জয়ের পর উল্লাস দলীয় সমর্থকদের। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।
আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে লোকসভা আসন ১৯টি। এর মধ্যে গত লোকসভা নির্বাচনে জোটশরিক দলকে ধরলে ১৩টি আসনই ছিল বিজেপির দখলে। এ বার বিজেপিকে রুখতে দিল্লি, পঞ্জাবের মতো বেশি লোকসভা আসনবিশিষ্ট কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে একসঙ্গে লড়েছিল ‘ইন্ডিয়া’। লক্ষ্য ছিল রাজ্যগুলির পাশাপাশি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতেও বিজেপির আসন যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।
তবে লোকসভা নির্বাচনে মিশ্র ফল দেখল ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি। কোথাও জিতল কংগ্রেস, কোথাও বিজেপি, আবার কোথাও চমক দেখালেন নির্দল প্রার্থীরা। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একটি মাত্র আসনে কংগ্রেসকে হারিয়ে জয়ী হয়েছে বিজেপি। বিজেপির হাত থেকে অল্প ব্যবধানে চণ্ডীগড় আসনটি ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। দাদরা ও নগর হাভেলি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে বিজেপি, আর দমন ও দিউ কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থীকে হারিয়ে চমক দেখিয়েছেন নির্দল প্রার্থী পটেল উমেশভাই বাবুভাই। লাদাখ আসনে কিস্তিমাত করেছেন আর এক নির্দল প্রার্থী শেরিং নামগয়াল। হারিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থীকে। গত বার এই আসনে জেতা বিজেপি চলে গিয়েছে তৃতীয় স্থানে।
লক্ষদ্বীপ আসনটি এ বার এনসিপি (শরদ পওয়ার)-এর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। গত বারের মতো এই লোকসভা নির্বাচনেও দিল্লির সাতটি লোকসভা কেন্দ্রে ফুটেছে পদ্মফুল। বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি আপ-কংগ্রেস জোট। পুদুচেরি আসনে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। জম্মু এলাকার দু’টি লোকসভা আসন উধমপুর এবং জম্মুতে জয় পেয়েছে বিজেপি। কাশ্মীর উপত্যকার ফলে অবশ্য চমক আছে। বারামুলা কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী শেখ এর রশিদের কাছে ২ লক্ষেরও বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)-এর নেতা ওমর আবদুল্লা। অনন্তনাগ রাজৌরি আসনে এনসি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পিপল্স ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)-র মেহবুবা মুফতি। শ্রীনগর আসনটিও ধরে রেখেছে এনসি।
দিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দিল্লি এবং পুদুচেরিকে ‘আধা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’ বলা হয়। কারণ, এই দুই রাজ্যেই নির্বাচিত সরকার রয়েছে। যা বাকি ছয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নেই। তবে এই দুই সরকারের হাতে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোনও ক্ষমতা নেই। বেশ কিছু বিষয়ে দুই সরকারকেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। দিল্লির বিধানসভা ভোটে আম আদমি পার্টি (আপ) বিপুল ভোটে জিতলেও গত লোকসভা ভোটে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দলকে খালি হাতেই ফিরিয়েছিলেন দিল্লিবাসী। রাজধানীর সাতটি আসনেই ফুটেছিল পদ্মফুল। এ বার অবশ্য দিল্লিরক্ষায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল আপ। চারটি আসনে নিজেরা লড়ে বাকি তিনটি আসন একদা প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসকে ছেড়ে দিয়েছিল তারা।
পুদুচেরি লোকসভা আসনে গত লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। এ বার ওই কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ ভি বৈইথিলিঙ্গমকেই প্রার্থী করেছিল তারা। ২০১৪ সালে পুদুচেরি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল ‘আধা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’টির মুখ্যমন্ত্রী এন রঙ্গস্বামীর প্রতিষ্ঠিত দল অল ইন্ডিয়া এনআর কংগ্রেস (এআইএনআরসি)। বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ-র শরিক এই দল এ বার এখানে প্রার্থী দেয়নি। জোটসূত্র অনুযায়ী বিজেপি প্রার্থীকেই সমর্থন করে তারা। আর তামিলনাড়ুর শাসকদল দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগাম (ডিএমকে) সমর্থন করেছিল কংগ্রেসকে।
লোকসভা নির্বাচন মিটলেই বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা জম্মু-কাশ্মীরে। তবে এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের তকমা নিয়ে থাকা ভূস্বর্গের পাঁচটি লোকসভা আসনের মাত্র দু’টিতে প্রার্থী দিয়েছিল বিজেপি— জম্মু এবং উধমপুর। উপত্যকার তিনটি আসনে লড়াই ছিল মূলত ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) এবং পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)-র মধ্যে। লড়াইয়ে ছিল সাজ্জাদ লোনের পিপলস কনফারেন্সও (জেকেপিসি)। উপত্যকার তিনটি আসনে প্রার্থী দেয়নি বিজেপি এবং কংগ্রেস। তবে জম্মুর দু’টি আসনেই কংগ্রেসকে সমর্থন জানিয়েছিল ‘ইন্ডিয়া’র শরিক পিডিপি এবং এনসি।
গত লোকসভা ভোটের সময়ও লাদাখ সাবেক জম্মু-কাশ্মীরের অংশ ছিল। ২০১৯ সালের অগস্টে জম্মু-কাশ্মীরের পাশাপাশি লাদাখকেও পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়। এ বার কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির একমাত্র লোকসভা কেন্দ্র লাদাখে প্রার্থী বদল করেছিল বিজেপি। বিদায়ী সাংসদ জামইয়াং সেরিং নামগয়ালের পরিবর্তে প্রার্থী করা হয় লাদাখের রাজধানী লেহ-র স্বশাসিত পার্বত্য উন্নয়ন পর্ষদের প্রধান তাশি গ্যালসনকে। প্রসঙ্গত, লাদাখকে আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া, একটির পরিবর্তে দু’টি লোকসভা কেন্দ্র করা, খনি ব্যবসায়ী এবং শিল্পগোষ্ঠীগুলির হাত থেকে লাদাখের প্রকৃতিকে রক্ষা করা এবং সর্বোপরি সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে লাদাখকে অন্তর্ভুক্ত করা— এই চার দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরেই আন্দোলন চলছে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটিতে। সম্প্রতি এই দাবিগুলিকে সামনে রেখে ২১ দিন অনশনে বসেছিলেন সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচুক। ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির নায়ক ফুংসুক ওয়াংড়ুর মধ্যে যাঁর ছায়া দেখেন অনেকে। এই আবহে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া রুখতে প্রার্থী বদল করার সিদ্ধান্ত নেয় বিজেপি। তার পরেও অবশ্য দলের মধ্যে একাধিক চোরাস্রোত ছিল। প্রার্থী বদলের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিদায়ী সাংসদ জামইয়াং।
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সংসদীয় রাজনীতিতে বাঙালি রাজনীতিকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন বরাবর। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির ওই একই নামের একমাত্র লোকসভা কেন্দ্রের আট বারের কংগ্রেসি সাংসদ ছিলেন মনোরঞ্জন ভক্ত। ১৯৯৯, ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে এই আসনে জয়ী হন বিজেপির বিষ্ণুপদ রায়। ২০১৯ সালে বিজেপিকে হারিয়ে আসনটি পুনর্দখল করে কংগ্রেস। পদ্ম প্রার্থী বিশাল জলিকে এক হাজারের সামান্য বেশি ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন কংগ্রেস প্রার্থী কুলদীপ রাই শর্মা। এ বারও কুলদীপকে প্রার্থী করেছিল ‘হাত’ শিবির। পক্ষান্তরে, বিষ্ণুপদকেই আবার প্রার্থী হিসাবে ফিরিয়ে এনেছিল বিজেপি। আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল সিপিএমও। ২০১৪ সালে এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন অনিতা মণ্ডল। জিততে পারেননি। বর্তমানে তিনি বিধাননগর পুরনিগমের ডেপুটি মেয়র।
