Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

রেকর্ড গড়ার মুখে অসুস্থতার সঙ্গে লড়ছেন নবীন

ষষ্ঠ বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড থেকে নবীনকে আটকাতে উঠে পড়ে লেগেছে বিজেপি। তবে এ বিষয়ে বিজেপির চেয়েও বড় বাধা যে তাঁর অসুস্থ-অশক্ত ভাবমূর্তি, ১৩ বছরের সঙ্গী পান্ডিয়ান তা বিলক্ষণ বোঝেন।

নবীন পট্টনায়ক।

নবীন পট্টনায়ক। —ফাইল ছবি।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৪ ০৯:১২
Share: Save:

জনসভার পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলছেন। ডান হাতে মাইক্রোফোন, বাঁ হাতে ধরে আছেন পোডিয়ামের একটা অংশ। সে হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে।

সম্মিলিত জনতার নজরে পড়ার কথা নয়। মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ককে দেখে তাদের তখন বিরতিহীন উল্লাস। বক্তৃতাতেও ছক-ভাঙা প্রবীণ নবীন। অপটু ওড়িয়ায় একটা করে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, যার জবাব হয় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-য়ে। জনতা জবাব দিয়ে কৃতার্থ বোধ করে। এ দিনও চলছিল তেমনই সওয়াল-জবাব। নিরবচ্ছিন্ন পাঁচ বারের মুখ্যমন্ত্রীর মুখে অমলিন হাসি। তবে অতিরিক্ত একটি মাইক্রোফোন ধরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিজেডির নতুন নেতা ভি কে পান্ডিয়ান দেখলেন, সংবাদমাধ্যমের ভিডিয়ো-ক্যামেরার নিশানায় মুখ্যমন্ত্রীর কম্পমান বাঁ হাত। দ্রুত নবীনের পাশে পৌঁছে সেই হাত টেনে তিনি ঢুকিয়ে দিলেন পোডিয়ামের আড়ালে।

চমকে গিয়েছিলেন নবীনও। তবে তাঁর ভাষণে ছেদ পড়েনি। কিন্তু ওড়িশায় লোকসভা-বিধানসভা যৌথ ভোটের প্রাক্কালে কয়েক সেকেন্ডের এই ভিডিয়োই ফোনে ফোনে ছড়িয়ে দিয়েছে বিপক্ষ বিজেপির আইটি সেল। সঙ্গে প্রশ্ন— অশক্ত, অসুস্থ মুখ্যমন্ত্রী কি কারও হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন? এমন পুতুলকে আবার মুখ্যমন্ত্রী চান?

দু’দিন পরে বিজেপির হয়ে ওড়িশার অঙ্গুল ও কেন্দ্রাপাড়ায় প্রচারে এসে ‘বন্ধুকৃত্য’ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ককে এত কাল তিনি ‘আপন’ বলে এসেছেন, তাঁর অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। জানালেন, তাঁকে সামনে রেখে অশুভ শক্তি রাজ্যপাট চালাচ্ছে কি না, বিজেপি ক্ষমতায় এসে তদন্ত দল গড়ে তার তত্ত্বতালাশ করবে। ‘যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অসুস্থ’, সেই ওড়িশা নিয়েও যে তিনি গভীর উদ্বিগ্ন, সে কথাও জানালেন।

সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করে তাঁকে বার্তা দিলেন নবীন, “আমি একেবারে সুস্থ। না হলে গোটা রাজ্য ঘুরে ঘুরে ভোটের প্রচার করলাম কী করে?” মোদীকে ধন্যবাদ জানালেন তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায়। শুধু বললেন, “এত উদ্বেগ, আমাকে একটা ফোন করলেই তো পারতেন। কেমন আছি নিজেই জানিয়ে দিতাম। উনি তদন্ত কমিটি গড়ছেন। আমি বলব, গড়ুন। আপনার দলের রাজ্য ও দিল্লির নেতারা আমার স্বাস্থ্য নিয়ে গুজব ছডাচ্ছেন। তদন্ত হোক তার। প্রধানমন্ত্রী ওড়িশা নিয়েও উদ্বিগ্ন! আমি বলব, তা হলে কয়লার রয়্যালটিটা বাড়িয়ে দিন। আমাদের নানা ন্যায্য দাবিরও হিল্লে করুন।”

১৯৯৭-তে ভারতের রাজনীতির বর্ণময় চরিত্র, জনতা দলের নেতা বিজু পট্টনায়ক মারা যাওয়ার পরে শূন্য আকসা লোকসভা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন পুত্র নবীন। তার আগে ওড়িশার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিল না জন্মস্থান কটককে বিদায় জানিয়ে দিল্লি চলে যাওয়া বালক পাপ্পু-র। পরে দেহরাদূনের ওয়েলহ্যাম বয়েজ় স্কুল হয়ে দুন স্কুলে। সেখানে সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে এক বেঞ্চে। দিল্লির কিরোরিমল কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। যখন ওড়িশার জনপ্রতিনিধি হয়ে এলেন, ওড়িয়া ভাষাটাই জানতেন না নবীন। ২৪ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরেও সড়গড় হতে পারেননি ওড়িয়ায়।

