেরা মাকে নিয়ে নানা কটূক্তি শুনছে। কোলের সন্তানটিও বার বার নানা অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়ছে। খারাপ লাগে না? রেখা উত্তর দিতে পারেননি। নীরব থেকেছেন।

বাংলার শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিল জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশন। ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ, পাচার, বোমা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ ছিল সেই রিপোর্টে। কিন্তু ছিল না ধীরে ধীরে শৈশবটাই হারিয়ে যাওয়ার কথা।

সন্দেশখালি থেকে ধামাখালি ফেরার পথে নৌকায় একটি শিশুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গত পাঁচ মাস সে মামার বাড়িতে থাকে। স্কুলে যেতে পারে না, বাবা-মা-বন্ধু সব ছেড়ে তাকে থাকতে হয়, কারণ তার বাড়ির লোক মনে করেন, সেটাই নিরাপদ। চার দিন বাড়িতে থেকে আবার মামাবাড়ি ফেরত যাওয়ার পথে অঝোরে কাঁদছিল সে।

কিছু দিন আগে আকুঞ্জিপাড়ায় শিশু সন্তানদের হাত ধরে মিছিলে শামিল হয়ে শেখ শাহজাহানের মুক্তির দাবি করেছিলেন এক দল মহিলা, সেই মিছিলে যে শিশুরা মুঠো করা হাত উপরে তুলে নেতাদের নাম ধরে নানা অভিযোগ করছিল, কথা বলেছিলাম তাদের কয়েক জনের সঙ্গে। ওই মিছিলের পরেও অনেক মিছিলে হেঁটেছে তারা। গরমের ছুটির আগে শেষ কবে স্কুলে গেছে জানতে চাইলে তারা জবাব দিতে পারে না, হাতড়াতে থাকে। অথচ কবে কোন মিছিলে গেছে তা স্পষ্ট মনে আছে। যে ভাবে অনর্গল তারা বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল, তাতে বোঝা যায় তাদের মগজে এখন বেশিরভাগ অংশই দখল করে আছে ওই দলাদলি, হিংসা, কদর্যতা।

বাবা-মায়েদের প্রশ্ন করেছিলাম, ওদের কেন নিয়ে গেছেন এই সব মিছিলে? জবাব দেননি তাঁরা। এলাকার এক মাঝারি তৃণমূল নেতা বললেন, “ওদের লড়াইটা লড়তে দিন। ভুল বোঝাবেন না।” কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওই একই জায়গায় বিজেপির ছোট জমায়েত ছিল। সেখানেও উৎসুক শিশুদের ভিড়। এরা এখানে কেন? বিজেপির এক নেতার জবাব, “ওরাই ভবিষ্যৎ। ওদেরই তো সব বুঝে নিতে হবে।”

শুধুই আখের গোছানো? তোমার মন নাই সন্দেশখালি? (শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sandeshkhali Incident sandeshkhali Lok Sabha Election 2024 TMC BJP

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।