দেশভাগের পর নতুন রাজধানী পায় পঞ্জাব। ষাটের দশকে পঞ্জাব ভেঙে হরিয়ানা জন্ম নেওয়ার পর চণ্ডীগড়কেই দুই রাজ্যের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু সেই শহর নিয়ে দুই রাজ্যের টানাপড়েন বন্ধে চণ্ডীগড়কে ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’ বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে কেন্দ্রশাসিত চণ্ডীগড়ের প্রথম লোকসভা নির্বাচনেই জয়ী হয়েছিল বিজেপির পূর্বসূরি সংগঠন জনসঙ্ঘ। ২০১৪ আর ২০১৯ সালে এই কেন্দ্রে জয়ী হন অনুপম খেরের স্ত্রী তথা অভিনেত্রী কিরণ খের। এ বার অবশ্য কিরণকে টিকিট দেয়নি পদ্মশিবির। তাঁর পরিবর্তে প্রার্থী হয়েছিলেন পঞ্জাবের প্রথম সারির বিজেপি নেতা, অধুনা প্রয়াত বলরাম দাস টন্ডনের পুত্র সঞ্জয় টন্ডন। আর কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল হরিয়ানার ‘ভূমিপুত্র’ তথা পঞ্জাবের আনন্দপুর সাহিব কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ মণীশ তিওয়ারিকে।
আত্মীয়কে খুনের চেষ্টার অপরাধে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে লক্ষদ্বীপের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)-র সাংসদ মহম্মদ ফয়জ়লের ১০ বছরের কারাবাসের নির্দেশ জারি করে কাভারাত্তির দায়রা আদালত। ওই বছরেরই মার্চ মাসে সাংসদ পদ খোয়াতে হয় তাঁকে। তবে চলতি বছরের গোড়ার দিকে ফয়জ়লের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় কেরল হাই কোর্ট। স্থগিত হয়ে যায় উপনির্বাচনও। সাংসদ পদ ফিরে পান ফয়জ়ল। তফসিলি জনজাতি সংরক্ষিত লক্ষদ্বীপ আসনে এ বারেও তাঁকে প্রার্থী করেছিল এনসিপি (শরদ পওয়ার)। আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল এনসিপির অজিত পওয়ার গোষ্ঠী। ২০০৯ সালে শেষ বার এই কেন্দ্রে জিতেছিল কংগ্রেস। সে বারের জয়ী প্রার্থী মহম্মদ হামদুল্লা সইদকে এ বার প্রার্থী করেছিল তারা।
মহারাষ্ট্র এবং গুজরাতের সীমানায় অবস্থিত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দাদরা ও নগর হাভেলি এবং দমন ও দিউতে দু’টি লোকসভা আসন— দাদরা ও নগর হাভেলি এবং দমন ও দিউ। সাত বার দাদরা ও নগর হাভেলি কেন্দ্র থেকে জিতে সংসদে গিয়েছিলেন মোহন সঞ্জীভাই দেলকার। কখনও বিজেপির টিকিটে। কখনও বা কংগ্রেসের টিকিটে। ২০১৯ সালে নির্দল সাংসদ হিসাবেও জয়ী হন তিনি। ২০২০ সালে তিনি নীতীশ কুমারের দল জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ)-তে যোগ দেন। ২০২১ মুম্বইয়ের একটি হোটেলে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় মোহনের। তাঁর শূন্যস্থান পূরণে রাজনীতিতে আসেন স্ত্রী কলাবেন দেলকার। উপনির্বাচনে সাবেক শিবসেনা প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন তিনি। পরে শিবসেনায় ভাঙন ধরলে তিনি উদ্ধব ঠাকরেকেই সমর্থন করেছিলেন। একনাথ শিন্ডে শিবিরে যাননি। তবে লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দেন। টিকিটও পান। বিরোধী জোটের তরফে কেবল কংগ্রেসই এই আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। অন্য দিকে, ২০১৪ সালে দেশে পালাবদলের পর রং বদলায় দমন ও দিউ-ও। ২০১৪ এবং ২০১৯— পর পর দু’বার এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। এ বার অবশ্য প্রার্থী বদল করে তারা। পদ্মশিবিরের সঙ্গে এই কেন্দ্রে দ্বিমুখী লড়াই ছিল কংগ্রেসের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy