অধীররঞ্জন চৌধুরী। ছবি: পিটিআই।
২০১৪ সালে অধীররঞ্জন চৌধুরী বহরমপুরে জিতেছিলেন সাড়ে তিন লক্ষের বেশি ভোটে। সে বার তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অধুনা রাজ্যের মন্ত্রী তৃণমূলের ইন্দ্রনীল সেন। ২০১৯ সালে সেই ব্যবধান গোত্তা খেয়ে নেমে এসেছিল অনেকটা। অধীর জিতেছিলেন। তবে ৮০ হাজার ভোটে। সাড়ে তিন লক্ষ থেকে নেমে ৮০ হাজার! সেই বহরমপুরেই।
অধীর এ বারও লড়ছেন। বহরমপুরেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তিনি ঘন ঘন মেজাজ হারাচ্ছেন। ঘন ঘন বিক্ষোভের মুখেও পড়ছেন। কখনও প্রতিপক্ষকে কষিয়ে থাপ্পড় মেরে দিচ্ছেন, কখনও সপাটে ধাক্কা। পাঁচ বারের সাংসদ, পোড়খাওয়া রাজনীতিক, লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর কি ‘স্নায়ুর চাপ’ ধরে রাখতে পারছেন না? অধীর নিজে অবশ্য তা মানছেন না। মানার কথাও নয়। তবে ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেসের নেতারা মানছেন, অধীর ক্রুদ্ধ হচ্ছেন। রেগে যাচ্ছেন। পাশাপাশিই তাঁদের বক্তব্য, রেগে যাওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। কিন্তু মানুষ সেটা দেখছে না। মানুষ শুধু অধীরের প্রতিক্রিয়াটা দেখছে। আর তার থেকে ধারণা তৈরি করে নিচ্ছে।
অধীর নিজে কী বলছেন? ‘মুর্শিদাবাদের রবিনহুড’-এর বক্তব্য, ‘‘ওরা চায় আমি ওদের মারি। গুন্ডা তো! ওরা সেই প্ররোচনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছু লাথখোরকে নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ও সব দিয়ে আমায় রোখা যাবে না।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই বিরোধী পক্ষ অধীরের ‘ক্ষোভ’ (মতান্তরে ‘ক্রোধ’) নিয়ে ময়দানে নেমেছে। বহরমপুরের বিজেপি বিধায়ক সুব্রত মৈত্র যেমন বলছেন, ‘‘এর আগে এমন দেখিনি। অধীরবাবুর প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট, তিনি জমি হারাচ্ছেন। সে কারণেই এই রকম বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে।’’ তবে একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূল যে ভাবে উত্ত্যক্ত করা শুরু করেছে, প্রার্থীকে দেখলেই গো ব্যাক স্লোগান দিচ্ছে, তা কখনও রাজনৈতিক সংস্কৃতি হতে পারে না। শুধু অধীরবাবু নন, মুর্শিদাবাদে আমাদের প্রার্থী গৌরীশঙ্কর ঘোষকে ঘিরেও তৃণমূল জলঙ্গিতে একই কাণ্ড ঘটিয়েছে। এই সংস্কৃতি বাংলার ভবিষ্যতের জন্য শুভ সঙ্কেত নয়।’’
সিপিএমের সঙ্গে জোট গড়ে ভোটে লড়ছেন অধীর। সেই সিপিএমের মুর্শিদাবাদের জেলা সম্পাদক জ়ামির মোল্লার বক্তব্য, ‘‘অতীতে কখনও অধীর চৌধুরীকে এই রকম অসভ্যতার মুখোমুখি হতে হয়নি। তৃণমূল নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারছে। ওরা বুঝতেও পারছে না, ওরা যত এগুলো করবে, অধীর চৌধুরীর ভোট তত বাড়বে।’’ শনিবারেও নওদায় অধীরের গাড়ি ঘিরে ধরে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দিয়েছে তৃণমূল। কংগ্রেস সাংসদের অনুগামীদের সঙ্গে একপ্রস্ত ধস্তাধস্তিও হয়েছে তৃণমূলের লোকজনের। পরে অবশ্য নওদার তৃণমূল বিধায়ক সাহিনা মমতাজ বলেছেন, ‘‘যে অসভ্যতা হয়েছে, তা ঠিক হয়নি। এটা আমরা সমর্থন করি না।’’
এক সময়ে মুর্শিদাবাদ জেলায় অধীরের ‘কাছের লোক’ ছিলেন হুমায়ুন কবীর। তার পর তিনি তৃণমূল, বিজেপি হয়ে ফের তৃণমূলে। এক সময় রাজ্যে কিছু দিনের জন্য মন্ত্রীও হয়েছিলেন। এখন তিনি ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক। তিনি কখনও অধীরের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, কখনও বিরোধী পরিসরে। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ওঁকে আজ থেকে দেখছি না। ওঁর মাথা বরফের মতো ঠান্ডা থাকত। বিশেষ করে মাঠ-ময়দানের রাজনীতিতে। ২০১৪ সালে অধীরকে আমি একটা এলাকায় আড়াই ঘণ্টা আটকে দিয়েছিলাম। সেই সময়ে আমার সঙ্গে অল্প তর্কাতর্কি করেছিলেন। কিন্তু এই রকম দেখিনি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘অধীর বোধ হয় বুঝতে পারছেন, ওঁর আর সংসদে যাওয়া হবে না।’’
তবে মুর্শিদাবাদের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা মনোজ চক্রবর্তীর বক্তব্য ভিন্ন। তাঁর কথায়, ‘‘অধীর চৌধুরী মেজাজ হারাচ্ছেন না। মেজাজ হারাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই তিনি এমন ভাষা বলছেন যে, টেলিভিশন চ্যানেলকে ‘বিপ’ বাজাতে হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম লিখতে পারছে না। আসলে তৃণমূল অসভ্যতা করছে। অধীর চৌধুরী তা রুখছেন।’’ বহরমপুরের অধীর-ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, ‘‘দাদাকে এমন এমন কথা বলা হচ্ছে যে, মাথা ঠান্ডা রাখা মুশকিল। মৃত স্ত্রী ও মেয়ের কথা তুলে অশ্রাব্য মন্তব্য করা হচ্ছে। কাঁহাতক মানুষ ধৈর্য রাখতে পারে!’’ সেই নেতা এ-ও বলছেন যে, বিবিধ কারণে এ বারের নির্বাচন অধীরের কাছে অতীতের তুলনায় ‘কঠিন’। তাঁর কথায়, ‘‘এই প্রথম অধীরদার বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিপক্ষ দল সংখ্যালঘু মুখকে প্রার্থী করেছে। অতীতে কখনও তা হয়নি।’’ বহরমপুরে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বহরমপুরে অধীরের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন আরএসপির প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়। ২০১৪ সালে তৃণমূলের হয়ে লড়েছিলেন গায়ক-রাজনীতিক ইন্দ্রনীল। গত ভোটে একদা অধীর-ঘনিষ্ঠ অপূর্ব সরকার ওরফে ডেভিডকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। সেই সময়ে মুর্শিদাবাদের তৃণমূলের সংগঠন দেখতেন শুভেন্দু অধিকারী।
গত লোকসভা ভোটে মুর্শিদাবাদে খাতা খুলেছিল তৃণমূল। জেলার তিনটি লোকসভা আসনের দু’টিতে ফুটেছিল জোড়াফুল। দল তৈরির পর প্রথম বার। তবে অধীর জিতেছিলেন। কিন্তু ব্যবধান এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গিয়েছিল। এ বারে তৃণমূল ইউসুফের মতো সংখ্যালঘু মুখকে প্রার্থী করায় হিন্দু ভোটের জোরালো মেরুকরণের আশঙ্কা করছেন কংগ্রেসের অনেক নেতা। তবে কেউ কেউ এমন বলছেন যে, ‘অধীর’ নামটাই আলাদা ফ্যাক্টর। ২০১৯ সালের পর পাঁচ বছরে ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। নবাবের জেলার হিন্দু মহল্লায় মাথা তুলেছে বিজেপি। খাস বহরমপুর শহরেই পদ্ম ফুটেছে বিধানসভা ভোটে। এবম্বিধ কারণেই কি অধীর এত ‘অধীর’? কারণ, এ বার তাঁর কুম্ভের দায়িত্ব। ৪ জুন প্রমাণিত হবে তাঁর ‘বহরমপুরের কেল্লা’ আসলই রয়েছে কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy