বিশ্বজিৎ দাস। —ফাইল চিত্র।
নিজের খাসতালুকেই এ বার ধরাশায়ী হলেন বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস। বনগাঁ উত্তর বিধানসভা এলাকার ভূমিপুত্র বিশ্বজিৎ। এখান থেকেই বিশ্বজিতের রাজনৈতিক জীবনের উত্থান। কিন্তু সেখানেই বিজেপি প্রার্থীর থেকে পিছিয়ে গিয়েছেন ২৫ হাজার ৩০ ভোটে!
বনগাঁ উত্তর কেন্দ্র এলাকাতেই জীবনে প্রথম পঞ্চায়েত ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন বিশ্বজিৎ। তারপর থেকে ছিল শুধুই সাফল্য। পঞ্চায়েত সমিতির আসনে জয়ী হয়ে কর্মাধ্যক্ষ হন। ২০১১ এবং ২০১৬ সালে বনগাঁ উত্তর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে বিধায়ক হয়েছেন। বিশ্বজিতের বাড়ি গোপালনগরে। সেটিও এই কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। বিশ্বজিতের আত্মবিশ্বাস ছিল, এই কেন্দ্র থেকে এ বার এগিয়ে থাকবেন।
কিন্তু লোকসভা ভোটের ফল বলছে, নিজের খাসতালুকে পিছিয়ে আছেন বিশ্বজিৎ। এই কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে বনগাঁ পুরসভা। পুরসভার ২২টি ওয়ার্ডেই বিশ্বজিৎ পিছিয়ে। ৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে চারটিতে পিছিয়ে। যার মধ্যে রয়েছে তাঁর নিজের পঞ্চায়েত গোপালনগর ১। গঙ্গানন্দপুর, গোপালনগর ২ এবং ঘাটবাওর পঞ্চায়েত থেকে কেবল বিশ্বজিৎ এগিয়ে আছেন।
কেন এমন ফলাফল?
তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, বিশ্বজিৎকে জেতাতে কিছু নেতা, জনপ্রতিনিধির মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল। গোষ্ঠীকোন্দলের চোরা স্রোত বয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া, বিশ্বজিৎ এই বিধানসভা এলাকায়, বিশেষ করে বনগাঁ শহরে প্রচারে কম সময় দিয়েছেন। এ সবের প্রভাব পড়েছে ভোটে।
বনগাঁ উত্তর অনেক দিন থেকেই তৃণমূলের গলার কাঁটা। ২০১৯ সালে তৃণমূল প্রার্থী বনগাঁ উত্তরে ২৮ হাজার ৩৭০ ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী পরাজিত হয়েছিলেন ১০ হাজার ৪৮৮ ভোটের ব্যবধানে।
বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তথা তৃণমূল নেতা প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘ভোটে প্রার্থীকে জেতানোর বিষয়ে নেতাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা এবং আন্তরিকতার অভাব ছিল। জনপ্রতিনিধি এবং দলের একাংশের নেতাদের জনবিচ্ছিন্নতা এবং দাম্ভিকতাও আমাদের এখানে হারের কারণ।’’ বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি সৌমেন দত্তের কথায়, ‘‘আমাদের নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। দায়িত্ব নিয়ে কেউ ভোট করাতে আসেননি।’’
গত পুরভোটে বিশ্বজিৎকে বনগাঁয় দলের পক্ষ থেকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল সে বার ১৯টিতে জয়ী হয়। পঞ্চায়েত ভোটে সাতটি পঞ্চায়েতেই তৃণমূল ক্ষমতা দখল করেছিল। বনগাঁ পুরসভায় হতাশাজনক ফল হওয়ায় পুরপ্রধান গোপাল শেঠ বলেন, ‘‘আমরা সর্বতো ভাবে চেষ্টা করেছিলাম। এই ফল অপ্রত্যাশিত।’’
তৃণমূলের অন্দরে শুরু হয়েছে ময়না তদন্ত। নেতাদের অনেকের মতে, অটো, টোটো, ভ্যান, বাস-ট্রাক চালকদের পুরো সমর্থন পাওয়া যায়নি। শহরের এক পরিবহণ শ্রমিকের কথায়, ‘‘কাজকর্ম বন্ধ রেখে ঘনঘন মিটিং-মিছিলে যাওয়াটা আমাদের অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। অনেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তার প্রভাব ভোটে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়।’’ যদিও তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি নারায়ণ ঘোষের দাবি, ‘‘পরিবহণ শ্রমিকেরা কেউ আমাদের বাইরে যাননি বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমরা অত্যন্ত পরিশ্রম রেছি। মানুষ কেন আমাদের ভোট দিলেন না, বলতে পারব না।।’’ বনগাঁ পুরসভার এক তৃণমূল কাউন্সিলর আবার বলেন, ‘‘আমরা হেরেছি অন্তর্কলহের কারণে। প্রার্থীকে জেতানোর তাগিদ আমাদের অনেকেরই ছিল না।’’
তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে বিশ্বজিতের বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফিরে আসা, বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি হওয়া, লোকসভার টিকিট পাওয়াটা দলের কিছু নেতা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরাই এ বার বিশ্বজিৎ হারাতে সক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘এ বার বিশ্বজিৎ দাসের বিরুদ্ধে এখানে কানে কানে প্রচার হয়েছে। দলের কিছু নেতা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, বিশ্বজিৎ জিততে পারবেন না।’’
রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করছেন, গত পুরসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটে রিগিং, ছাপ্পা, সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছিল শাসক দলের বিরুদ্ধে। ভোটে তার প্রভাব পড়ে থাকতে পারে।
অনেকে আবার মত, বনগাঁর প্রাক্তন পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যের না থাকাটাও তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রভাব ফেলেছে। শঙ্করের সাংগঠনিক দক্ষতার কথা অনেকেই স্বীকার করেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এ নিয়ে তৃণমূল কর্মীরা বিভিন্ন পোস্ট করছেন। অনেকেই মনে করছেন, শঙ্কর জেলের বাইরে থাকলে তৃণমূল এই বিধানসভায় আরও ভাল ফল করতে পারত। রেশন দুর্নীতি মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হয়ে তিনি এখন জেলে রয়েছেন।
বিশ্বজিতের পরাজয়ের পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় তৃণমূলের কর্মীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছেন। পরাজয়ের পরে বিশ্বজিতের প্রতিক্রিয়া, ‘‘বামেদের ভোট বিজেপিতে চলে যাওয়ায় এবং আমি নিজে এই কেন্দ্রে, বিশেষ করে শহর এলাকায় প্রচারে বেশি সময় দিতে পারিনি। কল্যাণী, হরিণঘাটা আমার কাছে তুলনায় অপরিচিত জায়গা ছিল। সেখানে সময় বেশি দিতে হয়েছিল। বনগাঁ শহরে স্থানীয় নেতা, জনপ্রতিনিধিরা প্রচার করেছিলেন।’’ বিশ্বজিতের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘আমি বিজেপির কাছে পরাজিত হইনি। হারের কারণ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েছি।’’
২০১৯ সালে সিপিএম-কংগ্রেস আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে। বনগাঁ উত্তর থেকে সিপিএম-কংগ্রেসের যৌথ ভোট ছিল ১২ হাজার ২২৫। এ বার কংগ্রেস-বামেদের আসন সমঝোতা হয়েছে। কংগ্রেস প্রার্থী এই কেন্দ্রে পেয়েছেন ৭০৬৬
ভোট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy