—ফাইল চিত্র।
এক দশক আগে ‘নরেন্দ্র মোদী প্যাকেজে’ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বিহারের চিরাচরিত জাতপাতের রাজনীতি। পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও বজায় ছিল সেই ধারা। ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর সেই চেনা ছক হাতিয়ার করেই এ বারও আরজেডি-কংগ্রেস-বামেদের ‘মহাগঠবন্ধন’কে টেক্কা দিল নরেন্দ্র মোদী-নীতীশ কুমার-চিরাগ পাসোয়ানদের এনডিএ।
বিহারের ৪০টি লোকসভা আসনের মধ্যে, এনডিএ জিতছে ৩০টি আসন । বিজেপি এবং জেডিইউ ১২টি করে। এজেপিআর পাঁচ এবং ‘হাম’ একটিতে। অন্য দিকে, বিরোধী জোটের শরিক আরজেডি চার, কংগ্রেস তিন এবং সিপিআইএমএল লিবারেশন দু’টি লোকসভা আসন পেয়েছে। পূর্ণিয়ায় জয় পেলেন সদ্যপ্রাক্তন কংগ্রেস নেতা তথা ‘বাহুবলী’ নির্দল প্রার্থী পাপ্পু যাদব।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় বিজেপির কমণ্ডল রাজনীতির মোকাবিলায় অভিভক্ত জনতা দলের মণ্ডল রাজনীতির সূচনা পর্ব থেকেই বিহারের রাজনীতি অগ্রসর (সবর্ণ) এবং অনগ্রসরে (পিছড়া) দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। লালকৃষ্ণ আডবাণীর রামরথ রুখে দিয়ে বিহারে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ককে নিশ্চিত করে নিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। পরের দেড় দশক এই যাদব-মুসলিম (এম-ওয়াই) সমীকরণকে হাতিয়ার করে তিনি মগধভূমি শাসন করেছেন।
কিন্তু বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৫ সালে পটনার কুর্সি দখলের পরে কুর্মি নেতা নীতীশ কুমার দ্রুত লালুর সেই ভোটব্যাঙ্কের মোকাবিলায় নতুন সমীকরণ গড়ায় মন দিয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রেও জাতপাতের অঙ্ক কষেই এগিয়েছিলেন তিনি। বিহারে জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) ভুক্ত। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যাদব, কুশওয়াহা-কোয়েরি এবং কুর্মিরা। বিহারে যাঁরা ‘ওয়াইকেকে’ নামে পরিচিত। এর মধ্যে যাদব প্রায় ১৫ শতাংশ, কুশওয়াহা-কোয়েরি ৭ শতাংশ এবং কুর্মি ৫ শতাংশ। অর্থাৎ, মোট ওবিসির অর্ধেকের কিছু বেশি। বাকি অংশ ১৩০টি ‘সাব-কাস্ট’ মিলে। কিন্তু সম্পদ, শিক্ষা-চাকরি-সহ সরকারি সুযোগসুবিধা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে অন্য অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলিকে পিছনে ফেলেছে ওয়াইকেকে-র তিনটি জাত।
নীতীশ ঠিক সেই জায়গাতেই থাবা বসাতে চেয়েছিলেন। ওই ১৩০টি সাব-কাস্টকে তাঁর সরকার ‘মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট’ বা এমবিসি (‘অতি পিছড়া’ এবং ‘ইবিসি’ নামেও পরিচিত) হিসেবে চিহ্নিত করে। পঞ্চায়েত ও নগরপালিকার ভোটে সংরক্ষণ দিয়ে তাদের ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করেছিল নীতীশ সরকার। সেই সঙ্গে দলিতদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা চামার (যাঁরা প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে পরিচিত) জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে একেবারে পিছিয়ে থাকা শ্রেণিগুলিকে ‘মহাদলিত’ মর্যাদা দিয়ে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন নীতীশ।
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে এনডিএ ছেড়ে আলাদা লড়তে নেমে অবশ্য সেই ‘অঙ্কের’ সুফল নীতীশ পাননি। মোদীর প্রবল পরাক্রম আর জনপ্রিয়তায় ভর করে সে বার ত্রিমুখী লড়াইয়ে অনায়াসে জিতেছিল এনডিএ। রাজ্যের ৪০টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি একাই জিতেছিল ২২টিতে। সহযোগী দলিত নেতা রামবিলাসের লোক জনশক্তি পার্টি (এলজেপি) ছ’টি এবং কুশওয়াহা-কোয়েরি জনগোষ্ঠীর ‘মুখ’ উপেন্দ্র কুশওয়াহার আরএলএসপি তিনটি আসনে জিতেছিল। একা লড়ে নীতীশের জেডিইউ মাত্র দু’টিতে! বিরোধী জোটের আরজেডি চার, কংগ্রেস দুই এবং এনসিপি একটিতে জেতে ২০১৪ সালে।
কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি হল শাঁখের করাত। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিহারে মোদীর বিজেপি যখন বিপুল ভাবে জয়ী হল, তখন কেউ ভাবতেও পারেননি, দেড় বছরের মাথাতেই বিধানসভা নির্বাচনে লালু-নীতীশ-কংগ্রেসের ‘মহাগঠবন্ধন’-এর হাতে তারা কচুকাটা হবে। সেই ভোটে বিজেপি, রামবিলাস, জিতনরাম মাঁঝির উচ্চবর্ণ-দলিত সমীকরণকে অনায়াসে টেক্কা দিয়েছিল ‘মহাগঠবন্ধন’-এর সংখ্যালঘু-অনগ্রসর ভোটব্যাঙ্ক। এমনকি, ভোটের ফল বিশ্লেষণে ধরা পড়েছিল বিজেপির চিরাচরিত ‘ভূরাবাল’ (উচ্চবর্ণের চার জাত, ভূমিহার, রাজপুত, ব্রাহ্মণ এবং লালা বা বৈশ্য) ভোটব্যাঙ্কে ফাটলও! কিন্তু লালুপ্রসাদের পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১৭ সালে ফের বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান নীতীশ। ২০১৯ সালে জাতপাতের অঙ্ক আর পুলওয়ামা-বালাকোট পরবর্তী দেশপ্রেমের আবেগকে হাতিয়ার করে বিরোধীদের কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেয় এনডিএ।
২০১৯ সালের সেই লোকসভা নির্বাচনে ৫৩ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে বিহারের ৪০টি আসনের মধ্যে ৩৯টি দখল করেছিল এনডিএ। বিজেপি ১৭, জেডিইউ ১৬ এবং এলজেপি ছ’টিতে জিতেছিল। লালুর আরজেডি একটি আসন না পেলেও তাদের সহযোগী কংগ্রেস একটিতে জিতে বিরোধীদের মুখরক্ষা করে। সেই ভোটে প্রমাণ হয়েছিল, জিতনরামের হাম, উপেন্দ্রর আরএসএলপি এবং মৎস্যজীবী ‘মাল্লা’ জনগোষ্ঠীর নেতা মুকেশ সহানীর ভিআইপি পার্টিকে সঙ্গী করে কোনও লাভ হয়নি লালুর। সাকুল্যে বিরোধী জোট পেয়েছিল ৩০ শতাংশ ভোট। ‘যাদবগড়’ নামে পরিচিত মধেপুরা, সারণের মতো আসনেও হেরেছিল আরজেডি।
জিতন এবং উপেন্দ্র এ বার বিজেপি শিবিরে ভিড়লেও আরজেডির সঙ্গে ছিলেন মুকেশ। অন্য দিকে, পিতা রামবিলাসের মৃত্যুর পরে ২০২০ সালের বিধানসভা ভোটে আলাদা লড়ে এনডিএ থেকে ছিটকে যাওয়া চিরাগকে আবার পাশে টেনেছিলেন মোদী-শাহেরা। ব্রাত্য করেছিলেন গত দেড় বছর ধরে মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য, এলজেপির অন্য গোষ্ঠীর নেতা পশুপতি পারসকে। সম্পর্কে যিনি চিরাগের কাকা।
সেই সঙ্গে ছিলেন নীতীশও। ২০২০ সালে বিহারের বিধানসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গী হয়ে লড়ে জিতলেও ২০২২ সালের অগস্টে এনডিএ ছেড়ে বিহারে আরজেডি-কংগ্রেস-বামেদের সমর্থন নিয়ে ‘মহাগঠবন্ধন’ সরকার গড়েছিলেন নীতীশ। এর পর টানা এক বছর ধরে জাতীয় স্তরে বিরোধী জোট গড়ে তুলতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, উদ্ধব ঠাকরে, অরবিন্দ কেজরীওয়াল, অখিলেশ যাদবদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘ইন্ডিয়া’ ছেড়ে আবার ফিরে যান এনডিএ-তে।
অন্য দিকে, বিরোধী শিবিরে ‘নতুন শরিক’ হয়েছিল ২০১৯ সালে সব মিলিয়ে আড়াই শতাংশ ভোট-পাওয়া তিন বাম দল। অর্থাৎ, জাতপাতের অঙ্কে এগিয়ে ছিল এনডিএ। তা ছাড়া, আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধীদের মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ্যে এসেছিল ভোটের আগেই। তেজস্বীর আপত্তিতেই প্রাক্তন ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার, বাহুবলী পাপ্পু যাদবকে কংগ্রেস ‘বঞ্চনা’ করতে বাধ্য হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে জোটের অন্দরে। ভোটের ফল বলছে পূর্ণিয়ার নির্দল প্রার্থী হয়ে জিততে চলেছেন কংগ্রেস নেতা পাপ্পু। তেজস্বীর দলের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ভূমিপুত্র কানহাইয়াকে বেগুসরাই না ছেড়ে বাম দল সিপিআই-কে দেওয়ার সিদ্ধান্তও ‘বুমেরাং’ হয়েছে। সেখানে আবার জিতেছেন বিজেপির গিরিরাজ সিংহ।
‘মহাগঠবন্ধন’-এ থাকাকালীন যে ভাবে নীতীশ বিহারে জাতসমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করে ওবিসিদের জন্য বাড়তি সংরক্ষণের বিল বিধানসভায় পাশ করিয়েছিলেন, তারও সুফল তারা পেতে পারে বলে মনে করেছিলেন ভোটপণ্ডিতদের অনেকেই। ভোটের ফলেও সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। পরিচিত প্রার্থীদের মধ্যে বিজেপির রবিশঙ্কর প্রসাদ (পটনাসাহিব), রাধামোহন সিংহ (পূর্ব চম্পারণ), রাজীবপ্রতাপ রুডি (সারণ) জিতেছেন। আরজেডি প্রধান লালুর জ্যেষ্ঠ কন্যা মিসা ভারতী (পাটালিপুত্র) জিতলেও আর এক কন্যা রোহিণী আচার্য (সারণ) হেরেছেন। এলজেপি প্রধান চিরাগ পাসোয়ান (হাজিপুর), প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ‘হাম’ সভাপতি জিতনরাম (গয়া), প্রাক্তন জেডিইউ সভাপতি লাল্লন সিংহ (মুঙ্গের), কংগ্রেস নেতা তারিখ আনোয়ার (কাটিহার) এবং লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার মীরা কুমারের পুত্র মনোজ (সাসারাম) জয়ী হয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy