Advertisement
E-Paper

তৃণমূলকে পিছনে টানছে তৃণমূলই

কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে ২০১৯ সালে তৃণমূল জিতেছিল এক লক্ষ ২৭ হাজার ভোটে। তার পরে বিধানসভা ভোটে উত্তর কলকাতায় তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে লোকসভা ভোটের থেকেও প্রায় ৬০ হাজার বেশি ভোটে।

(বাঁ দিকে) সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস রায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

(বাঁ দিকে) সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস রায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

রবিশঙ্কর দত্ত

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৪ ০৬:৪২
Share
Save

দলের অনুগত হয়ে লোকসভায় গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন, জনসভায় দাঁড়িয়ে সে কথা ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। আবার তাঁর গলার কাঁথা স্টিচের উত্তরীয়র সঙ্গে উত্তর কলকাতার ‘মিল’ ধরে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। সেই সঙ্গেই ভোট চাইতে এসে মমতাই বলেছেন, ‘‘জানি না, এটা সুদীপদা’র শেষ নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি না...!’’

তবে কি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না মমতা?

প্রচার শেষের আড্ডায় এই প্রশ্ন শুনে তৃণমূলের কাশীপুর-বেলগাছিয়া অঞ্চলের তরুণ সংগঠক বলেছিলেন, ‘‘সুর একটু একটু কাটছে, এটা ঠিক। তবে তৃণমূলের ভোট আসে মমতাদি’র মুখ আর সাধারণ কর্মীর পরিশ্রমে। জিতব। মার্জিন হয়তো এ দিক-ও দিক হতে পারে।’’

অসম্পূর্ণ বাক্যে একটা জিনিস স্পষ্ট হল, এ বার উত্তর কলকাতার এই জোড়া স্তম্ভের একটি খানিক নড়বড়ে হয়ে রয়েছে। তৃণমূলে নীচের তলায় এই রকম অসন্তোষ, ব্যক্তিগত রাগারাগি, পছন্দ-অপছন্দ কোনও কেন্দ্রের ভোটের ফল একেবারে উল্টে দিতে পারে, তা-ও আবার কলকাতা শহরে, সে অঙ্ক মেলানো খুব সহজ নয়। কারণ, এখানে শেষ পর্যন্ত এই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায় ‘দিদি’ মমতার ব্যক্তিগত প্রভাব এবং প্রতাপ।

কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে ২০১৯ সালে তৃণমূল জিতেছিল এক লক্ষ ২৭ হাজার ভোটে। তার পরে বিধানসভা ভোটে উত্তর কলকাতায় তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে লোকসভা ভোটের থেকেও প্রায় ৬০ হাজার বেশি ভোটে। পুরভোটেও কলকাতা উত্তরে ৬০টি ওয়ার্ডের ৫৬টিই তাদের দখলে। অঙ্কের এই হিসাব দল ও তৃণমূল নেত্রীকে আশ্বস্ত রাখতেই পারে। পাঁচ বারের সাংসদ সুদীপও শরীরী ভাষায় তা ধরে রেখেছেন। এই লড়াইয়ে খানিকটা উপরে থেকেই সভায় সভায় তাই তিনিও জানাচ্ছেন, সংসদে প্রধানমন্ত্রীকে কী প্রশ্ন করেছেন। অর্থমন্ত্রীকে, বিজেপি সরকারকে কী ভাবে বিপাকে ফেলেছেন ইত্যাদি।

সে দিক থেকে সবই ঠিক ছিল। কিন্তু ঘরের কোন্দল এমন পেকেছে যে, তা একেবারে ভোটের লড়াইয়ে এসে দাঁড়িয়েছে এই কেন্দ্রে। মাসখানেক আগে তৃণমূল ছেড়ে আসা তাপস রায়কে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করে এই লড়াইকে জমিয়ে দিয়েছে বিজেপি। তাপসের সঙ্গে চলে যাওয়া তৃণমূলের লম্বা সময়ের ‘সম্পর্ক’ই এখানে দুর্ভাবনা হয়ে উঠেছে রাজ্যের শাসক শিবিরে। ব্যস্ত সুদীপকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে এ সব চর্চাকে আমল দিচ্ছেন না তৃণমূল প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দলে মমতার অন্যতম সঙ্গী, কলকাতার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তাপসের কথা তুলতেই বলে দিলেন, ‘‘তৃণমূলে ভোট শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে হয়। আমাদের কে গেল, আর কে এল, তাতে কিছুই হয় না!’’

কিন্তু সেই মমতাও যে এ বার অতিরিক্ত সময় আর কর্মসূচি নিয়েছেন এই কেন্দ্রে, তা চোখ এড়ায়নি দলের নেতাদের। তাই পুরনো সঙ্গী সেই সুদীপকে নিয়ে এ বার বাড়তি চিন্তার জল্পনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। কেন নিজের কর্মসূচি অদলবদল করে তৃণমূল নেত্রী বাড়তি সময় দিতে চেয়েছেন উত্তর কলকাতায়? কেনই বা নিজেই ফোন করছেন মুখ ফিরিয়ে থাকা পুরনো সংগঠক, মুখ-ভার দলীয় বিধায়কদের? জনসভায় বলছেন, দলের প্রতি তাঁর প্রার্থী সুদীপের আনুগত্য, কেন্দ্রের প্রতি ভালবাসার কথা।

দল বিজেপিকে বাদ দিলে হিন্দুত্বের চড়া গন্ধ নেই তাপসের বক্তৃতায়। বরং, পুরনো সঙ্গ আর নতুন মঞ্চের মিশেলেই চমক দিতে চাইছেন তিনি। তৃণমূল ঘুরে বিজেপিতে আসা এক সময়ের কংগ্রেসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছাত্র নেতা প্রকাশ্যে, গোপনে ‘খোঁজ’ করছেন অনেককে। পরিচিতির সুতোও কি নেড়েচেড়ে দেখছেন তাপস? জবাবে তাপস হাসলেন। বললেন, ‘‘রাজনীতি তো সম্পর্ক গড়ার। ছিন্ন করার নয়। তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস বলে কী আছে! আমি ভোটার হিসেবে দেখছি।’’ তাঁকে নিয়ে দুর্ভাবনা যে উড়িয়ে দেওয়ার নয়, তা স্পষ্ট করে বক্তৃতায় নাম না করে তাপস সম্পর্কে দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।

উত্তর কলকাতায় বিজেপির প্রভাব পুরনো। বড়বাজারকে কেন্দ্র করে শ্যামপুকুর, জোড়াসাঁকো অঞ্চলের সেই সুবিধা তাপসের আছে। সেই সঙ্গে তৃণমূলের ঘাঁটি হয়ে ওঠা বৌবাজার অঞ্চল থেকে মাথা তুলেছেন বিজেপির সজল ঘোষের মতো নেতা। প্রতিপক্ষকে আক্রমণের এই ভোট-বাজারে তাপসের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা অস্বীকার করছেন না তৃণমূলের নেতারা। পুরসভার দলীয় প্রতিনিধিদের বৈঠকে তা মেনে নিয়েছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিমও। তবে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, এ লড়াই দলের। সেখানে সেই সম্পর্কের কোনও জায়গা নেই। মধ্য কলকাতার তৃণমূল বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহার কথাতেও সেই সুর। তিনি বলেন, ‘‘তাপস দলে ছিল, উত্তর কলকাতায় দলকে জানে। তাতে এই লড়াইয়ে কিছুটা সুবিধা পেতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত তাতে কিছু হবে না, কারণ লড়াইটা বিজেপির বিরুদ্ধে।’’

এই উত্তর কলকাতায় তৃণমূলের জেলা সভাপতিও ছিলেন তাপস। সে সব মিলিয়ে-মিশিয়েই দলের শক্ত ঘাঁটিতেও কিছুটা সংশয় তৈরি হয়েছে। ব্যক্তি তাপস ঠিক কতটা প্রভাব ফেলতে পারেন তৃণমূলের জয়ের পথে? মলঙ্গা লেন ধরে গলি, তস্য গলির মধ্যেও সুদীপের কাছাকাছি তাপসের ছবি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, লড়াই-পর্বে তা মোটেই কম নয়। একই ছবি গিরিশ ঘোষের বাড়ি ছেড়ে বাগবাজারের রাস্তায় অথবা বেলেঘাটা খালপাড় বা শোভাবাজারের গ্রে স্ট্রিটের দু’ধারে। ভোটের ফল যা-ই হোক, বছরের পর বছর ধরে সুদীপ-বিরোধিতাকে নিজের তপস্যায় বদলে ফেলা তাপসই পিছন থেকে টেনে চলেছেন তৃণমূলকে।

এই তরজা, জল্পনা আর পাল্লা দেওয়া প্রচারে কিছুটা পিছিয়েই রয়েছেন বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী, প্রবীণ নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। ঘুরে, সভা দেখে স্বভাবসুলভ প্রশান্তির সুরে ‘আমাদের লোক কিছু কম হচ্ছে না’ বললেও দীর্ঘ দিনের রাজনীতিক নিশ্চিত টের পাচ্ছেন সুদীপ-তাপসে মূলত মেরুকৃত হয়ে গিয়েছে এখানকার লড়াই। তাঁর হয়ে প্রচারে এসে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলে যাচ্ছেন, ‘‘এখানে বাকি দুই বড় দলের প্রার্থী কংগ্রেসে বড় হয়ে সুযোগ বুঝে অন্য দলে চলে গিয়েছেন। প্রদীপদা তেমন নন, দুর্নীতির কালিও তাঁর গায়ে নেই। তাঁর আছে বিশ্বাসযোগ্যতা। মনে রাখবেন, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে!’’

সংখ্যালঘু ভোটে বাম-কংগ্রেসের মিলিত প্রার্থী তেমন ভাগ বসাতে পারলে আরও উত্তেজক হয়ে উঠবে কলকাতা উত্তরের লড়াই। সেখানে এসইউসি প্রার্থী বিপ্লব চন্দ্র আছেন আরও কিছুটা পিছনেই।

Lok Sabha Election 2024 Spot Reporting TMC Tapas Roy Sudip Banerjee

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}