Advertisement
E-Paper

রটেছিল মৃত্যুর গুজব, ভোটের নামেই ভয় পান অশক্ত আবদুল্লা

২০২৩ সালের জুলাই মাস। রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে নির্দল-তৃণমূল সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল বারাসত-১ ব্লকের পিরগাছা এলাকা। নির্দল প্রার্থীর সমর্থকদের ধরে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ ওঠে শাসকদল তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে।

শঙ্কা: দত্তপুকুরের পরগাছায় নিজের বাড়িতে আবদুল্লা।

শঙ্কা: দত্তপুকুরের পরগাছায় নিজের বাড়িতে আবদুল্লা। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

চন্দন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৪ ০৭:৫০
Share
Save

বছর ঘুরতে চলল। কিন্তু, এখনও একা চলাফেরা করার ক্ষমতা নেই তাঁর। কেউ এসে ধরলে তবেই ঘর থেকে বেরোতে পারেন। মাঝেমধ্যে খিঁচুনি হয়। দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কাছের জিনিস কিছুটা নজরে এলেও দূরের সব কিছুই প্রায় ঝাপসা। বিছানায় বসে থাকা ওই মধ্যবয়সিকে ভোট নিয়ে প্রশ্ন করতেই বলে উঠলেন, ‘‘এই ভোটই তো আমার সব শেষ করে দিল! এলাকায় নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করায় সব রাগ এসে পড়েছিল আমার উপরে। মারের চোটে মাথার খুলি টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। এখনও ঘাড়, মাথা বেশি নাড়াচাড়া করলে যন্ত্রণা করে। ভোট দিয়ে আর কী হবে?’’

বারাসত-১ নম্বর ব্লকের পিরগাছার ঘরে বসে কথাগুলো বলতে বলতে চোখের জল মুছছিলেন মহম্মদ আবদুল্লা। কিছুটা থেমে পাশে বসে থাকা বছর নয়েকের ছেলে মেহেরামকে জড়িয়ে ধরে ফের বললেন, ‘‘অনেকে তো পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন না। তবে আমি এখন করি। আমারই তো পুনর্জন্ম হয়েছে।’’

পুনর্জন্মই বটে! ২০২৩ সালের জুলাই মাস। রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে নির্দল-তৃণমূল সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল বারাসত-১ ব্লকের পিরগাছা এলাকা। নির্দল প্রার্থীর সমর্থকদের ধরে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ ওঠে শাসকদল তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ভোটের আগের রাতে লাঠি, রড, বাঁশ দিয়ে আবদুল্লা-সহ একাধিক নির্দল সমর্থককে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। সেই ঘটনায় আবদুল্লা-সহ পাঁচ জন গুরুতর জখম হন। বারাসত হাসপাতালে তাঁদের ভর্তি করা হয়। আবদুল্লার মাথার খুলি রডের আঘাতে কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ভোরে হাসপাতাল থেকে এলাকায় খবর আসে, মৃত্যু হয়েছে আবদুল্লার। তাঁর মৃত্যুর এই ‘গুজবে’ কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল গোটা এলাকা। রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসও চলে এসেছিলেন সেখানে। যদিও পরে জানা যায়, অবস্থা সঙ্কটজনক হলেও বেঁচে আছেন আবদুল্লা। তাঁকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।

বারাসত থেকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ এবং পরে বিমানবন্দরের কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে আবদুল্লার চিকিৎসা চলে। মাসখানেক সেখানে ভর্তি থাকার পরে হাসপাতাল থেকে তাঁকে ছাড়া হলেও তখনই বাড়ি ফিরতে পারেননি আবদুল্লা। হাসপাতাল সংলগ্ন এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাখতে হয়েছিল তাঁকে। আবদুল্লার দাদা আব্দুল রফিক বলেন, ‘‘আমরা ভরসা পাইনি ওকে বাড়িতে আনার। চিকিৎসকেরাও বলেছিলেন, এই অবস্থায় গাড়িতে করে বেশি দূরে নিয়ে না যেতে। ওই ঘটনার পরে বাড়ি ফিরেছিল প্রায় তিন মাস পরে।’’

লোকসভা ভোটের দিন এগিয়ে এলেও কোনও দলের প্রার্থী বা কর্মীরা এখনও পিরগাছার বাড়ির রাস্তায় এসে পৌঁছননি। ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা কেউ ফোনেও খোঁজ নেননি। ‘‘কোন মুখে আসবে? কোন মুখে এসে খোঁজ নিয়ে ভোট চাইবে? সেই পরিস্থিতি কি আর রয়েছে!’’— বলছেন আবদুল্লা। আরও বললেন, ‘‘আমরা সকলে তৃণমূলই করতাম। পঞ্চায়েতে অঞ্চলের প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় আমরা নির্দল প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলাম। এটাই হল আমাদের অপরাধ। সেই রাগ এসে পড়ে আমার উপরে। মারধরের চোটে মরেই তো গিয়েছিলাম, ভাগ্যের জোরে বেঁচে এসেছি।’’

আবদুল্লার বাড়িতে স্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন দুই মেয়ে এবং এক ছেলে। এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আগে নিজের কেব্‌লের ব্যবসার পাশাপাশি ছোটখাটো কাজ করে সংসার চলাতেন আবদুল্লা। এখন শরীরে আর সেই ক্ষমতা নেই। মাসকয়েক আগে এক জন কর্মী রেখে আবার কেব্‌লের ব্যবসা শুরু করেছেন বটে, তবে তাতে আর সংসার চলে না। দাদা, ভাইদের উপরে নির্ভর করতে হয়। বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই এলাকায় ভোটের ঢাকে কাঠি পড়লেও সে সব নিয়ে আর আগ্রহ নেই গোটা পরিবারের কারও। বরং ভোটের কোলাহল থেকে নিজেদের দূরে সরিয়েই রাখতে চান তাঁরা। এমনকি, ভোট দিতে যাবেন কি না, তা-ও এখনও ঠিক করে উঠতে পারেননি কেউ। আবদুল্লার স্ত্রী সাহানারা বিবির কথায়, ‘‘ভোটের কথা শুনলেই এখন ভয় হয়। মনে হয়, আবার কোনও বিপদ বয়ে আনবে না তো আমাদের সংসারে?’’

Lok Sabha Election 2024 Barasat Poll Violence

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}