২০০০ সালে জনতা দল ভেঙে বাবার নামে ওড়িশায় নবীন পত্তন করলেন আঞ্চলিক দল বিজু জনতা দল (বিজেডি)। সে বছরেই বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে পরাজিত করে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। ২০০৭-এ কন্ধমলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরে শরিক বিজেপির ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির সঙ্গে সঙ্ঘাত বাধল বিজু-পুত্রের। গাঁটছড়া ভেঙে গেল বিজেপি ও বিজেডির। সিপিএম নেতা হরকিষেন সিংহ সুরজিতের ডাকে যোগ দিলেন তৃতীয় ফ্রন্টে। তার পরে দেশের রাজনীতিতে রং বদলেছে। ওড়িশার নেতৃত্বে এখন ‘শঙ্খ’ হাতে নবীন।

ওড়িশা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি সনৎ দাসকে যখন প্রশ্ন করি, “মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ককে আপনি কী ভাবে দেখেন,” কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলেন, “উনি আমাদের গর্ব। দক্ষ প্রশাসক, ব্যক্তিগত জীবনে সৎ, কাজের মানুষ। ওড়িশার ভোল বদলে দিয়েছেন।” এটা সনতের ব্যক্তিগত অভিমত না দলেরও? তিনি বলেন, “দলেরও।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শরৎ পট্টনায়কও বলেন, ‘‘ভিন্ন রাজনীতি করি বলে মিথ্যা বলব নাকি? দুষ্ট আর সাম্প্রদায়িক লোকেরা ছাড়া সবাই মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করবে। আগে লেখাপড়া থেকে চাকরি, ওড়িশার মানুষের ভরসা ছিল কলকাতা। এখন বাংলার ছেলেরা ভুবনেশ্বরে পড়তে আসে, আইটি কোম্পানিতে কাজ করতে আসে। রাজ্যের সব গুন্ডা-মস্তানকে হাওয়া করে দিয়েছেন।”

বিজেপিকে তো উনিই প্রতিষ্ঠিত করেছেন ওড়িশায়? প্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি বলেন, “প্রথমে সেটা ওঁর ভুল ছিল বটে, কিন্তু জোট ভেঙে যাওয়ার পরে তিনি ওড়িশায় বিজেপিকে যে ভাবে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করেছেন, প্রশংসাই করতে হবে। তবে নবীনবাবু সত্যিই অসুস্থ। এ বার তাঁরই উচিত মুখ্যমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব অন্য কাউকে ছেড়ে দেওয়া।”

বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সমীর মহান্তিকে একই প্রশ্ন করায় তিনি অবশ্য অতটা উদার হলেন না। তাঁর সব চেয়ে বড় অভিযোগ, “শরিক হিসেবে এবং ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পরে নানা কৌশলে বিজেপিকে নবীন ওড়িশায় বাড়তে দেননি।” সততা? সমীর বলেন, “ওঁর ব্যক্তিগত সততা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই, কিন্তু সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার দায় নবীনবাবুকে নিতে হবে। অনেকে বলেন, ওড়িশায় ইডি-সিবিআই ওঁদের ছোঁয়নি। আমি বলছি, ছোঁবেই।”

তবে পুরীর ব্যবসায়ী কার্তিক দাস থেকে গাড়িচালক সুনীল বেহেরা, বা বালেশ্বরে বিড়লা টায়ারের কর্মচ্যুত শ্রমিক ভানু সোঁয়াই— সততা ও সৌজন্যের জন্য দশে দশ দিচ্ছেন নবীনকে। এঁরা তিন জনই আলাদা রাজনৈতিক দলের সমর্থক। নবীনের দল বিজেডি-র নির্বাচনের কান্ডারি ভি কে পান্ডিয়ানের দাবি, “চার দফা নির্বাচনের যে তিন দফা শেষ হয়েছে, তাতে‌ই ঠিক হয়ে গিয়েছে আরও বেশি আসন নিয়ে নবীনবাবু ফিরছেন। শেষ দফায় আরও আসন বাড়বে। হিঞ্জিলি ও কন্টভানজি— দু’টি আসনেই বড় ব্যবধানে জিতবেন নবীনবাবু। শপথ নিয়েই তাঁর প্রথম ঘোষণা হবে, সবার জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ।”

ষষ্ঠ বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড থেকে নবীনকে আটকাতে উঠে পড়ে লেগেছে বিজেপি। তবে এ বিষয়ে বিজেপির চেয়েও বড় বাধা যে তাঁর অসুস্থ-অশক্ত ভাবমূর্তি, ১৩ বছরের সঙ্গী পান্ডিয়ান তা বিলক্ষণ বোঝেন। সে জন্যই ক্যামেরার ইগল চোখ থেকে আড়াল করেন মুখ্যমন্ত্রীর হাতের কম্পন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy